বিবিকা দেব

  ০৩ জানুয়ারি, ২০২০

গল্প

বিচার

রাত ১০টা বাজতে এখনো ১০ মিনিট বাকি। সালিসি বৈঠকে লোক সমাগম অন্যবার থেকে বেশি। কারণ, এ যাবত যত বৈঠক হয়েছে, এটা তার থেকে ভয়ানক। এ রকম ঘটনা এর আগে ঘটেনি। উৎসুক গ্রামবাসীর কৌতূহল। বিচারের রায় কী হবে? গ্রামের বৌ-ঝিদের পুকুরঘাটের আলোচনা থেকে শুরু হয়ে বাজারের নাপিতের দোকান পর্যন্ত রেশ রয়ে যায়।

গ্রামের একমাত্র স্বজ্ঞান ব্যক্তি মাস্টার সাহেব। বিজ্ঞ-অনবিজ্ঞ লোকের উপস্থিত তুলনামূলক। মাস্টার আসাতেই বিচারের মাঝখানে জায়গা করে দিল উৎসুকজনতা। যাতে মাস্টার সাহেব নির্বিঘেœ সভার মধ্যখানে চেয়ার নিয়ে বসতে পারেন। হালকা ফিসফিসানির গুঞ্জন শুরু হলো। গ্রামের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসহাক হাত উঁচিয়ে বললেন থামেন মিয়ারা।

ইসহাক চেয়ারম্যান : আজকে কি বিষয় নিয়ে বিচারকার্য শুরু হবে নিশ্চয় আপনারা অবগত হয়েছেন।

দেলোয়ার হোসেন : (গ্রামের কুচুটে স্বভাবের লোক) চেয়ারম্যান হচ্ছে আমাদের সবার মাথা। উনি যা ভালো মনে করেন, তা ঠিক হবে কি না বলুন।

বাকিরা মাথা নিচু করে কথায় সাই দিয়ে হুঁ বলল।

দেলোয়ার হোসেন : আসামি কোথায়? তাকে নিয়ে আসো বিচারের মধ্যখানে।

চেয়ারম্যান : কী মাস্টার সাহেব কিছু বলেন। আপনি বলবেন নাকি আমি শুরু করব?

সুলতান মাস্টার : হ্যাঁ। আপনি শুরু করতে পারেন।

আসামি কোনো ছেলে নয়। সাধারণ একটি মেয়ে। মেয়ের বিচার হবে জেনে মানুষের ভিড় বেশি। আসলে আমরা যে সমাজে বাস করি, তা মূলত পুরুষ পরিচালিত। যতই মুখে প্রচার করে ছেলে-মেয়ের সমান অধিকার, কিন্তু বাস্তবে মিল নেই! বিশেষ করে গ্রামে। সমাজে মেয়েদের সামান্য দোষ থাকলে তা বড় পর্যায়ে নিয়ে যায়। গলা উঁচিয়ে দু-চারটে কটুকথা শোনাতে দ্বিধা করে না। যদিও ছেলের মুখ্য ভূমিকা থেকে থাকে। তবু সব কিছু নিয়ে মেয়ের ওপর বর্তায়।

আসামি হলো সালমা জাহান নিভু। মা-বাবার একমাত্র আদুরে মেয়ে। বিবাহিত জীবনে ২২ বছর পর ছোট্ট তুলতুলে নিভুর আগমন। মেয়েকে পেয়ে সাইফুল আলম মিলনের খুশির উপচে পড়া আনন্দ জোয়ার বইছে। স্ত্রী ইসমত জাহানের একই অবস্থা। সাইফুল পণ্য আমদানি-রফতানি সরকারি জাহাজের সারেং। শক্ত সামর্থ্যরে অধিকারী। ফর্সা ত্বক। তারুণ্য ধরে রাখার মতো যুবক। বিবাহিত জীবনে কোনো সন্তান না আসাতে, কোনো দিন স্ত্রীর মনে দুঃখ দেয়নি। বরং ওপরে যিনি বসে সব কিছু দেখেন, তার ওপর ভরসা করতে বলেন।

ইসমত কেঁদে কেঁদে চোখের নিচে কালির বসবাস করেছে! কখনো নিরাশ হয়নি। আশায় বুক বেঁধে সংসার সামলে নিয়েছে। ভরা সংসারে যখন নতুন বউ হয়ে এসেছে ইসমত, তখন অনেকজনে অনেক কথা বলেছেÑ গায়ের রং কালো ও বেশ লম্বা হওয়াতে। সন্তান না জন্মানোতে আরো কটুকথা শুনতে হয়েছে! সেই কষ্টের সন্তানের কারণে বাবাকে অপমান সহ্য করতে হচ্ছে!

ইসমত যদি বেঁচে থাকত, হয়তো এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে দিত না। স্ত্রীর মৃত্যুর তিন মাস পর এমন একখানা কান্ড! সাইফুল কখনো ভাবতে পারে নাই। দুচোখের কূপ থেকে জল গড়িয়ে পড়েছে। মাথা নুয়ে যেন মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চায়!

২.

চেয়ারম্যান : আমি যা জিজ্ঞেস করব, সব ঠিকঠাক উত্তর দেবে। তোমার সঙ্গে সরোয়ার সুমনের সম্পর্ক আছে? তা কী ধরনের সর্ম্পক? তার একটা কথা গ্রামের সবার মুখে মুখে। এমনকি সেই কথা বাতাসে উড়ে। সেই কথাটা সত্যি কতটুকু?

সালমা : আপনারা কী শুনেছেন, আমি জানি না। আপনি যা জিজ্ঞেস করেছেন, আমি শুধু তা বলব। আমার সঙ্গে সরোয়ারের মন দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক তো আছে। হ্যাঁ, কথাটা সত্য। তাছাড়া সরোয়ারকে আমি ভালোবাসি। সেই সঙ্গে আমি তিন মাসের গর্ভবতী। এই সন্তানের জনক সুমন।

উপস্থিত গ্রামবাসী তাজ্জব হয়ে গেল, নিভুর কথা শুনে। সবাই একজনের মুখ আরেকজনে চাওয়া-চাওয়ি করছে। কথাটা ঠিক! নাকি ভুল শুনল। এর মধ্যে কুজোবুড়ি রহিমের মা বলে উঠল, তোমাকে তো মাইয়া আমরা ভালো মনে করতাম। আর তুমি কি না ওই বাদ্দাইমা ছেলের লগে এই কুকর্ম করেছ। ছিঃ ছিঃ, তোমার লজ্জা শরম বলতে কিছুই নাই! এমন মেয়েকে কাইট্টা গাঙে ভাসাইয়া দেওয়া দরকার!

চেয়ারম্যান : এই মেয়েটার দুঃসাহস দেখে আমি অবাক। এই রকম ঘটনা আজ পর্যন্ত দেখিনি। আজ নিজের চোখে দেখছি ও শুনেছি। মাস্টার সাহেব কি বলেন? মেয়েটার কথা শুনছেন? এখন বিচারের রায় কী হবে আপনি বলেন?

মাস্টার : কী বলারবা আছে। যদি কিছু মনে না করেন। আমি একটা কথা বলতে চাই। কথাটা হচ্ছে, মেয়ে এবং মেয়ের বাবাকে এক সপ্তাহ সময় দেন।

চেয়ারম্যান : না মাস্টার সাহেব। এক সপ্তাহ হলে বেশি দেরি হয়ে যায়। কালকে সরোয়ার আর সালমাকে নিয়ে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে! নইলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে।

দেলোয়ার হোসেন : মাস্টার সাহেব জ্ঞানী মানুষ। আমার মনে হয় চেয়ারম্যান সাহেব মাস্টার যেই কথাটি বলেছেন। সেটা ভেবে দেখেন। যদি সময় দেন তাহলে ভালো হতো।

চেয়ারম্যান : এত ভাবার কোনো কারণ নেই। যেটা একবার সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটা নড়চড় হবে না। এটাই বহাল থাকল। কালকের মধ্যে দুজনেই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে।

উপস্থিত সবাই চেয়ারম্যানের বিচারের রায়কে সঠিক বলে মনে করে। তাই হুঁ হুঁ বলে সম্মতি দিল।

বেশ রাত অবধি বিচারকার্য শেষ হয়। যে যার মতো বাড়িতে ফিরে গেছে। স্থির দৃষ্টি। নির্বাক শুধু সাইফুল। হাঁটতে গিয়ে পা টলছে। বিচার সভার সব কথা বারবার ঘুরে-ফিরে আসে কানের কাছে। ওপর দিকে দুহাত তুলে বলে, আমার মরণ হয় না কেন! হে খোদা তুমি এক্ষুনি আমার মরণ দাও! আমি আর বাঁচতে চাই না। এই মুখ নিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচব কীভাবে! তোমরা আমার জন্য দোয়া করো, যাতে আমার মৃত্যু হয়!

বাকি রাতটুকু অনড় হয়ে আসে। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। ভোরের আলো ফোটার আগে মাঠ পেরিয়ে নদীর পাড়ে গিয়ে বসে আছে। সম্মোহনী দৃষ্টিতে নদীর জলের গভীরে পরিমাপ করেছে। ঘটে যাওয়া কোনো কিছু ভুলতে পারতেছে না। ভাবতে ভাবতে নিজের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনার অন্ত্যমিল খুঁজে পাচ্ছে না। সব কিছু উবে নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে থাকিয়ে আছে। নিজেকে জিজ্ঞেসুর ভঙ্গিতে বলল, আমি কেন কষ্ট পাচ্ছি। সালমা যদি ওই ছেলেকে পেয়ে সুখী হয়, তবে তাই হোক। সালমা সুখে থাকলে আমার কষ্ট হবে না। যাই বাড়িতে অনেক কাজ পড়ে আছে।

পরদিন সকালবেলা সাইফুল মেয়ে সালমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সরোয়ার আগেই বলে রেখেছে। কোথায় দেখা করতে হবে। বিকালে তিনজনই এক সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসে। তবে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ের কাজ আগে সেরে ফেলে। আশপাশের মানুষের গুঞ্জন শোনা যায়। তার দুই দিন পর আবার চেয়ারম্যানসহ বিচার সভা বসে।

চেয়ারম্যান : সাইফুল। কী বলেছিলাম গত বিচার সভায়। নাকি আমার কথা কান দিয়ে প্রবেশ করে নাই।

৩.

সাইফুল : জি। শুনেছি আপনার কথা। কিন্তু মেয়ে আমার যাবে কোথায়?

চেয়ারম্যান : কোথায় যাবে মানে! আকাম-কুকাম করার সময় মনে ছিল না। তোমরা যখন এই গ্রাম থেকে চলে যাও নাই, তাহলে কাল থেকে তোমাকে সমাজচ্যুত করলাম। তার মানে সমাজের কোনো কাজে অথবা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারবে না! তুমি ও তোমার বেহায়া মেয়ে আর জামাইয়ের পরিবারসহ একঘরে থাকবে!

দেলোয়ার হোসেন : চেয়ারম্যান সাহেব, আপনি হলেন গিয়ে গ্রামের সকলের মাথা। এত রাগ করলে কি চলে। বিষয়টা আর একবার ভেবে দেখলে ভালো হয়।

চেয়ারম্যান : না, আমার সিদ্ধান্তের নড়চড় হবে না। ১২ বছর পর্যন্ত ওরা দুই পরিবার সমাজ থেকে আলাদা থাকবে। আর যদি কোনো ব্যক্তিকে ওদের সঙ্গে মেলামেশা করতে দেখি বা শুনি, তাহলে ওই ব্যক্তি বিরুদ্ধে একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সালমা : বাবার মুখে ও চেয়ারম্যানের বলা কথা শুনে বলে, দেখি কোন বাপের বেটার সাধ্য আছে। আমাকে গ্রাম থেকে বের করে দেবে। বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে কোথাও যাব না!

রঙিন সুখে দুঃখে সালমার সংসার জীবন অতিবাহিত হচ্ছে। এদিকে, আশপাশের মানুষের গুঞ্জন এখনো অপয়া মেয়ে-ছেলেটা গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে না। মেয়ের জামাইকে দুই লাখ টাকা দিয়ে অটো সিএনজি কিনে দেয়। বেকার ছেলেকে মেয়ে পছন্দ করে বিয়া করেছে। ড্রাইভার হিসেবে ভাড়া খাটবে।

হঠাৎ বিপত্তি ঘটল! বাবার সঙ্গে আসা বয়স্ক মহিলাকে নিয়ে। সালমা রাগে ক্ষোভে চোখ কপালে ওঠে।

সালমা : কে এই মহিলা?

সাইফুল : ইনি তোমার নতুন মা। আজ থেকে তুমি ওকে মা বলে ডাকবে। শরিয়ত মোতাবেক আমি বিয়ে করেছি।

সালমা : মা! কে মা? আমার তো মা মরে গেছে। আমি কখনো ওনাকে মা বলে ডাকতে পারব না। মা মরে যাওয়ার চার মাসের মধ্যে তুমি বিয়ে করে এনেছো।

সাইফুল : সালমা রাগ করো আর যাই করো না কেন, সব কিন্তু তোমার জন্য হয়েছে। তুমি যদি গ্রামের সামান্য বেকার ছেলেকে নিয়ে এসব কাজ না করতে, তাহলে আমি বাকি জীবনটা তোমাকে নিয়ে সুখে দুঃখে কাটিয়ে দিতাম। তুমি তো আমার কথা ভাবলে না। তাই আমি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। আর একটা কথা না বলে পারছি না! তোমার তো এখন বিয়ে হয়েছে, চাইলে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে থাকতে পারো। এমনিতে তুমি মান সম্মান সব শেষ করেছো। তোমার জন্য আজ সমাজচ্যুত হতে হয়েছে।

সালমা অজোরে কাঁদতে থাকে। কখনো মায়ের বিলাপ করে। সান্ত¦না দেওয়ার কেউ নেই। ওইদিন সালমা শ্বশুরবাড়িতে ফিরে আসে। দিন দিন পেটটা ফুলে উঠতেছে। নড়াচড়া করে ছোট্ট পা দিয়ে লাথি মারে। স্পন্দন বাড়ছে।

কিছুদিন পর সরোয়ারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল রূপটা বেরিয়ে আসে! ইদানীং গায়ে হাত তোলে আর যখন-তখন অকথ্য ভাষায় গালি দেয়।

সরোয়ার : ভেবেছিলাম বিয়ে করে রাজ্য পাব। সঙ্গে রাজকন্যা। দেখি সবই মেকি ন্যাকামি। রাগে হিসহিস করতে থাকে।

অজানা শষ্কায় গুটিয়ে যায় সালমা। রাত-দিন ফুরোতেই চায় না। এখনো অনেক সময় বাকি আছে। কীভাবে কাটবে জানি না। এখন আমি কী করব। কয়েক মুহূর্তের ভালো লাগা এখন বিষে পরিণত হয়েছে। নতুন একটা ভোরের অপেক্ষাই আছি। ভোরের আলোটা হামাগুড়ি দিতে দিতে এগিয়ে আসবে। কচিমুখ ও হাতের আশায় আছি। তলপেট ভীষণ ব্যথা। কঠিন যন্ত্রণা অনুভবে কচি ঠোঁটের উষ্ণতা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close