মৃধা আলাউদ্দিন

  ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯

স্বাধীনতা বা লাল-সবুজের চেতনা

আরব বণিকদের কাছে প্রথমে ইংরেজরা জানতে পারল ভারতীয় উপমহাদেশের কথা। এই সবুজ-শ্যামল সুন্দর বদ্বীপের কথা। তারপরই ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে কলম্বাস ছুটল তার দলবল নিয়ে আমাদের এই উপমহাদেশকে উদ্দেশ্য করে আমাদের এই সবুজ ভূমির দিকে। দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত এসে কলম্বাস তার দিক হারিয়ে, আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে চলে গেলেন আজকের আমেরিকায়। সে অনেক কাহিনিÑ তবে একদিন জানতে পারলেন, তারা ভারত উপমহাদেশ জয় করতে পারেনি। এরও বহু বছর পর, ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে মেরে বর্বর ইংরেজরা ঠিকই দখল করে নিল আমাদের এই দেশ। শাসন করল প্রায় ২০০ বছর এবং একদিন ঠিকই বিদ্রোহ করে বসল এই উপমহাদেশের মানুষজন। রাজ্য ছাড়তে বাধ্য হলো ইংরেজরা। রাজ্য ছাড়লেও ভাইয়ে ভাইয়ে বাধিয়ে দিয়ে গেল সংঘাত। যুদ্ধ। ভাগ হয়ে গেল ভারত-পাকিস্তান। মুসলমান বলে আমরা পড়লাম পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে। কিন্তু ওরাও একসময় আমাদের সঙ্গে বিদ্রোহ করল। বলল, উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। আমরা ‘না’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলাম এবং ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধের পর ফিরে পেলাম আমাদের এই বাংলা নামের দেশ।

২.

বিশ^ মানচিত্রের দিকে তাকালে চোখে পড়বে ছোট্ট একটি সবুজ ভূখ-, আমাদের বাংলাদেশ। দেশটি বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ভালো করে না তাকালে চোখেই পড়ে না; এত ছোট এই আমাদের দেশটি। এর তিন দিকই ঘিরে রেখেছে বিশাল দেশ ভারত, পাহাড়ের দেশ নেপাল, ভুটান আর মিয়ানমার। অর্থাৎ নদীমাতৃক বদ্বীপের এই দেশটি আগে ছিল অখ- ভারতেরই একটি ক্ষুদ্র অংশ। যদি ভারত আমাদের কখনো আক্রমণ করে বসে, তখন বঙ্গোপসাগরে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো গতান্তর থাকবে না। যাক সে কথা, পাকিস্তানিদের উর্দু ভাষাও আমরা নিজেদের ভাষা হিসেবে মানতে পারলাম না। আমাদের এই পূর্ববাংলার সহজ-সরল মানুষগুলো নির্যাতিত হতে হতে একসময় রুখে দাঁড়াল। ছাত্র-জনতা, শিক্ষক ও মেহনতি মানুষদের মন ও মননে, জীবন-জিঘাংসায় বাঁধভাঙা বন্যার মতোই এলো স্বাধীনতার আশা-আকাক্সক্ষা। তারা নদীর মতোই উত্তাল হয়ে উঠল স্বাধীনতার দাবিতে। গর্জে উঠল নিরীহ হাল চাষ করা, মাছ ধরার জেলে, কামার-কুমার-তাঁতি মানুষগুলো। কারণ এটাই তো তাদের পরিচয়; তারা মাছে ভাতে বাঙালি। শুরু হলো ভাষার জন্য, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সাল। দেশজুড়েই তখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মানুষের মনে প্রচ- ঘৃণা আর রাগ। সবার মনে উৎকণ্ঠা। জননেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারা দেশের মানুষ তখন মানসিকভাবে স্বাধীনতার দাবি আদায়ের জন্য রুখে দাঁড়াতে প্রস্তুত হলো। সবার মনে ভয় ছিল, হয়তো পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা সহজে আমাদের দাবিগুলো মেনে নেবে না। হয়তো তারা কঠিন কোনো আইন বা নিয়ম চাপিয়ে দেবে আমাদের জনগণের ওপর। কিন্তু তা কখন, কীভাবে হবে, তা কেউই অনুমান করতে পারেনি, ভাবতেও পারেনি। একটা দারুণ কষ্টের মধ্যে দিন পার করছিল এই পূর্ববাংলার মানুষজন। ঠিক তখনই, পঁচিশে মার্চ রাতে ঢাকায় শুরু হয়ে গেল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অতর্কিত বর্বর আক্রমণ। যুদ্ধ। রক্তের বন্যা। হিন্দু-মুসলিম, নিরীহ মানুষদের পাখির মতো গুলি করে মারতে থাকল পাকিস্তানি হায়েনারা।

এরপর কী হলো তাতো আজ ইতিহাস হয়ে আছে। বাঙালিদের জন্য বিজয় আর পাকিস্তানিদের জন্য চরম পরাজয়ের সেই ইতিহাস। কিন্তু এই বিজয় বা স্বাধীনতা সহজে আসেনি। এই স্বাধীনতা আসবে বলেই আমাদের অজস্র মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারাল। হাজার হাজার বাবা, ভাইবোন তাদের জীবন দিল। বাড়িঘর পুড়ে ছাই হয়েছে লাখো মানুষের। রক্তের বন্যা বয়ে গেছে গ্রাম থেকে গ্রামে। সমগ্র দেশে। হাজার হাজার কিশোর, তরুণ, তরুণী, যুবক আর বৃদ্ধ আনাড়ি হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়েছিল আমাদের জওয়ানরাও। বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসারের বেশির ভাগ সদস্যই এসব বাহিনীতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া এফএফ মুজিব বাহিনী এবং যৌথ বাহিনীর অবস্থান ও নিরাপত্তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এসব বাহিনী। মুজিবনগর সরকারের অনুগত ছোট ছোট বাহিনীই মূলত মুক্তিযুদ্ধের ‘প্রাণ’ ছিল। দেশের ভৌগোলিক কারণ ও যাতায়াত ব্যবস্থা তেমন উন্নত না হওয়ায় স্বাধীনতাকামী, এই পূর্ববাংলার মানুষদের খুব কষ্ট হচ্ছিল সত্য। তবু দুর্গম অঞ্চলে, পাহাড়-পর্বতে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই বিভিন্ন বাহিনী গড়ে উঠেছিল। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আমাদের দেশের চলচ্চিত্র, নাট্য ও কণ্ঠশিল্পীরাও যুদ্ধের সময় যে যার যার মতো করে তাদের অবদান রেখেছেন। এ সময় কলকাতা থেকে প্রচারিত হতো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নানা অনুষ্ঠান, নজরুল ও দেশাত্মবোধক গান মানুষের মনোবল বাড়িয়েছে, উৎসাহ-উদ্দীপনা জুগিয়েছে সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনা মানুষরা।

৩.

১৬ ডিসেম্বর ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কেবল বিজয় দিবসে নয় বরং বিজয়ের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে প্রত্যেক বাঙালিরই কিছু কর্তব্য রয়েছে। প্রতিক্ষণে দেশ-জাতি, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পক্ষে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে কাজ করা। বাঙালির ইতিহাস সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন, তাই এর সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ ও প্রচারে জাতীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করাও জরুরি। যারা স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিজয়ের ইতিহাস বিকৃত করে পরবর্তী প্রজন্মকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে সচেষ্ট, তাদেরও চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া আমাদের, প্রত্যেক বাঙালির জাতীয় কর্তব্য। স্বাধীনতাময় এই দিনটি, বিজয় দিবসের দিনটি সবার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যময়। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস বড় সমৃদ্ধ ও আত্মত্যাগের ইতিহাস। তবে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বিজয় দিবসকে সীমাবদ্ধতা না রেখে কষ্টার্জিত স্বাধীনতার যথাযথ সংরক্ষণে আমাদের এই দিনে বিশেষভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা গতিশীল, প্রকৃত আদর্শকে সঠিকভাবে রক্ষা করার নিরিখে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে প্রত্যেকের অবস্থান ও ক্ষমতা অনুসারে বাংলাদেশের বাঙালির কৃষ্টি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে, দেশ গঠনে একযোগে সবাইকে কাজ করতে হবে। তাতে দেশের সমৃদ্ধি ঘটবে, জাতি অনেকদূর এগিয়ে যাবে। তরুণ প্রজন্ম পাবে মুক্ত-স্বাধীনতার স্বাদ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close