মাহবুব আলম

  ১৮ অক্টোবর, ২০১৯

বই আলোচনা

পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ

পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ বইয়ের ভূমিকায় লেখক হায়দার আকবর খান রনো বলেছেন, ‘২০১৪ সালে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’Ñ এ বিষয়ের ওপর নিয়মিত লেকচার দেওয়ার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ করেছিল। কলা ও বিজ্ঞান উভয় অনুষদের সব বিভাগে এ বিষয়ের ওপর একটি বাধ্যতামূলক পেপারও আছে। তার ওপর পরীক্ষাও হয়। আমন্ত্রণ গ্রহণ করে আমি তখন থেকে উপরোক্ত বিষয়ের ওপর ক্লাস নিয়ে আসছি। শিক্ষাদান করতে গিয়ে আমি দেখলাম যে, এ বিষয়ের ওপর পরিপূর্ণ পাঠ্যপুস্তক নেই। অথবা যা আছে তা আমার পছন্দমতো নয়। তাই আমি প্রতি লেকচারের পাশাপাশি আমার তৈরি নোটস ছাত্রদের জন্য সরবরাহ করে আসছি। সেসব নোটস একত্র করে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে এই গ্রন্থটি তৈরি করা হয়েছে। এটি দুই খন্ডে সম্পন্ন বই হবে। প্রথম খন্ডটিতে রয়েছে বাংলার মধ্যযুগ থেকে ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দিনটি পর্যন্ত একটি সংক্ষিপ্ত ধারাবাহিক ইতিহাস।

লেখক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের জন্য বইটি লিখলেও এই বই শুধু ছাত্রদের পরীক্ষা পাসের পাঠদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই বই একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। মধ্যযুগ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাস রচনা করেছেন লেখক। এই বইয়ের পরিচ্ছেদ এক শুরু হয়েছে ‘প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা’ এই শিরোনামে। দুই খন্ডে প্রকাশিত এই বইয়ের ১ম খন্ডে রয়েছে ১৬টি পরিচ্ছেদ। ১৬টি পরিচ্ছেদের শিরোনামগুলো হচ্ছেÑ বাংলায় ইসলামের অভ্যুদয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ও বাংলা লুণ্ঠন, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণের বিভিন্ন পর্যায়, কৃষক বিদ্রোহ, সন্ন্যাস বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, তিতুমীরের বিদ্রোহ, তেলাঙ্গানা বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ, নানকার বিদ্রোহ, সিপাহি অভ্যুত্থান, কংগ্রেস ও গান্ধীর আন্দোলন, কমিউনিস্ট পার্টি ও শ্রমিক কৃষকের সংগ্রাম এবং সাম্প্রদায়িকতা, পাকিস্তান আন্দোলন ও দেশভাগ। অর্থাৎ দীর্ঘ বছরের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। তবে এই ইতিহাস ব্যতিক্রমী পুরোপুরি ভিন্ন এক ইতিহাস। আগেই বলেছি, সাধারণত আমরা যে ইতিহাস দেখি, পড়ি তা হলো রাজা-বাদশাদের ইতিহাস। কে কখন কীভাবে রাজা-বাদশা হলো, কীভাবে কত দিন শাসন করল, তার শাসনামলে তিনি প্রজাবৎসল ছিলেন না, অত্যাচারী ছিলেন এসব। এ বিষয়ে লেখক নিজেই বলেছেন, ‘আমি ইতিহাস বই লিখছি ঠিকই, কিন্তু তা পাঠ্যপুস্তক ধরনের বা গতানুগতিক ধরনের ইতিহাসের বই নয়। জনগণের চিন্তাচেতনা রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল, তা তুলে ধরা হয়েছে এই বইয়ে।’

সত্যিই তাই, এই বইতে লেখক সাধারণ মানুষের ইতিহাস লিখেছেন। যে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে। লড়াই করতে করতেই বেঁচে থাকে, সেই মানুষের ইতিহাস লিখেছেন। লিখেছেন সংগ্রামী আর সাহসী মানুষের ইতিহাস। যারা হার মানে না। যারা লড়াই-সংগ্রাম করে সমাজকে এগিয়ে নেয়, মানুষকে সচেতন ও সাহসী করে তোলে। মানুষকে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়, বাঁচতে শেখায়, সেসব মানুষের ইতিহাস লিখেছেন। তাইতো এই বইতে গুরুত্ব পেয়েছে বিভিন্ন বিদ্রোহ, গণ-আন্দোলন ও সশস্ত্র আন্দোলনের কথা। আমাদের দেশের ইতিহাসে রাজা-মহারাজাদের গৌরবগাথা তুলে ধরা হয়। বলা হয়, অমুক জমিদার ছিলেন দাপুটে জমিদার, তার দাপটে বাঘে-ছাগলে এক ঘাটে পানি খেত ইত্যাদি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাজতন্ত্রে রাজাই সব কিছু, ফলে সব ক্ষমতা তার হাতে। প্রজার কোনো ক্ষমতা নেই। প্রজা শুধু রাজ অনুগত থাকবে। রাজার আদেশ, নির্দেশ অনুযায়ী চলবে। এটাই রাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এর মধ্যেও প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হয়েছে। এই প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ইতিহাস সেভাবে লিখিত হয়নি। তার পরও এ কাজটা হয়েছে। কাজটা করেছে সামান্য কজন মানুষ। সেই সামান্য কজন মানুষের অন্যতম হায়দার আকবর খান রনো।

এখানে একটা কথা বলা দরকার তা হলো, আমাদের দেশের ইতিহাস লিখেছেন মূলত পাশ্চাত্যের ইতিহাসবিদরা। এদের মধ্যে আবার অধিকাংশই ইংরেজ ইতিহাসবিদ। ইংরেজরা ভারতবর্ষ দখল করে দীর্ঘদিন শাসন করেছে। শাসন না বলে রাজত্ব করেছে বলাই ভালো।এবং এটাই সঠিক। সেই ইংরেজ অর্থাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের লেখা ইতিহাস কেমন হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এর বাইরে এ দেশীয় যারা লিখেছেন তারা প্রায় সবাই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির অনুগত, দাসানুদাস ছিলেন। তাদের চিন্তাচেতনার মূলে ছিল এক ধরনের ঔপনিবেশিক মানসিকতা। আর তাই তাদের লেখনীতে ভারতবর্ষে সাধারণ ধারণা তৈরি করা হয় যে, ইংরেজদের কল্যাণে ভারতবর্ষের মানুষ আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছে। কিন্তু এটা মোটেও ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ শাসনের আগেই ভারতবর্ষে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটেছে। এবং ভারতবর্ষ শিক্ষা-দীক্ষায়ও যথেষ্ট অগ্রগামী ছিল। আর আর্থিক অবস্থাও খারাপ ছিল না। বরং ভারতবর্ষ ছিল সম্পদে ভরপুর। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর লর্ড ক্লাইভ তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে মুর্শিদাবাদ শহরে প্রবেশ করে বিস্মিত হন। তিনি তার সহকর্মীদের বলেন, ‘এত বড় বড় দালান। এ তো লন্ডন শহরের চাইতেও বড় শহর’। এ কথা কোনো ভারতীয় ঐতিহাসিকের নয়, এটা ব্রিটিশ ঐতিহাসিকের গবেষণালব্ধ লেখা। এ থেকেই বোঝা যায়, তৎকালীন বাংলা সম্পদে ভরপুর ছিল। আর এ কথা তো ব্যাপকভাবে প্রচারিত যে, সে সময় মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী জগৎশেঠের ধন-সম্পদ এত বেশি ছিল যে, তা কোনো ইংরেজ কেন সেই সময়ের দুনিয়ায় অন্য কোনো ব্যবসায়ী চিন্তাও করতে পারতেন না। আর যুদ্ধাস্ত্র ও প্রযুক্তির কথা যদি বলেন তাহলে বলতে হয়, বিশ্বে প্রথম রকেট প্রযুক্তি উদ্ভাবন হয় এই ভারতবর্ষে; মহীশুরে, টিপু সুলতানের শাসনামলে। আর ঢাকার মসলিন ছিল জগদ্বিখ্যাত। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের অনেকে মনে করেন, ইংরেজরা আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। এ বিষয়ে ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য। ইংরেজরা আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে এই বক্তব্য সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, ইংরেজদের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি শুধু রেলগাড়ি আর ইংরেজি ভাষা।

রাজস্ব আদায় প্রসঙ্গে লেখক ঐতিহাসিক প্রমাণাদি দিয়ে লিখেছেন, প্রাচীন ও মধ্যযুগে কৃষকের উৎপন্ন ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগ খাজনা হিসেবে সামন্ত প্রভুকে দিতে হতো। শেরশাহ ও আকবরের আমলে তা এক-তৃতীয়াংশে বৃদ্ধি পায়। পরে তা অর্ধেকেরও বেশি পর্যন্ত ধার্য করা হয়েছিল।’ প্রজারা এই অত্যাচার সব সময় সর্বক্ষেত্রে মুখবুজে মেনে নেয়নি। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিদ্রোহ করেছে। লেখক সেই বিদ্রোহের কাহিনি লিখেছেন। লেখক হায়দার আকবর খান রনো একজন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক। তাই তিনি শ্রেণি দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণ করে এই ইতিহাস রচনা করেছেন। এবং তা সার্বিকভাবেই সম্পন্ন করেছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close