দীপংকর দীপক

  ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯

মোস্তফা কামালের ‘আমি কবি’ উপন্যাস

কবির বিরহ, কবির বেদনা

বাইরের জগতের রূপ-রস-গন্ধ, আনন্দ-বেদনা-স্পর্শানুভূতি লেখক যখন আপন কল্পনালোকে স্থাপন করে শব্দাক্ষরের ছন্দোবদ্ধ তনুশ্রী দান করেন, তখন তিনি পরিপূর্ণ কবি হয়ে উঠেন। কবির আনন্দঘন কিংবা বেদনাবিধুর হƒদয়ই কবিতার জš§ভূমি। কবি সর্বদা ধ্যানস্থ থেকে কল্পনালোকে বিরাজ করেন। এ কারণেই কবিরা চিরদিন উদাসীন হন।

আবীর হাসানও আপদমস্তক কবি। দিন-রাত কবিতা লেখায় মশগুল থাকেন। কবিতার মাধ্যমে উšে§াচন করেন জীবনরহস্য। শব্দসম্ভারের মাধ্যমে প্রেমময়ী নারীর দেহসৌষ্ঠব নিখুঁতভাবে অঙ্কন করেন। তাদের মনের অন্তরালের কথা ছন্দ-মাধুর্যতায় প্রকাশ করেন জাদুকরী মহিমায়। এ কারণেই আবীরের কবিতার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পান ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে অনামিকা আহমদ অনু। তার কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তির মধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পান অনু। একপর্যায়ে আবীরের কবিতার একনিষ্ঠ ভক্ত বনে যান।

সময়ের পরিক্রমায় আবীরকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে ফেলে অনু। কবিরা যেমন প্রেমিক স্বভাবের, তেমনই মানবিক গুণসম্পন্ন। তাই অনুর ভালোবাসাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি আবীর। তার অন্তরের অভিপ্রায়কে সম্মান করতে গিয়ে জাগতিক প্রেমের বেড়াজালে আবদ্ধ হয় আবীর। একপর্যায়ে অনুকে বিয়ে করে পুরোপুরি সংসারী হতে হয় তাকে।

আবীর-অনুর সংসারজীবন প্রথম দিকে ঠিকমতো চলছিল। আবীর ভালো চাকরি নিয়ে সংসারটা অল্প সময়ের মধ্যেই গুছিয়ে নিয়েছিল। স্ত্রীর ভালোবাসা ও কবিতার খ্যাতি তাকে নতুন জীবন দান করেছিল। কিন্তু কথায় আছে, নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি ঈর্ষাপরায়ণ। এই ঈর্ষাই আবীর-অনুর দাম্পত্য জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। আবীরের কবিতার আবেদন অন্য নারীদের হƒদয়ে দোলা দিচ্ছেÑ এ বিষয়টি অনু বুঝতে পারে। এরপরই অনুর মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আবীরের কবিতাকে অনু এড়িয়ে চলতে থাকে। তার লেখালেখিতে নানাভাবে বিঘœ সৃষ্টি করে। তাকে মানসিকভাবে চাপে রাখে। অনুর এ পরিবর্তনে আবীর অবাক হয়। অনুকে বারবার বোঝাতে চেষ্টা করেÑ তার সন্দেহ সঠিক নয়, তা মনগড়া মাত্র। কিন্তু বোঝাতে ব্যর্থ হয়। অনুর ঈর্ষার আগুনে ঝলসে যায় আবীরের সৃজনশীল জীবন। তার পরও আবীর সংসার টিকিয়ে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। কিন্তু অনুর সন্দেহপ্রবণতা ও অবিশ্বাসের বিষবাষ্প সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। একদিন অনু সিদ্ধান্ত নেয়, চিরদিনের জন্য তার বাবা-মায়ের কাছে চলে যাবে। সেদিন আবীর আর তাকে আটকাতে পারেনি।

এমনই করুণ কাহিনি নিয়ে ‘আমি কবি’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট গড়ে উঠেছে। এ উপন্যাসে একজন কবির বাস্তবিক চিত্রপট সুনিপুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে অনুর মা অহনা আহমেদের উক্তির মধ্যে তা আরো সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, ‘কবিরা মানুষ, তবে ভাবুক মানুষ। ওরা খুব একটি সংসারী হয় না। আদাড়ে-বাদাড়ে ঘোরে। কাজকাম কিছু করে না। বউয়ের ঘাড়ে চেপে বসে।’

সৃজনশীলতা সংসার জীবনকে ততটা সমর্থন করে নাÑ এটাই ধ্রুব সত্য। আবীরের অফিসের বস রাশেদ মহিউদ্দিনের উক্তির মাধ্যমে তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘লেখালেখিটা অব্যাহত রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। বিয়ের পর সব শেষ হয়ে গেছে।’

‘আমি কবি’ উপন্যাসটি লিখেছেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল। ২০১৯-এর বইমেলায় এটি প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ। হলদে অভায় এর প্রচ্ছদ এঁকেছেন মোস্তাফিজ কারিগর।

বাংলা সাহিত্যের মূলধারার লেখক হিসেবে মোস্তফা কামালের নাম সর্বমহলে উচ্চারিত হচ্ছে। বিশেষ করে ‘অগ্নিকন্যা’, ‘অগ্নিপুরুষ’ ও ‘অগ্নিমানুষ’ উপন্যাস তাকে আলোচনার শীর্ষে নিয়ে এসেছে। ‘জননী’ উপন্যাসও তাকে অসামান্য খ্যাতি এনে দিয়েছে। এ উপন্যাসের ইংরেজি সংস্করণ ‘দ্য মাদার’ লন্ডনের অলিম্পিয়া পাবলিশার্স প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া ভারত, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে প্রকাশিত তার তিনটি উপন্যাসের ইংরেজি সংস্করণ ‘থ্রি নভেলস’ আন্তর্জাতিক মানের অনলাইন পরিবেশক আমাজনের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়েছে।

মোস্তফা কামালের সাহিত্যকর্মে মানবিক মূল্যবোধ, শ্রেণিচেতনা ও সমাজ বাস্তবতা জীবন্ত উপাদান হয়ে পরিস্ফুটিত হচ্ছে। জীবন ও জীবিকার নানা বাঁক, দৃষ্টিদৃক্ষা ও চর্চিত অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি তার সৃষ্টিকর্মকে বাস্তবতায় রূপদান করছেন। পঠনে, বোধে ও বিশ্লেষণে তার সাহিত্যধারা ও সাহিত্যচেতনা সত্যিকারার্থে নতুনত্ব ও উত্তরাধুনিকতার গুণে অনন্য হয়ে উঠেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close