অপর্ণা খান

  ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

ভ্রমণ। শেষ পর্ব

মেঘ-পাহাড়ের সাজেক ভ্যালি

ভোরের আকাশ আমার মনের মতোই ভার ছিল। মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি নেই। ঝুলন্ত বারান্দায় বের হয়ে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলাম। যতটা নির্মল বাতাস নেওয়া যায়। ঢাকার যা অবস্থা সর্বত্র ফরমালিন। ভাবলাম, যাক বৃষ্টি নেই, খাগড়াছড়ি গিয়ে ঘোরাঘুরি করা যাবে। দূরে মেঘেদের সঙ্গে পাহাড়ের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা চলছে। দেখলাম, আমার আগেই সবাই উঠে গেছে এবং খোলা জায়গায় সেলফি তুলতে ব্যস্ত। নীরু আপা সেলফি স্টিক দিয়ে দেদার ছবি তুলে যাচ্ছে। বললাম, আস আমার ঘরে। সে ঢুকেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলল। বলল, বাহ কী দারুণ ঘর, তোমার রাতে ভয় করেনি। বললাম, হুম করেছিল সাপের।

আমি দ্রুত তৈরি হয়ে সেলফিতে যোগ দিলাম। গাইড শাকিল বলল, আপা ৮টার দিকে ব্রেকফাস্ট করে ১০টায় আমরা খাগড়াছড়ি রওনা দেব। খিচুড়ি ডিম ভুনা দিয়ে খেতে বেশ লাগছিল। আমাদের সঙ্গে এক ভদ্রলোক ও তার ছেলে ছিল, বেশ আলাপী। ওকে দেখে বারবার আমার ছেলে ঋদ্ধির কথা মনে পড়ল। ইস, ছেলেটা কি যে মিস করল। সিটি ব্যাংকে জব করে আরেকটি ছেলে ও ছোটভাই কামরুল আমরা এক টেবিলে খেতে বসেছিলাম। আলাপ হলো সবার সঙ্গে। প্যাকেজ ট্যুরে এটা একটা ভালো দিক অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। আমরা চা খেলাম, ছবিও তুললাম। সময় দ্রুত চলছে। কখন ১০টা বেজে গেল। সবাই আবার সেই চাঁদের গাড়িতে। আমার মন কেমন করে, কে জানে কাহার তরে। সত্যি খুব মন খারাপ হলো, আরেকটা দিন থাকতে পারলে ভালো লাগত। যখন গাড়ি ছাড়লো ঝলমলে রোদ।

আবার ছুটে চলা সেই একই পথ ধরে। এবার আমি চালকের পাশের সিটে বসলাম ইচ্ছা করে, যাতে আরো ভালো করে দুই চোখ ভরে সবুজ বনরাজি, সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাওয়া পথ দেখতে পাই। যেতে যেতে দু-একবার গাড়ি থামল। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ কিছু কিনে খেল। প্রায় ৪ ঘণ্টা পর আমরা খাগড়াছড়ি পর্যটনের মোটেলে পৌঁছলাম। পথিমধ্যে শুরু হয় অঝোর ধারায় বৃষ্টি। একেবারে যাচ্ছে তাই অবস্থা। এমন মুষলধারে বৃষ্টি থাকলে পরের দর্শনীয় স্থান দেখা সম্ভব হবে না ভাবতেই মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। উপায় নেই, প্রকৃতি বিরূপ। আমরা ফ্রেশ হয়ে ওখানেই দুপুরের খাবার খেলাম। দারুণ আয়োজন, খাবাবের রান্নাও ছিল সুস্বাদু। কিন্তু বৃষ্টি থামছে না। এরই মধ্যে গাইড বলল, যারা যারা যেতে চান তারা গাড়িতে বসেন, বাকিরা বিশ্রাম।

এত বৃষ্টি যে, সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমাদের সঙ্গীরা প্রায় সবাই বিশ্রামের জন্য দোতলায় চলে গেল। আমি হাল ছাড়িনি। চললাম সেই বৃষ্টির মধ্যে চাঁদের গাড়িতে আলুটিলা পাহাড় আর ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে।

বৃষ্টি মাথায় করে চাঁদের গাড়িতে উঠলাম। সঙ্গী খুব বেশি না। একটি পলকা ছাতা ভরসা করে চলছি। আমি আগের মতোই সামনের সিটে। রাস্তায় মনে হচ্ছে ঘনকুয়াশা, কিছু দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টি যেন ভীষণ রেগে আছে। আলুটিলা পাহাড়ে পৌঁছলাম কিন্তু প্রচন্ড বৃষ্টি। কারো কারো কাছে ছাতাও নেই। হেনা আপার বর সাখাওয়াত ভাই বললেন, ২৬৫টা সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে হবে। এই বৃষ্টিতে রিস্ক নিলাম না। আমরা কজন আর গেলাম না। পাশেই দেখলাম কয়েকটা দোকান। নেমে সেখানে গিয়ে দেখি, দুটো দোকানে ওখানকার তৈরি কিছু চাদর থ্রিপিস বিক্রি হচ্ছে। পাশে চায়ের দোকান, ডাবও বিক্রি করছে। আমরা ডাব খেলাম। কোথাও যাব আর কেনাকাটা হবে না সে কি হয়? হয়তো পরব-ই না, তবু কিনলাম চাদর, মাফলার। আমার দেখাদেখি অনেকেই তাদের ওয়াইফ, কারো মেয়ে বন্ধুর জন্য চাদর কিনল এবং পছন্দ করে দিতে হলো আমাকেই।

এর মধ্যে আলুটিলা পাহাড় দেখে ফিরে এলো অন্যরা, শুরু হলো আবার চলা, ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে। অল্প সময়ে চলে এলাম। এবার আমি না নেমে পারলাম না। দেখতেই হবে। সেই ছোট ছাতা মাথায় চলছি। এর মধ্যে দেখি ওই ভদ্রলোকের ছেলে ছাতা ছাড়া নেমে ভিজছে। বললাম, তুমি আমার ছাতার নিচে আস। আসলে ছাতাটা অত বৃষ্টির কাছে কিছু না। যা হোক, এভাবেই ভিজতে ভিজতে গেলাম। সত্যি না নামলে মিস করতাম। অসম্ভব সুন্দর ব্রিজ। দুই পাশে দড়ি দিয়ে বানানো রেলিং দেওয়া ঝুলন্ত কাঠের ব্রিজটি এত দিন ক্যালেন্ডারে দেখতাম। নিচে স্বচ্ছ জল। অসম্ভব সুন্দর এই কাঠের দোদুল্যমান ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে মনে হলো, কষ্ট স্বার্থক। বেশ সুন্দর maintenence. দুই পার বাঁধানো পরিষ্কার ঝকঝকে রাস্তা। আমরা ব্রিজ পার হয়ে ওপারে গেলাম। কেউ কেউ খুব দোল দিচ্ছিল ব্রিজের ওপর উঠে। ওপারে কফিশপ। বৃষ্টির জন্য কোথাও শান্তি পাচ্ছিলাম না। সবাই কাকভেজা। ভালো করে কিছু দেখাও হলো না। কোনোরকম ছবি তুলে এপারে এসে ঝালমুড়ি খেলাম। আমার বেশ প্রিয় খাবার। বাসায় যত মজা করে বানাই, ওদের মতো হয় না।

এত ঝামেলার পরও সময়টা ভালো কাটছিল। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই উপভোগ্য। আমরা ফিরে এলাম মোটেলে একটা দারুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে। বন্ধুরা তখন গান গল্পে মশগুল। সুখের সময় দ্রুত শেষ হয়। কখন সময় হলো যাওয়ার, টের পেলাম না। রাতে খেলাম পর্যটনের মোটেলে, বাবুর্চি ভালোই রাঁধে। শুরু হলো ঢাকার উদ্দেশে ফেরা। সেই কোলাহল মুখরিত শহরের উদ্দেশে যাত্রা।

সাজেক ভ্যালি পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। রাঙামাটির ছাদ বলা হয় এই জায়গাকে। এখানে খাসিয়া, পাংখুয়া ও ত্রিপুরা উপজাতি বাস করে। আমার কাছে বেশ সহজ সরল মনে হয়েছে ওখানকার মানুষদের। আর বন্ধুরা যারা যাবেন, ওখানকার সুস্বাদু কলা ও কমলা খেতে ভুলবেন না। সাজেক নদীটি দেখার ইচ্ছা থাকলেও হয়ে উঠেনি এবারের যাত্রায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close