হিমেল আহমেদ

  ৩০ আগস্ট, ২০১৯

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ও মেরি শেলি

মেরি শেলি। বিখ্যাত এই নারী ঔপন্যাসিকের সঙ্গে আমরা যতটা পরিচিত, তার চেয়ে অধিক পরিচিত তার লেখা জগৎজয়ী বিজ্ঞান ও কল্পকাহিনির উপন্যাস ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সঙ্গে। যেখানে তিনি তার কল্পনায় বিজ্ঞানকে মিশিয়েছেন সাহিত্যে।

মেরি শেলি তার লেখনীর মাধ্যমে আজও বিখ্যাত। ইংরেজি এই মহান লেখিকা জন্মগ্রহণ করেন ৩০ আগস্ট ১৭৯৭ সালে লন্ডনে। ২২২ বছর পেরিয়েছে অথচ মানুষ আজও মেরি শেলিকে নিয়ে লিখছে। এটাই একজন ভালো লেখকের গুণ। মৃত্যুর পরও যে লেখক স্বমহিমায় সৃষ্টকর্মে অমর হয়ে থাকেন। মেরি শেলি তাদের একজন।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন উপন্যাস নিঃসন্দেহে মেরি শেলির লেখা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। যে উপন্যাসকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে কল্পকাহিনির প্রথম উপন্যাস বলা হয়। মেরি শেলির এই উপন্যাসে আমরা দেখেছিÑ একজন বিজ্ঞানী, যিনি একই সঙ্গে ডাক্তার, নাম ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। যিনি বিভিন্ন গবেষণা করে একটি অতিমানবীয় দানব সৃষ্টি করেন। ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন প্রাণের উৎস নিয়ে যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন। তার স্বপ্ন ছিলÑ তিনি এমন কিছু আবিষ্কার করবেন, যার বদৌলতে পৃথিবী তাকে আজীবন স্মরণ করবে। তিনি দিন-রাত মানবদেহ এবং এর বিভিন্ন টিস্যু নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন। কীভাবে টিস্যু ধ্বংস হয় এবং পুনরায় জন্মানো সম্ভব, এসব তথ্য-গবেষণায় অজান্তেই এক মানব দানবের সৃষ্টি করেন। যাকে দেখে তিনি নিজেও ভয় পেয়ে যান এবং পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন। কিন্তু দানবটি তখন শহরে একা ঘুরতে থাকে। এভাবেই এগিয়ে যায় গল্পটি। মেরি শেলির এই উপন্যাস আজও সমাজে সমাদৃত। আজও তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন নাটক, সিনেমা কিংবা গল্প!

মেরি শেলিই প্রথম লেখক, যিনি বিজ্ঞান ও কল্পকাহিনির সুন্দর উপস্থাপক। কিন্তু এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গল্পটি মেরি শেলি কাকতালীয়ভাবে লিখেছিলেন। এটা প্রকাশ করতেও আগ্রহী ছিলেন না!

মেরি যখন তার ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গল্প লিখেছিলেন, তখন সময় ছিল খ্রিস্টাব্দ ১৮১৬। বন্ধু লর্ড বায়রনের আমন্ত্রণে শেলি দম্পতি তখন ছুটি কাটানোর জন্য জেনেভায় অবস্থান করছিলেন। জেনেভার আকাশে তখন খারাপ আবহাওয়া। খারাপ আবহাওয়ার জন্য সবাইকে ঘরেই থাকতে হতো। সময় কাটানোর জন্য তারা বিভিন্ন বিষয়ে গল্প ও আলোচনা করতেন। কেউ ভূতের গল্প বলতেন, কেউ বিজ্ঞানের রহস্যের! সঙ্গে ছিলেন লর্ড বায়রন ও জন পলিডরি। তারা দুজনই ছিলেন স্বামী পার্সি শেলির বন্ধুজন। একসময় এই আলোচনায় উঠে আসে বিখ্যাত বিজ্ঞানী লুইজি গালভানির কথা। ১৭৭০ সালে গালভানি বৈদ্যুতিক শকের মাধ্যমে একটি মৃত ব্যাঙের পেশিতে স্পন্দন সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা করেন এবং তিনি বেশ কিছু ক্ষেত্রে এই বিতর্কিত পরীক্ষায় সফল হন। একদিন এরূপ এই আড্ডায় গল্প লেখার প্রতিযোগিতা করা হলো। মেরি শেলি, কবি পার্সি শেলি, লর্ড বায়রন এবং জন পলিডরি মিলে রোমাঞ্চকর গল্প লেখার প্রতিযোগিতায় বসলেন। লর্ড বায়রন ও জন পলিডরি ভাম্পায়ারকে নিয়ে গল্প লিখলেন। কিন্তু মেরি লিখে ফেললেন মানবীয় দানবকে নিয়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন! সবাই যতটা অবাক হলেন, ততটা প্রশংসাও করলেন। এটা একটি ছোটগল্প ছিল, পরে পার্সি শেলি ও তার বন্ধুদের অনুরোধে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গল্পটি উপন্যাসে রূপ দেন মেরি। নাম ফ্রাঙ্কেনস্টাইন : দ্য

মডার্ন প্রমিথিউস।

১৮১৮ সালের ১ জানুয়ারি উপন্যাসটি বাজারে আসে। কিন্তু উপন্যাসের মলাটে শুধু ফ্রাঙ্কেনস্টাইন লেখা ছিল। লেখকের নাম দেওয়া ছিল না। মেরি শেলি কখনো এই রহস্যের খোলাসা করেননি। লেখকের নাম না থাকলেও উপন্যাসটি পাঠক সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে। লন্ডনজুড়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নিয়ে আলোচনা সমালোচনা! তখন প্রায় পাঁচ বছর পর ১৮২৩ সালে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এতেও নাম দিতে চাননি মেরি শেলি। কিন্তু পার্সি শেলি ও অন্য বন্ধুদের অনুরোধে নাম প্রকাশে বাধা দেননি তিনি! পাঠকরাও জানতে পারলো এই রোমাঞ্চকর উপন্যাসের লেখক মেরি শেলি, পার্সি শেলি নন।

১৮২২ সালে লন্ডনসহ আরো কয়েকটি শহরের বিখ্যাত থিয়েটারে মঞ্চায়িত হয় ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নাটক। এবং বিংশ শতাব্দীতে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন রুপালি পর্দায় চিত্রায়িত হয়। ১৯৩১ সালে বরিশ কার্লফের ফিল্ম ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দর্শকদের কাছে সবচেয়ে বেশি সমাদৃত হয়েছিল। মেরি শেলির ২০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিখ্যাত পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ উপন্যাসের তালিকা করেছিল। যেখানে মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দশম

স্থান দখল করে।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ছাড়াও মেরি শেলি আরো ছয়টি উপন্যাস লিখেছেন। তিনটি শিশুসাহিত্য, অসংখ্য ছোটগল্প, ফিচার, রিভিউ করেছেন। শেলির সঙ্গে ফ্রান্সে থাকাকালীন ঘটনা নিয়ে ১৮১৭ সালে ‘হিস্টোরি অব এ সিক্স উইকস ট্যুর’ নামে একটি ভ্রমণ কাহিনি প্রকাশ করেন। ১৮২৬ সালে ‘দ্য লাস্ট ম্যান’, ১৮৩০ সালে ‘লডোর’ এবং ১৮৩৭ সালে লেখা ‘ফকনার’ তার উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে অন্যতম। তার লেখা শেষ পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হচ্ছে ‘র‌্যাম্বলস ইন ইতালি অ্যান্ড জার্মানি’, যা ১৮৪৪ সালে প্রকাশিত হয়। বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী লেখা ছিল তার শখ। মেরি শেলি প্রায় ৬২ জন বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনী লিখেছিলেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close