স্বপ্নীল রায়

  ১৫ নভেম্বর, ২০১৯

বইয়ের অনিল পর্দার অনিল

বিখ্যাত বই থেকে বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাণ অতীতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এটা যেমন বাংলাদেশে, তেমনি বাইরেও। সেসব বইয়ের মতো চলচ্চিত্রও দর্শকের মাঝে সাড়া ফেলে। এটা সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয় সেই দর্শককে, যিনি বইটি আগে পড়েছেন। পাঠক সেসময় দর্শক হয়ে চেষ্টা করেনÑ বই থেকে পর্দার কাহিনির কতটুকু সামঞ্জস্য। বইয়ের চরিত্র পর্দায় ঠিকমতো এসেছে কি না। এসব প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। সে কারণে সাধারণ দর্শকের থেকে এসব বই পড়া দর্শকের আগ্রহ ও বিশ্লেষণে পার্থক্য থাকে।

বাংলা সাহিত্যে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বহু উপন্যাস এবং তা থেকে চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। উদাহরণ অনেক। প্রতিনিয়তই নতুন সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে। সাহিত্যের একেকটি শাখা নতুন করে মুক্তিযুদ্ধ ও তৎকালীন পরিস্থিতিকে প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছে। কবিতা, ছড়া, ছোটগল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করছেন লেখকরা। ভবিষ্যতেও আরো সাহিত্য রচিত হবে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে।

প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন। লিখেছেন কালজয়ী সব উপন্যাস। প্রতিটি উপন্যাসই অমূল্য সম্পদ। এসব উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সুচারুরূপে বর্ণনা করেছেন। এ রকম বহু উদাহরণ না টেনে হুমায়ূন আহমেদের ‘অনিল বাগচীর একদিন’ উপন্যাসের কথাই ধরা যাক। উপন্যাসটি ব্যাপক জনপ্রিয়। উপন্যাসের চরিত্র, বর্ণনা, আবেগ সবকিছুই নিখুঁত। এ উপন্যাস কম করে হলেও পাঁচবার পড়েছি। প্রতিবারই আগ্রহ ছিল সমান। এরপর যখন এই উপন্যাস বই থেকে সিনেমায় রূপান্তরিত হলো, তখন বারবার পড়ার সঙ্গে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অনিলের চেহারা, আচরণ, পোশাক, কথা বলার ধরন, উপন্যাসের কাহিনি এবং প্রতিটি চরিত্রের খুঁটিনাটি দিক মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করলাম। সত্যি বলতে, উপন্যাস পড়ার সময় চোখবুজে যে অনিলকে কল্পনা করেছিলাম, পর্দার অনিল ছিল অনেকটা সে রকমই। সাধারণ, সহজ-সরল এবং কিছুটা ভীত চরিত্রের।

উপন্যাসের মূল চরিত্র অনিল নামের এক হিন্দু যুবক। ঢাকায় চাকরি করেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও ঢাকায় অবস্থান করেন। তার বাবার মিলিটারির হাতে মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা দেন। উপন্যাসের সিংহভাগই পথের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে। উপন্যাসে আরো চরিত্র থাকলেও অনিল চরিত্রটি কেন্দ্রীয়। উপন্যাসজুড়ে অনিল এবং তার পারিপাশির্^ক অবস্থার বর্ণনাতে মুক্তিযুদ্ধকালীন অবস্থার একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। উপন্যাসের প্রথম দিকে অনিলকে বেশ ভীতু দেখা যায়। তবে কাহিনি এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনিল আর ভীতু থাকেননি। উপন্যাসের এক জায়গায় অনিল যখন বাবার মৃত্যু সংবাদের চিঠি নিয়ে ওই রকম একটি পরিস্থিতিতে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন, তখন পথে মিলিটারি অফিসার এবং বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হয়।

বিদেশি সাংবাদিক ডেকে নিয়ে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে অনিল নির্ভয়ে জানান, ‘স্যার, আপনি নিজে বুঝতে পারছেন না? আপনি কি রাস্তায় কোনো শিশু দেখেছেন? আপনার কি চোখে পড়েছে হাসতে হাসতে, গল্প করতে করতে কেউ যাচ্ছে? শহরে কিছু সুন্দর সুন্দর পার্ক আছে। গিয়ে দেখেছেন পার্কগুলোতে কেউ আছে কি না? বিকাল চারটার পর রাস্তায় কোনো মানুষ থাকে না। কেন থাকে না? স্যার, আমার বাবা মারা গেছেন মিলিটারির হাতে।’ এর পরও তার সঙ্গে অনিলের কথা চলতে থাকে। এ রকম একটি পরিস্থিতি, যেখানে অনিলের বাইরে বের হওয়াটাই বিপজ্জনক। সেখানে অবলীলায় পাকিস্তানি অফিসারের সামনে সত্য কথা বলে দিলেন। এই দৃশ্য সিনেমায় বেশি আলোড়িত করেছে। একজন পাক সেনাবাহিনীর অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে সত্যি কথা বলার সময় যে তীক্ষè অভিনয়শৈলীর দরকার হয়, তা পর্দার অনিলের ছিল। অনিলের বক্তব্য অনুযায়ী বাবার চিঠি বুকে নিয়ে তিনি মিথ্যা বলতে পারবেন না। তাছাড়া যুদ্ধাবস্থা চলতে থাকা কোনো দেশের পরিস্থিতি জানার জন্য আশপাশে তাকালেই স্পষ্ট হওয়া যায়, তাই বোঝানো হয়েছে। এই কথা কেবল এ দেশের জন্য নয়, বরং বিশে^র যুদ্ধাবস্থা চলতে থাকা জাতির জন্যই সত্যি। একটি সমাজের প্রাণ হলো শিশু। সেই শিশুরা যদি দেশের রাস্তাঘাট, পার্কে আনন্দ করতে না দেখা যায়, চলাচল করতে না দেখা যায়, মাঠে খেলতে না দেখা যায়; তাহলে বুঝতে হবে সেখানে বড় সমস্যা রয়েছে। উপন্যাসে অনিলের বাবার দার্শনিকতা এবং অনিলের প্রতি গভীর আস্থা প্রকাশ পেয়েছে। কারণ তিনি জানতেন, তার সন্তানের আর কোনো গুণ না থাকলেও সততার বিষয়টি রয়েছে পুরো মাত্রায়। তাই তিনি নিজেই সন্তানকে প্রশংসাপত্র দিয়েছিলেন। যেখানে তার পুত্র সম্পর্কে খোলামেলা সত্য বর্ণনা রয়েছে। অনিল যখন চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ডে যান এবং তারা প্রশংসাপত্র দেখতে চাইলেন, তখন অনিল বাবার দেওয়া প্রশংসাপত্র বোর্ডে দেখান। যেখানে অনিলের প্রতি পূর্ণ আস্থা এবং বিশ^াসের প্রকাশ ঘটে। প্রশংসাপত্রের এক জায়গায় লেখা, ‘ঈশ^র মানুষকে পরিপূরক গুণাবলি দিয়ে পাঠান। সেই কারণেই আমার পুত্রের মেধার অভাব পূরণ করিয়াছে তাহার সততা। অন্য কোনো গুণ আমি আমার ছেলের মধ্যে লক্ষ করিনি। যাহা লক্ষ করিতেছি তাহাই বলিলাম। এই প্রশংসাপত্রেই অনিলের চাকরি হয়েছিল। সিনেমায় এ দৃশ্যে প্রথমে একটু বিব্রত মনে হয়েছিল। কারণ নিজের বাবার দেওয়া প্রশংসাপত্র ইন্টারভিউ বোর্ডে দেওয়ার কথা আসলে কল্পনামাত্র। কিন্তু অনিল এমন একটি চরিত্র, যেকোনো পরিস্থিতিতে সত্যি কথা বলে।

উপন্যাসে অনিল গ্রামের বাড়িতে রওনা হওয়ার পর যে বাসে উঠেন, সেই বাসে আয়ুব আলি নামে একজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। আয়ুব আলি চরিত্র একদিকে রাগী, অন্যদিকে গভীর মমতার। তিনি পরিবারের সঙ্গে রাগ দেখান, অপরদিকে অনিল হিন্দু জেনে তাকে বাঁচানোর জন্য কৌশল অবলম্বন করেন। এমনকি যখন মিলিটারি গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে, তখনো তিনি অনিলের নাম ‘মোহাম্মদ মোহসিন’ দেন। এটা করেন শুধুই অনিলকে মিলিটারির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। পর্দায় এই আয়ুব আলি চরিত্রকেও চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আয়ুব আলি নামের মানুষরাও নিজের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারেন, সে দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে নিজেরই ছিল বড় বিপদ। শেষ দিকে মিলিটারি অনিলকে ধরে নিয়ে যায়, তখন আয়ুব অনিলকে দিদিকে দেখার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। বিপদে একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়ানোÑ এটা তার উদাহরণ। মোটকথা, বইয়ের পাতার অনিল এবং পর্দার অনিলের চমৎকার মিল রয়েছে, যা বইটির পাঠকমাত্রই অনুভব করতে পারবেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close