আফরোজা পারভীন

  ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

ভিক্টর হুগোর লা মিজারেবল

সীমার মাঝে অসীমের ঠিকানা

ভিক্টর হুগোকে বলা হয় উনিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী রোমান্টিক লেখক। ‘লা মিজারেবলস’ এবং ‘দ্য হাঞ্চব্যাক অভ নটরডেম’ তাকে অমর করে রেখেছে।

হুগো প্রভাবিত ছিলেন রোমান্টিসিজম নামক সাহিত্যিক ধারার অগ্রপথিক এবং উনিশ শতকে ফ্রান্সের প্রখ্যাত চরিত্র François-René de Chateaubriand দ্বারা। যৌবনে তিনি প্রতিজ্ঞাও করেছিলেন হয় Chateaubriand-এর মতো হবেন অথবা কিছুই হবেন না। Chateaubriand-এর মতো হুগোও রোমান্টিসিজমের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যান। রিপাবলিকানিজমের সমর্থক হিসেবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি রাজনৈতিক মনোভাবের কারণে নির্বাসনে পর্যন্ত যেতে বাধ্য হন। তার রচনায় আবেগ আতিশয্য ছিল, ছিল বাগ্মিতা। আর সে কারণেই অল্প বয়সে সাফল্য এবং খ্যাতি অর্জন করেন। হুগোর প্রথম কবিতা সংকলন (Odes et poésies diverses) প্রকাশিত হয় ১৮২২ সালে। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২০। এ গ্রন্থের কারণে তিনি অষ্টাদশ লুইয়ের কাছ থেকে রাজকীয় ভাতা লাভের সম্মান পান। তবে ১৮২৬ সালে প্রকাশিত তার পরবর্তী বইটিই (Odes et Ballades) তাকে একজন মহান কবি, সুরকার এবং গীতিকার হিসেবে সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়।

‘লা মিজারেবল’ ফরাসি বিপবের পটভূমিকায় রচিত। রচনায় একযোগে সন্নিবেশ ঘটেছে তৎকালীন ফ্রান্সের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি এবং ফরাসি সমাজের ভালো-মন্দ, নীতিনৈতিকতা, দর্শন, ধর্ম। প্রাধান্য পেয়েছে মেহনতী মানুষের যাপিত জীবনের কথা।

Miserables শব্দের অর্থ হতভাগ্য। উপন্যাসের মূল চরিত্র জাঁ ভালজাঁ (Jean Valjean) সত্যিই এক হতভাগা। তার জীবনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা এ উপন্যাসের উপজীব্য। ক্ষুধার তাড়না সহ্য করতে না পেরে মাত্র এক টুকরো রুটি চুরি করে ভালজাঁ। ভালজাঁর বয়স তখন ১২ বছর। ওই বয়সে সে দণ্ডিত হয় পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। জেলে দণ্ড ভোগকালে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে সে বারেবারে পালানোর চেষ্টা করে। আর বারবারই ধরা পড়ে। শাস্তিস্বরূপ দণ্ড বাড়তে বাড়তে ১৯ বছরে গিয়ে দাঁড়ায়। সুদীর্ঘ ১৯ বছরের জেলজীবন পার করে জাঁ ভালজাঁর সমাজের প্রতি ভীতশ্রদ্ধা জন্মায়। সে হয়ে ওঠে তথাকথিত অমানুষ।

এমনকি যে পাদ্রি তাকে আশ্রয় দিয়েছিল তার বিড়ি চুরি করে সে ধরা পড়ে। কিন্তু পাদ্রির মহানুভবতায় সে ছাড়া পায়।

এ ঘটনাটি তাকে আমূল বদলে দেয়। অপরাধী জাঁ ভালজাঁ পরিচয় লুকিয়ে নাম নেয় ম্যাদেলিন। কঠোর পরিশ্রম করে। আর একসময় হয়ে ওঠে ফ্যাক্টরি মালিক এবং শহরের মেয়র। তখন তার জীবনে এসেছে অনেকটাই শান্তি আর স্বস্তি। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। শহরে নতুন আসা পুলিশ ইন্সপেক্টর জাঁভার্ট (Javert) চিনে ফেলে তাকে।

সুতরাং পালাতে হয় ভালজাঁকে। পালানোর সময় ভালজাঁ সঙ্গে নিয়ে যায় তার ফ্যাক্টরির কর্মচারী, তার ভালোবাসার মানুষ ফন্টিনের আগের প্রেমিকের সন্তান কোসেতকে।

প্যারিস শহরের এখানে-ওখানে লুকিয়ে কাটে পরের দিনগুলো। জাঁভার্ট খুঁজতে থাকে তাকে। কোসেত ক্রমে বড় হয়। রাজতন্ত্রবিরোধী বিপ্লবী মরিসের (Marius) প্রেমে পড়ে সে। ভালজাঁর পছন্দ হয় না। তবু মেয়ের সুখের কথা ভেবে মেনে নেয়। অন্যদিকে, বিদ্রোহ চলাকালে বিদ্রোহীদের হাতে আটক জাঁভার্টকে বাঁচিয়ে দেয় ভালজাঁ। বিদ্রোহে আহত মরিসকেও মরণপণ করে বাঁচায়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জাঁভার্টের হাতে ধরা পড়ে যায়। তখন ভালজাঁ নিজের প্রাণের বিনিময়ে ভিক্ষা চায় মরিসের জীবন।

আশ্চর্য হয়ে যায় জাঁভার্ট। মানসিক দোটানায় পড়ে ছেড়ে দেয় ভালজাঁকে। আর অতীত জীবনের গানি সইতে না পেরে সীন নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। শেষ জীবনটা কোসেত আর মরিসকে নিয়ে ভালোই কাটে ভালজাঁর।

উপন্যাসটি দীর্ঘ পাঁচ ভলিউমে প্রকাশিত। এত অল্প কথায় কাহিনি বোঝানো সম্ভব না। এর ব্যাপ্তি অসীম। প্রকাশের পরই বইটি ফরাসি বোদ্ধা মহলে প্রচ- সাড়া ফেলে। এ নিয়ে একটা গল্প আছে। গল্পটা এমন, ‘লা মিজারেবল’ প্রকাশের সময় হুগো ফ্রান্সের বাইরে ছিলেন। বইয়ের কাটতি কেমন জানতে তিনি প্রকাশককে চিঠি লেখেন কাগজে শুধু একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন (?) দিয়ে। আর প্রকাশক জবাব দেন চিঠিতে একটা বিরাট আশ্চর্যবোধক চিহ্ন (!) লিখে। এটাই নাকি বিশ্বের সবচেয়ে ছোট চিঠি।

পৃথিবীর অনেক ভাষায় অনুবাদ হয়েছে ‘লা মিজারেবল’। নির্মিত হয়েছে কমপক্ষে তিন ডজন চলচ্চিত্র। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, বই এবং চলচ্চিত্র দুটোই আজও পৃথিবীব্যাপী পাঠক-দর্শকের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়।

প্রিয় লেখক ভিক্টর হুগোর স্মৃতি আর কীর্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close