মতিন বৈরাগী

  ৩১ জানুয়ারি, ২০২০

কবিতায় জেগে ওঠা নতুন চর

নদী দেখলেই তোমাকে মনে পড়ে/উজানের আছাড়িপিছাড়ি তমস্যায়/তুমি নদী হয়ে গ্যাছো.../ভালো নেই আমি, আমাদের লাল-নীল প্রজাপতিগুলো.../সবাই চলে গেলেও আমি জেগে থাকি একা/জেগে থাকি রাত জাগা পাখির মতো; বিমূর্ত বেদনায়...

এ রকম আরো অনেক পঙ্ক্তিতে বিবৃত হয়েছে কবি মৃধা আলাউদ্দিনের কবিতা- বলা যায় নতুন কাব্যের প্রয়াস। ‘উজানের’ অর্থাৎ বৈরিতার তিত-তিক্ততায় নদী যেমন মরে যায়, তার সচলতা শীর্ণ হয়ে পড়ে, তার উচ্ছলতা উধাও হয়ে এক নদী যেমন হারায় দিশা, তেমনি নানা প্রতিকূলতা জীবনকে করে সীমিত, অর্থহীন কঙ্কাল মানুষ, আশাহীন এক ভবিষ্যতের; অর্থ ও বোধহীন করে জীর্ণ নদীর মতো এক অচেনা অস্তিত্ব। মৃধা একই সঙ্গে প্রেম-ব্যথা, দ্রোহ ও রোমান্টিক ধারার কবি, তার কবিতায় অন্তর্গত এক প্রেমের বিবৃতিই বেশি মাত্রা আবেগায়িত হয়েছে কাব্যভাষার মোড়কে। সে কেবলই একটা গতানুগতিকতার মধ্যে সীমিত থাকেনি বরং অন্তর্মানসীর কষ্ট-দুঃখ-বেদনারাজি- সমাজের যে সামাজিক অসংগতিরই উপাদান থেকে সংক্রমিত এবং তা যে ভালোবাসাময় জীবনকে আর সহায়তা দেয় না অর্থাৎ স্বাভাবিকতার মধ্যে যে অস্তিত্বকে নির্মাণ করে না, কবির লেখায় মনোযোগ দিলে সেই সত্য দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।- ‘শুঁড়িখানার নরম দেহ, কাবাব ভুনা, আদিরসের নিষ্প্রয়োজন/কান্নাভেজা জীবনে আজ আমার দেখি সবার আগে বিষ প্রয়োজন।’

কাব্যভাষায় এই তরুণ কবি ধীরে ধীরে যে পারঙ্গম হয়ে উঠেছে তা তার কবিতাই বলে দেয়। মৃধার নির্মাণ করা উপমা, উৎপ্রেক্ষা এবং বৈপরীত্যও অনেকখানি স্বতন্ত্র করেছে আমাদের। ‘বেহায়া বাতাস উড়াচ্ছে চুল’, ‘জলের বিছানা’, ‘পাথর প্রেমিক’, ‘অমীমাংসিত কোনো সৌন্দর্য’ ও ‘সামনের শীতে মানুষ রৌদ্র হয়’ ইত্যাদি নির্মাণ তার কল্পনাশক্তিকে চিহ্নিত এবং শনাক্তযোগ্য করে।

মানুষের সব কাজ সামাজিক এবং যৌথ। স্বতন্ত্রতার মধ্যেই যৌথ জীবনের স্বাতন্ত্র্য। ব্যক্তি এবং ব্যষ্টির যেমন দূরত্ব রয়েছে, রয়েছে নৈকট্যও। সব সৃষ্টি স্বতন্ত্র ব্যক্তির কিন্তু সব সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা সমাজের। সৃষ্টিতে অভিজ্ঞতা লাগে, অভিজ্ঞতা পূর্বজ এবং সামাজিক। এরমধ্য দিয়েই পরিবর্তনগুলো ঘটে এবং প্রতিটা পরিবর্তনে নতুনদের ভূমিকা থাকে ছোট্ট, খুব সাধারণ কিন্তু এই সাধারণের মধ্য দিয়ে তরুণরা এমন কিছু উপাদানের সৃষ্টির করেন; যা পূর্বকে আরো নতুন করে এবং দিক পরিবর্তনের যাত্রায় যুক্ত করে। সন্ধান দেয় জমিন বা নতুন চরের।

‘সামনের শীতে মানুষ রৌদ্র হবে’ বইটির কবিতাগুলো পড়ে আমার মনে হলো- এই তরুণ আগামীতে তার প্রকাশে এমন কিছু সংযোজন করবেন, যা তাকে পরবর্তী সময়ের কবি বলে শনাক্তকরণে আর কোনো দ্বিধা থাকবে না। প্রস্তুতি পর্বে তার প্রকাশগুলো দিশাযুক্ত হয়ে বিষয় নির্বাচন ও রূপের সমন্বয়কে উজ্জ্বল করে তুলতে তেমনটা না পারলেও কবিতার গঠনশৈলীতে তার স্বাতন্ত্র্য আছে। আছে ভাষা প্রয়োগের দারুণ দক্ষতা।

‘এসো আমরা চলে যাই/জনান্তিকে, রাস্তায়,/টর্নেডো, টাইফুন ছেড়ে/জৌলুসপূর্ণ রৌদ্দুরে...।’ ‘তুমি তো আমার কাছে/আদি আয়নার মতো/সাত রং, ষড়ৈশ^র্য।’ এ রকম আরো অনেক নির্মিত পঙ্ক্তি তার কবিতাগুলোতে রয়েছে। মৃধা কবি এবং কবিতার প্রস্তুতি পর্বে তার আন্তরিকতা আমাকে এই প্রতীতি দেয়, সে আগামীর উত্থানপর্বে দক্ষতার স্পষ্টতা তৈরিতে পারঙ্গম হবেন। তার কবিতায় জেগে ওঠা নতুন চরের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। ...কবিতা মূলত বিষয় ও রূপের নির্মাণ, যার ভেতর বহুর উপস্থিতি কবিতাকে পাঠক গ্রাহ্য করে। মৃধার কবিতায় সমাজের রোগ-শোক, ভালোবাসা ও রঙের বিমূর্ততার অনুষঙ্গগুলো শনাক্ত করা যায়। কবি মৃধা আলাউদ্দিনের জন্য আমাদের শুভ কামনা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close