অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

  ০১ নভেম্বর, ২০১৯

বই আলোচনা

বিসর্জনের নিশিকাব্য

বাঙালিয়ানার এই দুঃসহ সময়ে প্রবীণদের যোগ্যতা এবং দক্ষতাকে সম্মান জানিয়ে নবীনরা যখন তাদের শিল্প সৃজন করে, তখন তা কার না ভালো লাগে। নাট্যকার এস এম সোলায়মানকে আত্মস্থ করে কবি মাহফুজ রিপন কবিতার বই ‘বিসর্জনের নিশিকাব্যে’ লিখেছেনÑ খ্যাপা পাগলার প্যাচালে/উড়ে যায় জালালি কৈতর/ঘুড়ি ছেঁড়া লাটাই পড়ে থাকে/মা আমেনার হাতে।/অপেক্ষার শূন্য গৃহে, জমা হয় ধুলো!/কোর্ট মার্শালেÑ খ্যাপা/চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে!/আপন মাঝে ডুব দেবে বলে। (রঙ্গমাতন, পৃষ্ঠা ২৮)

গভীরে ডুব দিয়ে রতœ অনুসন্ধান পরিণত মনস্কের সিদ্ধান্ত। কিন্তু চাওয়া-পাওয়ার এই ছেলেখেলায় মানুষ তো স্বপ্ন দ্যাখে জীবনের থেকে অনেক বড় করে। ফলে নিরন্তর ছুটে চলে মানুষের কল্পনা। মানবের আশার প্রত্যাশাকে কাব্যিক অবয়বে ফুটিয়ে তুলতে কবি লিখলেনÑ পাগলা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে/ছুটে যাই অজানা গন্তব্যে,/খুঁজে যাই অমরত্বের বীজমন্ত্র;/রংধনুর সাত রঙে গতর রাঙিয়ে/ হতে চাই প্রকৃতির সন্তান। (শেষকৃত্য, পৃষ্ঠা ১৪)

প্রকৃতির সন্তান হতে চাই আর মানবসন্তান হতে চাই, চাইলেই যে সব পাওয়া যাবে এমন তো নয়। মহাভারতে আছে, বার্ধক্যজ্বরা-ব্যাধিতে দেহ ক্ষয় হতে হতে শেষ হতে চললেও থাকে বাসনা। অনন্ত যৌবন নিয়েই দেহ বাস করে। নইলে মৃত্যুপথযাত্রী কেন আগলে ধরতে চায় বালিশের নিচে রাখা টাকার বান্ডিল। বাসনার অনলে পুড়তে থাকা মোহ এবং মোহভঙ্গ নিয়ে কবি মাহফুজ রিপন লিখলেনÑ মূর্ধন্য সূর্যের তেজ আমাকে বারবার/জলের কাছে নিয়ে যায়/পিপাসার শরীরে লোনা ধরে।/জোয়ারের আশায় মন মাতায়,/ ঝাঁপায় দুনিয়ার এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। (জলকীর্তন, পৃষ্ঠা ৯)

বিসর্জনের নিশিকাব্য গ্রন্থেটির ভূমিকা লিখেছেন কবি ওবায়েদ আকাশ এবং এ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করা হয়েছে শতবর্ষী রাজেন্দ্রিয়ান মিলনমেলার প্রবাদ পুরুষ ড. রানা চৌধুরীকে, সাবেক অধ্যাপক সরকারি রাজেন্দ্র বিশ^বিদ্যালয় কলেজ, ফরিদপুর। কবি মনের প্রান্তের এপাশে যে চাওয়া ওপ্রান্তের ওপাড়ে সেই পাওয়া যে মেলে না, সে কারণেই হয়তো কবি লিখেলেন পবিরেশ বন্দনা কাব্যÑ জল-দর্পণে আকাশ জোড়া কষ্টÑ/অন্ধের মতো নীলকণ্ঠ পাখি;/রঞ্জন শোকে কাতর।/বিসর্জনের ব্যথায় নিশিকাল চলে যায়! (বিসর্জনের নিশিকাব্য, পৃষ্ঠা ১০)

এ গ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই পাঠককে টানমারবে এটা বলা যায় তবে আশাব্যঞ্জক কবিতা কবি বিনয় মজুমদারকে স্মরণেÑ নিভৃতচারী, অসাম্প্রদায়িক হে কবি!/মহাকাল তোমায় এনে দিলো প্রজন্মের কাছে/প্রকৃতির কাছে আজ প্রার্থনা,/তোমার কাব্য-শরীর অমরত্ব পাক/প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের রথে। (টান, পৃষ্ঠা ৩৫)

মনের রথে চড়ে কবি মাহফুজ রিপনের সৃজনে আশার বিপরীতে নৈরাশ্যই বেশি। হাহাকারের নিশিকাব্য রচনা করেছেন মাহফুজ রিপন। জলের জন্য হাহাকার, আলোর জন্য হাহাকার, একটুখানি আয়েশের জন্য হাহাকার, এ কারণে কবিতাগুলো হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে। এই নৈরাশ্য তথা হাহাকার যতটা না মানুষ নিয়ন্ত্রিত, তার চেয়ে বেশি নিয়তি নিয়ন্ত্রিত বলেই চিত্রশিল্পী রাজীব দত্তের প্রচ্ছদের পাখি দুটি বায়ু মানচিত্র ভাঙতে চায়। নিয়তি তো শেষ পর্যন্ত মানুষকে আক্রান্তই করে। তবু মেঘদূত কাব্যে বিরহের হাহাকার যেমন সত্য অভিজ্ঞান শকুন্ততলা কাব্যে সন্তান আগমনে উৎসবও সত্য। মাহফুজ রিপনের কাব্যে হাহাকারের বিপরীতে প্রাপ্তি, উদ্দেহীনতার বিপরীতে গন্তব্য, নৈরাশ্যের আঁধারের বিপরীতে আশার আলো জ্বলবেÑ এটাই কাব্য অনুরাগীদের দাবি। তবে এ কথা বলা যায়, ‘বিসর্জনের নিশিকাব্য’ সংগ্রহে রাখার মতো, ভিন্ন আঙ্গিকের, সুপাঠ্যের একটি নান্দনিক কাব্যগ্রন্থ।

বিসর্জনের নিশিকাব্য

মাহফুজ রিপন

প্রকাশক : চলন্তিকা

প্রচ্ছদ : রাজীব দত্ত

মূল্য : ১৪০ টাকা

প্রকাশ : বইমেলা ২০১৯

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close