বীরেন মুখার্জী

  ২৯ নভেম্বর, ২০১৯

রবিউল হুসাইন

চকিত অবলোকন

‘বিছিন্নতাবোধ’ আধুনিক কবিতার মৌল প্রবণতাগুলোর একটি। আধুনিক কালপর্বের কবিরা একাকিত্ব লালন করেন। নিজেকে মনে করেন শেকড়বিচ্যুত। তাদের কবিতায় এসব প্রপঞ্চ যথাযথ চিত্রকল্প এবং রূপকের মাধুর্যেও স্ফূর্তি পায়। কবিতাকে আরো শৈল্পিক করে তুলতে নানান ঈঙ্গিত দেন আধুনিক কালপর্বের কবিরা। প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘বিপন্ন মনোভূমি’ সৃষ্টি করে কবি যে ইঙ্গিত দেন, তা বস্তুগত নাকি অবস্তুগত? এ প্রশ্নের ভেতরে প্রবেশের আগে বিচ্ছিন্নতা বিষয়ে ফরাসি দার্শনিক জ্যাক লাকার মতামত জেনে নেওয়া যাক। মনোবিশ্লেষণিক রচনা ‘এক্রিটস’ গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ‘আধুনিক বৈজ্ঞানিক সভ্যতায় ভাষার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যেই বিচ্ছিন্নতার সবচেয়ে গভীর কারণগুলো লুকিয়ে আছে।’ জ্যাক লাকার মতানুসারে ‘ভাষা’ ও ‘সম্পর্ক’ এ দুটি বিষয় সামনে আসে, যা বিচ্ছিন্নতাকে মূর্ত করে তোলে। অপরদিকে ‘আধুনিকতা’ এবং ‘ফিউচারিজম’ আন্দোলনের পুরোধা প্যারিসে জন্মগ্রহণকারী সুইজারল্যান্ডের কবি-উপন্যাসিক ব্লেজ সঁদ্রার (Blaise Cendrars) বলেছেন, ‘প্রত্যেকটি জীবন একটা কবিতা, একটা গতি ছাড়া আর কিছু নয়।’ এ কথাগুলো মনে এলো, ষাটের উজ্জ্বলতম কবি রবিউল হুসাইনের কবিতার সামনে উপনীত হয়ে।

রবিউল হুসাইন একাধারে কবি, স্থপতি, উঁচুস্তরের শিল্প-সমালোচক, ছোটগল্পকার এবং প্রাবন্ধিকও। সবকিছু মিলিয়ে তিনি একজন শিল্প-সমঝদার। কবিতায় তাকে পৃথকভাবে চেনা যায় মূলত কবিতায় বিচ্ছিন্নতাবোধ, দুঃখ, হতাশা, নিরানন্দ ইত্যাদি কারণে। কারো কারো কবিতায় বিচ্ছিন্নতাবোধ শক্তির স্মারক হিসেবেও দৃশ্যমান। রবিউল হুসাইন এদেরই একজন, যিনি জগতের সব বস্তুকে অনায়াসে অবস্তুগত করে তোলার ক্ষমতা রাখেন। দীক্ষিত পাঠক এ প্রক্রিয়া কবির ‘একান্তই ব্যক্তিগত’ হিসেবে শনাক্ত করেন। যদিও তার মতে, ‘কবিতা মানুষের প্রতিধ্বনি, মানুষও কবিতার প্রতিভূ। কবিতা স্বপ্ন, সংগ্রাম, ভালোবাসা, জীবন ও বাস্তবতার ভাষ্যরূপ দেয়। বিভিন্নভাবে মানুষ ও দেশকে বিভক্ত করা হয়, তার বিপরীতে কবিতা সবাইকে শান্তি ও কল্যাণে এবং শ্রেয়বোধে উজ্জীবিত করে।’

‘কোনোকিছুই কোনোকিছু নয় খানিক ইঙ্গিতময়/যদিও সম্পূর্ণতা সবসময় পরিবর্তনের প্রস্তুতি/পরিস্থিতি নিবিড় চাষের বিনম্র আলিঙ্গনে ঘন হয়/সাধারণত অসাধারণত্ব কোনোদিন পায় না স্বীকৃতি।’

‘কোনোকিছুই কোনোকিছু নয়’ কবিতায় তিনি যখন সম্পূর্ণতাকে ‘সবসময় পরিবর্তনের প্রস্তুতি’ হিসেবে দেখেন তখন, জীবনের জটিল ইঙ্গিতময়তায় কি কোনো নতুন ভাষ্যের উন্মোচন ঘটে? রবিউল হুসাইনের কবিতার আপাতদৃশ্যে এই প্রশ্নের মীমাংসা নেই সত্য, কিন্তু সম্পূর্ণ কবিতাটির মর্মস্থলে এক ধরনের বার্তা ‘অদৃশ্যতার অবগুণ্ঠনে লুপ্ত’, প্রকারান্তরে লুপ্ত নয় প্রকাশ্য। এই বৈপরীত্যধর্মী বয়ানকৌশলই কবিতার মর্যাদা লাভ করে বোদ্ধা পাঠকের কাছে।

অস্বীকার করা যাবে না যে, ষাটের দশকে গড়ে ওঠা স্যাড আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কবিতায় নতুন হাওয়া এনে দেয়। রবিউল হুসাইনের কবিতায় স্যাড আন্দোলনের ছাপ আছে, আছে জীবনের ছাপও। স্থপতি হওয়া সত্ত্বেও তিনি প্রতি পলে কবিতার মধ্যেই বসবাস করেছেন। তাই কবিতায় রবিউল হুসাইনকে বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কবি মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কবিতার বাইরেও অপরাপর বিভিন্ন বিষয়ে তার ব্যুৎপত্তি, গভীর জ্ঞানের আঁচ ভাবিয়ে তোলে। সমকালীন নানান অনুষঙ্গের সঙ্গে কবিতায় তিনি যে যুক্তির ভিত রচনা করেন, তা কবিতার মনোযোগী পাঠককে বিস্ময়বিমুগ্ধ ও সম্মোহিত করে। এ ক্ষেত্রে তার ‘একান্তই ব্যক্তিগত’ কবিতাটির পাঠ নেওয়া যেতে পারে।

‘নিশ্চিত হওয়ার কী প্রয়োজন এখন/যেখানে অনিশ্চয়তার এত আয়োজন/বরং এই বিপদসঙ্কুলতায় দুলে দুলে/ভেসে ভেসে উৎপাটিত হই সমূলে।’

প্রকৃতপক্ষে, সমকালীন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে কবি যখন মানসচক্ষে দেখতে থাকেন ‘কোথাও স্থিরতা নেই, নেই কোনো নিজস্বতা’ তখন তিনি ঢালুভূমির দিকে বয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন। পাশাপাশি মনে করিয়ে দেন ‘দুই দিকে সারি সারি বিবর্তনের উষর জমি/পূর্ণ সতেজ সর্বংসহা দুঃখ-কষ্ট বহমান’; যা পরিবর্তিত জীবনেরই ইঙ্গিতবাহী মনে করা যেতে পারে। পাঠক বোধকরি একমত হবেন, রবিউল হুসাইন এমন একজন শক্তিমান কবি, যিনি একটি সাধারণ বিষয়কে হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করতে পারেন। অনাস্বাদিত কিংবা আস্বাদিত চিত্রকল্পে তার কবিতায় যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক জীবনবোধের গভীর প্রকাশও লক্ষ করা যায়। প্রবল দুঃখবোধ জাগ্রত থাকা সত্ত্বে কখনো-সখনো আশাবাদও ধ্বনিত হয় তার কবিতায়। ‘আশা আর আসা’ কবিতায় তিনি বলেনÑ ‘কী এমন প্রত্যাশা যে আসতেই হবে প্রতিবার/না এসেও তো আসা যায় মনে মনে/আশা যায় আশা আসে বারংবার/আসা যায় আসার আশায় বসা যায় সিংহাসনে/...আশা নেই আশা কখনো থাকে না অমন/আসা-যাওয়ার মধ্যেই আশার সরল মন/ওই যে বিন্দু বিন্দু আলো ওরা কারো নয় তেমন/ওরা সবার ওরা খুব নিজস্বপরায়ণ/... আবার নিজেরও নয় অনমত্মকাল ঘুরে ঘুরে মরে/আসে আর আশায় আশায় আসা-যাওয়া করে/আশার আসায় যায় আসে সব/আসার আশায় নিত্য কলরব।’ এভাবেই তিনি আশাকে দুরাশার কলরবে একই সুতোয় গ্রন্থিত করে উপস্থাপন করেন।

‘কবিতা সবসময় সত্যিকথা বলে’ কবিতায় রবিউল হুসাইন উল্লেখ করেছেন, ‘ভালোবাসা দুই রকমের/মনোমিলনের আর মনোমালিন্যের’; কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘যুদ্ধ প্রেম শিল্প আর রাজনীতির কোনো স্থায়িত্ব নেই/সর্বদাই পরিবর্তনবান্ধব/জীবিত না থাকলে মানুষ বা প্রাণীর মৃত্যু হয় না/যার কিছু নেই, সে কীভাবে নিঃশেষ হবে/যে ঘর থেকে বেরই হয় না, সে কী করে পথ হারাবে।’ ‘ধান্যসংস্কৃতির এই মৃত্তিকা’ কবিতায় কবির এই আত্মজিজ্ঞাসা জীবন কিংবা শিল্প উভয়ের ক্ষেত্রেই যেমন প্রাসঙ্গিক, তেমনইভাবে তার কবিতার গভীর পাঠে ‘মণিমুক্তা’-এর সন্ধান পাওয়ার প্রসঙ্গটিও অমূলক মনে হয় না। কবি এখন অনন্তলোকের যাত্রী। ফলে আজকের এই চকিত অবলোকন কবিকে নিয়ে গবেষণার সূত্রমুখ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কবিকে অন্তিম শ্রদ্ধা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close