আহমেদ তানভীর

  ০৩ জানুয়ারি, ২০২০

বাংলা লোকগানের অদেখা জানালা

সহজ-সরল ভাষায় অথচ লোকদর্শনঋদ্ধ গীতিকাব্য লিখে বাঙালি লোকজীবনের স্বরূপ রচনার সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন কবি জসীম উদ্দীন। অথচ ‘পল্লীকবি’ অভিধায় অভিহিত হওয়ার কারণে বা অন্য যেকোনো অজ্ঞাত কারণে জসীম উদ্দীনের বিশাল রচনাসম্ভারের অনেকাংশ বিশেষত তার গান বা গীতিকবিতা রয়ে গেছে হালের সাহিত্যমোদীদের অগোচরেই। ভিন্ন আঙ্গিকে বলতে গেলে, এমন অনেক জনপ্রিয় লোকগান মানুষের কণ্ঠে-কানে-মনে ছড়িয়ে রয়েছে যুগ যুগ ধরে; কবি জসীম উদ্দীন যে এসব গানের রচয়িতাÑ এ তথ্যটিইবা জানে কজন? কবি, প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক, কথাসাহিত্যিক প্রভৃতি পরিচয়কে অতিক্রম করে ‘গীতিকার’ পরিচয়টি জসীম উদ্দীনের বেলায় কেন অতটা প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারেনি, তা অবশ্যই ভাবনার দাবি রাখে।

লোকজীবনের রূপায়ণ ও লোকদর্শনের প্রকাশ জসীম উদ্দীনের গানের প্রধানতম উপজীব্য। বাংলা লোকগানে পুরোধা ব্যক্তিত্ব যাদের মনে করা হয়Ñ সেই লালন, হাছন, রাধারমণ, উকিল মুন্সী, জালাল খাঁ কিংবা আবদুল করিমের গান যতখানি জীবনঘনিষ্ঠ, প্রকৃতিঘেঁষা আর মরমিয়া কথামালায় সমৃদ্ধ, জসীম উদ্দীনের গীতিকবিতা উপাদান, চিত্রময়তা বা বৈশিষ্ট্যে সেসবের চেয়ে কোনোভাবে পিছিয়েÑ এ কথা বলার ন্যূনতম অবকাশ নেই। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, গানপ্রেম কিংবা গানচর্চায় লালনের গানের ভক্ত ছিলেন জসীম উদ্দীন। লালনকে আর লালনের দর্শনকে অনুভব করেছেন আত্মার গভীর থেকে। এ কারণেই তার গানে লালনের পরোক্ষ প্রভাব লক্ষণীয়। এমনকি জসীম উদ্দীনের স্মৃতিকথায় ব্যক্তি লালনকেও গুরুত্ব পেতে দেখা যায়। এ ছাড়া ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত লোকসাহিত্য সংগ্রাহক হিসেবেও জসীম উদ্দীন কাজ করেছেন ড. দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে। সে সুবাধে তিনি পূর্ববঙ্গ গীতিকার একজন সংগ্রাহকও বটে। তার সংগৃহীত ১০ সহস্রাধিক লোকসংগীতের আংশিক তার সম্পাদিত সংগীত সংকলন ‘জারি গান’ (১৯৬৮) এবং ‘মুর্শিদী গান’ (১৯৭৭)-এ স্থান পেয়েছে। এসব শেকড়সন্ধানী কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততা জসীম উদ্দীনের লোকগান রচনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

সরল-সহজ ভাষায় রচিত গানের ভাঁজে কবি নিখুঁতভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন জীবনবোধের গভীরতম অনুভব, দর্শন আর আধ্যাত্মিকতা। উদাহরণস্বরূপ কবির গানের ‘আরে সাবধানে চালাইও মাঝি আমার ভাঙা তরী রে, অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে’ এই অংশে বিবৃত ‘তরী’ এবং ‘দরিয়া’কে নানাজন নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, নানামুখী অর্থ দাঁড় করিয়েছেন। কেউ কেউ এর সঙ্গে রবি ঠাকুরের ‘সোনার তরী’-এর সাযুজ্য খোঁজার প্রয়াস পেয়েছেন। আবার কেউ ভিন্ন দর্শনের সন্ধান করেছেন আপন চিন্তার ভিত্তিতে। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সাধারণ কথামালায় এরূপ অসাধারণ গুরুবাক্যের জুড়ি মেলা ভার।

শুধু নিগূঢ় আধ্যাত্মবাদ আর গুরুগম্ভীর দর্শনে মোড়ানো মরমিয়া গান রচনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না জসীম উদ্দীনের লেখনী। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য, বাংলাদেশের মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ও যাপিত জীবন তার গানে উপস্থাপিত হয়েছে নতুন আঙ্গিকে, নতুন মাত্রায়। এ কারণেই তার গানে উঠে এসেছে এ রকম সহজিয়া ভাষার গীতিকাব্য : ‘দেহ দিছি প্রাণ রে দিছি/আর নাই কিছু বাকি/শত ফুলের বাসন দিয়া রে/অঙ্গে দিছি মাখি রে/আমার সোনার ময়না পাখি।’

পরক্ষণেই শোনা যায় ছেড়ে চলে যেতে থাকা প্রিয়জনের জন্যে বাঙালি জীবনের চিরায়ত আকুতি : ‘যাইবা যদি নিঠুর পাখি/ভাসাইয়া মোর আঁখি/এ জীবন যাবার কালে রে/ও পাখি রে/একবার যেন দেখি রে/আমার সোনার ময়না পাখি।’

এ রকম অসংখ্য গানে মাটি-মানুষ আর প্রকৃতির কথা বিবৃত করেছেন জসীম উদ্দীন। তার রচিত শ্রোতাপ্রিয় উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছেÑ ‘আমার সোনার ময়না পাখি...’, ‘আমার গলার হার খুলে নে, ওগো ললিতে...’, ‘আমার হাড় কালা করলাম রে, ওরে আমার দেহ কালার লাইগা রে...’, ‘আমায় ভাসাইলি রে, আমায় ডুবাইলি রে...’, ‘আমায় এত রাতে কেনে ডাক দিলি, প্রাণ কোকিলা রে...’, ‘কেমন তোমার মাতা-পিতা, কেমন তাদের হিয়া...’, ‘নদীর কূল নাই কিনার নাই...’, ‘ও বন্ধু রঙিলা...’, ‘রঙিলা নায়ের মাঝি...’, ‘নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভোমরা...’, ‘প্রাণ সখি রে ঐ শোন্ কদম্ব তলে বংশী বাজায় কে...’, ‘ও আমার দরদি, আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না...’, ‘ও আমার গহিন গাঙের নাইয়া...’ প্রভৃতি।

গীতপ্রেমী কবি জসীম উদ্দীন কতটা গানপাগল ছিলেন, গানের গভীরতা কতখানি ধারণ করতেন নিজের হৃদয়বন্দরে তার দেখা মেলে ব্যক্তি জসীম উদ্দীনের জীবনেও। প্রসঙ্গত একটি ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। জসীম উদ্দীনের এক ভক্ত ছিলেন হাজেরা বিবি। তিনি স্বামীকে নিয়ে গানবাজনা করতেন, সাধনা করতেন মরমী দর্শনের। গান গাওয়ার অপরাধে হাজেরা বিবি আর তার স্বামীকে একবার গ্রামবাসীরা একঘরে করে রেখেছিল। কোনো উপায়ন্তর না দেখে তারা শরণাপন্ন হন জসীম উদ্দীনের। কবির সঙ্গে দেখা করে তারা ‘ছোট গাঙের ওপাড়ে হিন্দুপাড়ার কাছে একখানা কুঁড়েঘর তুলিয়া এই গ্রাম হইতে চলিয়া’ যাবেন বলে কবিকে অবহিত করেন এবং গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার অনুমতি চান। সব জানতে পেরে মনে খুব কষ্ট পান কবি। অবশেষে তাদের সান্ত¦না দেন। কবি বলেন, ‘আজ যদি তোমরা আমাদের এই গ্রামকে ছাড়িয়া যাও, তবে এই অন্যায়কে স্বীকার করিয়া লওয়া হইবে। হাজেরা! তুমিই ত গানে বল, রসুলুল্লাহকে লোকে প্রথম একঘরে করিয়াছিল। লালন ফকির, সাল্লাল ফকির, এরাও সমাজের হাতে বহু লাঞ্ছনা পাইয়াছেন। হাজেরা, তুমিই ত গানে বল, ‘লোকের মন্দ, পুষ্পচন্দ অলংকার পইরাছি গায়।’ আজ লোকের মন্দ পুষ্পচন্দনের মতো তোমাদের গায় অলংকার হইয়া থাক।’

গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী অনেক গান রচিত হয়েছে জসীম উদ্দীনের লেখনীতেÑ এ কথা যেমন সত্য; ঠিক তেমনই তিনি রচনা করেছেন ভাটিয়ালি গান, আধুনিক গান, দেশপ্রেমমূলক গান, এমনকি ইসলামি সংগীতও। তার অধিকাংশ অবিস্মরণীয় লোকগীতি রচনায় বিশেষ করে ভাটিয়ালি ধারার গান রচনায় বেশ সহযোগিতা করেছেন বাংলার কিংবদন্তিতুল্য লোকসংগীতশিল্পী আব্বাস উদ্দীন। বেতারের জন্য রচিত জসীম উদ্দীনের আধুনিক গানের কথা যেমন নানা সূত্র থেকে জানা যায়, ঠিক তেমনই ইসলামি ভাবধারার গান রচনার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে ছিলেন না। কবি গোলাম মোস্তফা তার প্রতিবেশী হওয়ার সুবাধে তিনি ইসলামি ভাবধারার গান রচনায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেশ কিছু দেশাত্মবোধক গানও লিখেছেন জসীম উদ্দীন।

সর্বোপরি জসীম উদ্দীনের ‘কবি’ (বা পল্লীকবি) পরিচয়ের পাশে ‘গীতিকার’ পরিচয়টি কী কারণে সমান্তরাল হয়ে উঠতে পারেনি, তা ভেবে দেখার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় বয়ে গেছে। বর্তমান প্রজন্মকে তার গানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা সময়ের দাবি। অথচ গুটিকয়েক শ্রোতাপ্রিয় কিংবা জনপ্রিয় গানের বাইরে পূর্ণাঙ্গ কোনো গান-সংকলন নেই, যা স্বতন্ত্রভাবে ‘গীতিকার’ জসীম উদ্দীনকে প্রতিভাত করতে পারে স্বমহিমায়। ‘পল্লীগীতি’ বলে গানের ধরন রয়েছে অথচ ‘পল্লীকবি’র লেখা গানের পূর্ণাঙ্গ সংগ্রহ সহজলভ্য নয়, এ এক নিদারুণ দৈন্য আমাদের। বাংলার জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা প্রজন্মকে মাটি-মানুষের আবহমান জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করাবার প্রয়োজনেই জসীম উদ্দীনের গানের মূল পা-ুলিপি সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও চর্চা একান্তভাবে প্রয়োজন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close