তাহমিনা মনসুর

  ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯

অরূপ তালুকদারের কবিতা

শাশ্বত শব্দের সরল ব্যঞ্জনা

কথাসাহিত্যিক অরূপ তালুকদার, কবিতাতেও সিদ্ধহস্ত। প্রকাশিত হয়েছে কাব্যগ্রন্থÑ সেই নির্বাসন চাই (১৯৭৪), দূরের হরিণী (১৯৮২), অন্ধকারে আলোর ম্যাজিক (১৯৮৬)। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বাছাই কবিতার সংকলন ‘নির্বাচিত কবিতা’। গ্লোব লাইব্রেরি (প্রা.) লিমিটেড থেকে প্রকাশিত এই নির্বাচিত কাব্য সমগ্রটিতে রয়েছে চৌষট্টিটি কবিতা। যদিও ‘বেশ কিছু পছন্দের বা ভালো লাগার কবিতা নির্বাচনের বাইরে রাখতে হয়েছে অনেকটা দোদুল্যমান মানসিকতা এবং সময়াভাবের কারণে। এই ত্রুটি আমার।’ এটি কবির সরল স্বীকারোক্তি। তবে বয়সের ভারে ন্যুব্জ-নত নয়, বরং ধাবমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিরন্তর ছুটে চলেছেন কবি। জীবনের দেখা না দেখার অনেক জটিল সমীকরণকে লিপিবদ্ধ করছেন নানা মাত্রিকতায় কী গল্পে, কী উপন্যাসে, কী কবিতায়; তবে শব্দের সরল ব্যঞ্জনা অরূপ তালুকদারের কবিতা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই শব্দসৈনিক

নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী কালকে; যা তিনি অবলীলায় ধারণ করেছেন তার কবিতায়। ফলে দেশাত্মবোধ হয়ে উঠেছে তার কবিতার মৌল প্রেরণা। তাই নিজ বাসভূমি, স্বজনদের মধ্যে ফিরে আসার আকুতি তার প্রবল। অনিশ্চিত যাত্রায় কিছুতেই ভাবতে পারেন না কবিÑ ‘আবার কোনোদিন ফিরে আসবো, ভাবিনি।/ভাবিনি, আবার কোনোদিন দেখা হবে/আপনাদের সঙ্গে, আমার যারা প্রিয়জন/একান্ত আপন বন্ধুবান্ধব তাদেরকে/কোনোদিন দেখবো, দেখতে পাবো আমার/সেই প্রিয়তমার মুখ মøান নক্ষত্রবীথিতলে...।’ (যুদ্ধোত্তর প্রত্যাবর্তন/নির্বাচিত কবিতা)

মুক্তিযুদ্ধ অরূপ তালুকদারের কবিতার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। তার কবিতার ব্যাপক আয়তনজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের বিস্তার। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ বিক্ষত সময় তার কবিতায় বিধৃত হয়েছেÑ ‘স্বাধীনতা আমার জীবন, আমার রক্ত, রক্তবীজের ঋণ/স্বাধীনতা আমার চিরদুঃখিনী মায়ের দুফোঁটা অশ্রুজল/স্বাধীনতা আমার প্রিয়তমার মুখ, দোয়েল পাখির গান/স্বাধীনতা আমার স্বপ্নের ধন, এই দীপ্ত প্রাণের ফসল।’ (স্বাধীনতা/নির্বাচিত কবিতা)। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তার কবিতার হৃৎস্পন্দন ও ধ্বনিত হয় উজ্জ্বল মহিমায়Ñ ‘তুমি নেই, হে অমৃতের পুত্র, আমাদের মধ্য থেকে/অকস্মাৎ একদিন তুমি চলে গেলে, যেন/এক ঝংকৃত দুর্বার ঝড়ের মতো তোমার/তোমার সেই আসা আর যাওয়া।’ (তুমি নেই, কাঁদে বাংলার মানুষ/নির্বাচিত কবিতা)

অরূপ তালুকদার তার কবিতায় ব্যক্তিগত প্রেমাবেগ, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, আশা ও হতাশা, স্মৃতিকাতরতা, সুখ-দুঃখ ও বেদনাকে যেমন উপস্থাপন করেছেন। তেমনি ক্রান্তিকালীন নিষ্ফলা সময়, পতনোন্মুখ সভ্যতা, মানবতার লাঞ্ছনা ও রাজনীতির চালচিত্রকে শিল্পিত বাগ্বিন্যাসে প্রতিভাসিত করেন। কবির অনুভবÑ ‘যদিও যেতে চাই অনির্বাণ আগুনের দিকে নিমেষেই/পেছন থেকে কে বুঝি ডেকে বলে ওঠে, ওদিকে নয়। বোধের/উৎস থেকে নিশিদিন এই ঘাতক যৌবন ফিরে আসে/সেই অবাক চৌকাঠে। আসলে কোথাও আছে কি কিছু?’ (এই ঘাতক যৌবন/ নির্বাচিত কবিতা)।

আবহমান বাংলা কবিতার প্রধান প্রবাহ রোমান্টিকতা। রোমান্টিক চেতনার স্পর্শে অরূপ তালুকদারের কবিসত্তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেয়। তার সব কবিতাজুড়েই এই কবিচারিত্র প্রাধান্য বিস্তার করেছে। তার কাব্যভাষার চিত্রলতা ও গীতিময়তা এক মোহনায় মিলনাভিসারী। কবি যখন বলেন, ‘তুই যদি ফিরে আসিস দুচোখে যদি ধরে রাখিস/অনন্ত পিপাসা/যৌবনের/যদি দিতে পারিস অঞ্জলিভরে/রক্তিম ফুলরাশি/ভালোবাসার/এবং/এই অনিদ্র রাত যদি রাখিস ধরে/আজীবন তুই ঐ তোর/দীপ্ত দেহের আধারে/তবে/মুহূর্তেই বদলে যাবো/এই আমি ত্রিশঙ্কু আঁধারে হবো প্রজ্ব¡লিত...।’ (ব্যূহত্রাণ/নির্বাচিত কবিতা)

বিষয়বস্তু আহরণে কবি অরূপ তালুকদার বৈচিত্র্য সন্ধানী হলেও দূরবিহারী নন; পরিপার্শ্ব থেকেই গ্রহণ করেন যাবতীয় মালমসলা। প্রেম প্রকৃতি নারী স্বদেশ সমাজ রাজনীতি পরিবেশ প্রতিবেশ সভ্যতা সময় ও সমকাল আদ্যোপান্ত তার কবিতার উপজীব্য। সৃষ্টিশীল সত্তার শেকড় দেশ-কাল-মৃত্তিকায় প্রোথিত। তার কাব্যভাষা সম্পূর্ণ আধুনিক। ছন্দের ক্ষেত্রে অক্ষরবৃত্তই তার প্রধান অবলম্বন। শব্দের স্বাচ্ছন্দ্য, ধ্বনির দ্যোতনা ও পঙ্্ক্তির বিন্যাসে তিনি নান্দনিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে তৎপর। উপমা উৎপ্রেক্ষা রূপক প্রতীক সংকেত চিত্রকল্প-নির্মাণ ও পুরাণের যথাপ্রয়োগে সিদ্ধহস্ত। আবেগ ও মননের রসায়নে তার কবিতা পাঠক হৃদয়ে সঞ্চারিত করে গভীর সংবেদনা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close