গৌতম চন্দ্র দাশ

  ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৯

সৈয়দ শাহনূর

আধ্যাত্মিক গানের স্বর্ণযুগের মহাজন

‘বন্ধু তোর লাইগা রে/আমার তনু জড়জড়/মনে লয় ছাড়িযারে যাইতাম/থুইয়া বাড়িঘর।’ এ রকম অসংখ্য জনপ্রিয় ও তত্ত্ববহুল গানের রচয়িতা সাধক কবি সৈয়দ শাহনূর। তাকে যতই জানা হয়, ততই আগ্রহ বাড়ে। শুধু গানেই কবির এই দেশ-দেশান্তরে ছুটে চলা নয়, বাস্তব জীবনেও ছুটে বেড়িয়েছেন পরম আরাধ্যের সন্ধানে সিলেট, আসামসহ পূর্ববঙ্গের বিস্তৃত জনপদ। শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় কবিসম্পর্কিত মন্তব্য ছিল এমন, ‘যে যে ফকিরের কণ্ঠ-বাণীর সুরতরঙ্গে নিজস্ব কথায় অধ্যাত্মবাদ ফুটিয়া উঠিয়াছে, যাদের কথায় শ্রীহট্টের পল্লী ভাব-সাগরে সাঁতার দেয়, যাদের কাছে শ্রীহট্টের হিন্দু-মুসলমান সমভাবে মাথা নোয়ায়, তাদের মাঝে সৈয়দ শাহনূর শীর্ষস্থানীয়।’(শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, মাঘ, ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ) এই গুণী সৈয়দ শাহনূরের জন্ম ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে মৌলভীবাজারে। তার রচিত ‘পুথি নূর নছিয়ত’-এ বলেছেন, ‘নুরের পীর ভজিআ কইসা চান্দের চরন/নিআজ না মুই গআলে দিছি ভবের ধন/জরম দাতা ভজিআ কই ছৈঅদ নবু নাম/কলস বিবি মাএ কৈইছৈন জার পানির কাম/উছতাদ ভজিআ কই চেরাগ আলি জি।’

কবি তার রচনায় পিতা হিসেবে সৈয়দ নবু (ওরফে সৈয়দ শাহ করম আলী) ও মাতা কলসী বিবি বলে উল্লেখ করেছেন। আরো জানা যায়, কবির মুরশিদ ছিলেন শাহ মনজুর আলী, পীর ছিলেন শাহ চান্দ আর ওস্তাদ ছিলেন চেরাগ আলী। কারো মতে, সৈয়দ শাহনূর তিনটি বিয়ে করেন। সমিনা বানু নামক কবির একজন স্ত্রীর নাম জানা যায়, যিনি নিজেও কবিত্ব শক্তির অধিকারী ছিলেন। গবেষক মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান ‘আধ্যাত্মিক সাধক ও মরমি কবি সৈয়দ শাহনূর’ গ্রন্থে দুই বিয়ে ও তিন পুত্রসন্তান ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। সৈয়দ শাহনূর ১৮৫৫ সালে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার জালালসাফ গ্রামে মারা যান।এখানেই তার মাজার।

সৈয়দ শাহনূরের রচনাবলি- পুথি নূর নছিয়ত, রাগনূর, নূরের বাগান, মনিহরি ও সাত কন্যার বাখান। সবগুলোই সিলেটী নাগরী লিপিতে লেখা। কবির রচিত ‘সাত কন্যার বাখান’ গ্রন্থটি মো. আবদুল মান্নানকৃত বাংলা লিপ্যান্তরসহ উৎস প্রকাশন, ২০০৯ সালে প্রকাশ করে। বাৎসায়নসহ বিভিন্ন প্রাচীন কামশাস্ত্রকারগণ নারীর ভালো-মন্দ বিরাচক যে লক্ষণগুলো আলোচনা করেছেন, সৈয়দ শাহনূর রচিত আলোচ্য গ্রন্থেও ভিন্ন ভিন্ন লক্ষণ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন নারীর গুণাবলির বর্ণনার প্রয়াস পেয়েছেন।

এ ছাড়া বাকি গ্রন্থগুলো অপ্রকাশিত। কবির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা ‘পুথি নূর নছিয়ত’। এই গ্রন্থ বাংলা লিপ্যান্তর সম্পর্কে একটি কিরা (অভিশাপ) মৌখিকভাবে প্রচলিত থাকায় গ্রন্থটির বাংলা লিপ্যান্তর কেউই প্রকাশ করেননি। এই গ্রন্থের পান্ডুলিপির একটি মূল অনুলিপি ও একটি অনুলিপির ফটোকপি সংগ্রহ করতে পেরেছি। পান্ডুলিপি দুটি মিলিয়ে প্রামাণ্য পাঠ তৈরি ও আরো কয়েকটি পান্ডুলিপি সংগ্রহ ও লিপ্যান্তরের চেষ্টা করছি। গ্রন্থের শুরুতে কবি গ্রন্থপাঠ ও ব্যবহারের যে নিয়মাবলি পদ্য ছন্দে লিখেছেন, তার মূল অংশ হলো, ‘কেহ জদি চাএ এই পুতি লেখিবার/ছারা লেখিআ পুতি করিহ সমার/পএআর তৈআ জেই জনে রাগ নিত চাইব/নিচএ জানিঅ তার রুহু ছিআ হৈব।’

যেহেতু ‘পুথি নূর নছিহত’ গ্রন্থের অংশ বিশেষ প্রচার বা কপি করা কবি নিষেধ করেছেন, সেই সাবধান বাণীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পাঠকের কৌতূহলের দিক বিবেচনা করে এই গ্রন্থটির সারমর্ম বর্ণনার চেষ্টা করছি। কাউসার চৌধুরী তার ‘সৈয়দ শাহনূর ও তার গান’ গ্রন্থে গবেষক চৌধুরী গোলাম আকবরের উদ্ধৃতি দিয়ে ‘পুথি নূর নছিহত’ গ্রন্থের পৃষ্ঠা ২৭৩ ও এতে ২৭টি পয়ার ও ২১৩টি গান আছে বলে উল্লেখ করেছেন। শাহনূর সাহিত্য সংসদের সেক্রেটারি আ. মন্নানের কাছে রক্ষিত একটি পান্ডুলিপির ৩০২ পৃষ্ঠা, প্রতি পৃষ্ঠায় লাইন সংখ্যা ২০ আছে জানিয়েছেন। এই গ্রন্থে বন্দনা ১, পয়ার ২২, পৈ (মরমীয়া) ধাঁধা ৫১, গীত ১০৮ আছে। আমার সংগৃহীত মূল পা-ুলিপির অনুলিপি কীট দংশিত ও ছেড়া হওয়ায় মোট পৃষ্ঠা নির্ণয় করা যায়নি। এই পাণ্ডুলিপির বর্তমান পৃষ্ঠা ২৮৮, প্রতি পৃষ্ঠায় গড় লাইন সংখ্যা ১৬। ফটোকপি করা পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠা ৪২০, প্রতি পৃষ্ঠায় গড় লাইন সংখ্যা ১৫টি। গ্রন্থে বন্দনা, বয়আনসহ মিলে ৪১টি পয়ার, পৈ (মরমিয়া ধাঁধা) ৫১টি, রাগ, জারি, লাচারী, মালসী, নৌকা দৌড়ানোর হাইর মিলে গীত আছে ১২১টি। এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়- লোকশিক্ষা ধর্মী রচনা, মরমিয়া ধাঁধা (পৈ), মরমি সংগীত, কৃষিকাজ ও দৈনন্দিন জীবনে নানা শুভ অশুভ দিকনির্দেশনামূলক রচনা।

প্রেমমিশ্রিত ধ্যান অনুধ্যান দ্বারা পরম সত্তার সঙ্গে মিলিত হতে আগ্রহীদের মরমিবাদী নামে আখ্যায়িত করা হয়। আর ইসলামিক ভাবধারা আশ্রিত মরমিবাদকে সুফি মতবাদ বলা হয়। সুফি মতবাদ ভারতবর্ষে আসার আগে ভারতীয় বিভিন্ন দেহাত্মবাদীদের মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণে ভারতবর্ষে আসার পর ভারতীয় অন্যান্য মরমিবাদের সঙ্গে সুফি মতবাদ সমানতালে বিকশিত ও প্রচারিত হতে থাকে।

অন্যান্য মরমিবাদীর মতো সুফিসাধনাও গূঢ়, গোপনীয়। তারা তাদের সাধনার পদ্ধতি, তথ্য, সাধনালব্ধ জ্ঞান, তত্ত্বকথা প্রকাশে আশ্রয় নেন সুফি কবিতার। ভারতীয় সংগীতের তালে তাল মিলিয়ে ভারতবর্ষে এই কবিতা সংগীতের গুণ অর্জন করে রূপ নেয় মরমি সংগীতের। সৈয়দ শাহনূর ছিলেন ফকিরী মতবাদ প্রভাবিত সুফি সাধক। তার রচনাবলি ও জীবন সম্পর্কিত কিংবদন্তি বিশ্লেষণে অন্তÍত এমনটাই মনে হয়।

সুফিমতবাদীরা ইসলামি ভাবধারায় আলোকে সাধনায় রত হন। সৈয়দ শাহনূর একটি গানে বলেছেন- ‘নুরে কান্দে-কান্দে নুরে ইমানের লাগিয়া/হেলায় হারাইলে ইমান পাইমুনি খুজিয়া।/হায় হায় রতন ধন হারিলু বিফলে/কি জুয়াব দিমু আমি হাসরের কালে।’

মরমিবাদীগণের সাধনার একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ হলো নিজ দেহকে জানা। কবি রচিত একটি গানে আছে, ‘বাড়ীর মাঝে পুস্করিনী/শান বান্দাইল ঘাটখানি/হাতি ঘোড়ায় না খায় পানি/কলসী না অয় তল।/সেই পুকুরের পানি খাইলে/নাগর হয় পাগল।

সৈয়দ শাহনূর ছিলেন দীর্ঘজীবী। এই দীর্ঘজীবনের কারণে তিনি যেমন সহজেই ঘুরে বেড়িয়েছেন ভাব ক্ষেত্র বাংলার বিভিন্ন স্থানে, তেমনি রচনা করতে পেরেছেন মূল্যবান ও পরম আস্বাদ্য আধ্যাত্মিক সংগীত। তিনি বাংলার আধ্যাত্মিক সাধনা ও সংগীতের স্বর্ণযুগের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close