মীম মিজান

  ১৬ আগস্ট, ২০১৯

প্রেমের ঠিকানা উজান

লু হাওয়ার মতো শাঁ শাঁ শব্দ করে বাতাস ঢুকছে বাসের ভেতর। আমি করিডোর সংলগ্ন সি-২ আসনটিতে। কান প্রায় তালা লাগা অবস্থা। ডানপাশের জানালা ঘেঁষা আসনে পঞ্চাশোর্ধ্ব একজন নারী বসেছেন। পরনে প্রিন্টের বোরকা। মাথায় বসন্তের ফুলের রঙ হলুদিয়া ওড়না। বাসের চাকার মতো গোল গোল দুটো দুল কানে। নাকে বড় আকারের নাকফুল। গোলাপি বরণের পাথর বসানো। মুখের আকারের তুলনায় নাকফুলটা বেশ বড়োসড়ো। মেছতা ও বসন্তের দাগে ভরানো গাল ও কপাল। রাজশাহী থেকে সিরাজগঞ্জ ফেরার জন্য বাসে বসে যখন এই বর্ণনা লিখছিলাম, তখন মনে পড়ে গেল হাসান আজিজুল হক স্যারের একটি গল্পের কথা। এইতো গত রাতেই স্যারের বাসায় হলো আড্ডা। সেই আড্ডায় জানতে চেয়েছিলাম তার বর্ণনা দেওয়া কাজের মেয়েটির সম্বন্ধে। স্যারের বর্ণনার হাত ও শব্দ চয়ন নিখুঁত। যাব স্যারের কাছে। বিনোদপুর থেকে চার্জিং অটো করে তার বিহাসের বাসা গন্তব্য। টিপটিপ বৃষ্টি ঝরছে। পিচের কালো রাস্তাটি ভিজে একাকার।

আমি বিহাসের গেটে নেমে দক্ষিণ দিকে জোর কদমে হাঁটছি। আকাশের প্রেমযুক্ত বৃষ্টিকণা আমার মাথার চুল, পরনের পরিচ্ছদের ওপর পড়ে হালকা ভেজা বরণ দিচ্ছে। হাতের বায়ে মোড় নিয়ে একটি বাড়ি পেরিয়ে ফুল-পাতা দ্বারা আচ্ছাদিত একটি ফটকের সামনে দাঁড়ালাম। ছোট ছোট ফুল ও পাতাগুলো কী মোহনিয়া হয়েছে বৃষ্টির পানির মুক্তোদানায়! প্রথম ছোট গেট পেরিয়ে কেচিগেটের কাছে যেয়ে উঁচু লোহার গেটটি সজোরে সরালাম, বাসার দরজা খুলে ঢুকে পড়লাম এক প্রেমের রাজ্যে। এই প্রেমরাজ্যের ছোট্ট সেই গেটের কাছে বাংলায় লেখা ‘উজান’।

আমরা জানি, সবকিছুই ভাটির টানে গড়িয়ে যায়। উজানের দিকে খুব কমজনই যাওয়ার দুঃসাহস দেখান। কারণ উজানে বা স্রোতের বিপরীতে চলা অনেক কষ্টসাধ্য। আর যিনি উজানের পথধরে এগিয়ে যেয়ে নিজেকে সফল লক্ষ্যভেদকারী নাবিক হিসেবে প্রমাণ করেছেন, তার অভিব্যক্তি কেমন হতে পারে সেটা অনুমেয়। এই সেই হাসান স্যার যিনি জীবনের ৮০ বসন্ত পেরিয়েছেন। আর তাকে দেখতে লাগে সদা প্রাণবন্ত! পক্ষান্তরে বয়সের ভারে ন্যুব্জে পড়ার কথা যার। অথচ সাহিত্যের নানা অনুষ্ঠান, আড্ডা, সাক্ষাৎকার ইত্যাদিতে প্রায়শই মশগুল থাকেন এ অশীতিপর চির যুবক। থাকেন সহাস্যমুখ। দেখে মনে হবে নেই কোনো ক্লান্তি। নেই বয়সের ভার।

তিনি যেন মাশুক বা প্রেমাষ্পদ। আর তার চারপাশে ভিড় জমান আশেক বা প্রেমিকেরা। দিনের প্রায় অধিকাংশ সময়ই এই প্রেমের ঠিকানা ‘উজান’ মুখরিত থাকে সাহিত্যরস পিয়াসুদের কলকাকলিতে। আর সবার মধ্যমণি হয়ে সেই কলকাকলিকে পূর্ণতা দেন। ক্লিনশেভ করা উঁচু নাকের মানুষটি পরেন পাঞ্জাবি আর পায়জামা। ঠাসা বইয়ের কক্ষটি তার সারা দিনের বিচরণক্ষেত্র। মাঝে মাঝে আরাম কেদারায় বসেন। সাহিত্যরস পিপাসুরা যখন আপন নীড়ে ফিরে যায় তখন তিনি বসেন কলম হাতে শাদা কাগজের জমিনে জাদুর ছোঁয়া দিতে। তার হাতের লেখনীর জাদুর ছোঁয়ায় শাদা কাগজ ভরে ভরে শব্দেরা কথা বলে। কথা বলে রাঢ় এলাকার মাটি-মানুষ। জীবন সংগ্রামে লিপ্ত জনগোষ্ঠী উচ্চকিত করে তাদের কণ্ঠ। মর্মস্পর্শ করে তার জাদুময়ী মানসের চিন্তার ফসল।

আমি তার কাছে এগিয়ে যেতেই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আরে মীম মিজান। তুমি এসেছ। আমি খুব খুশি হয়েছি।’ স্যারের বন্ধু তাওশিকুল ইসলাম রাজা ছিলেন তখন তার কক্ষে। গল্পের শুরু হলো আমার বর্তমান ঠিকানা বেলকুচি দিয়ে। বেলকুচির বিখ্যাত লুঙ্গি। এনায়েতপুরের নানা বিষয়। আমার শ্বশুরবাড়ি শাহজাদপুর। সেখানে রাবি সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. আবদুল খালেক স্যারের বাড়ি। হাসান স্যারের কর্মজীবনে সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে অধ্যাপনা, খুলনায় অধ্যাপনা ইত্যাদি বিষয়ে আলাপ হলো। আমাকে জিগ্যেস করলেন বাবা-মা সম্পর্কে। হাসান স্যারের বাবা ছিলেন একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ। তিনি তার ছেলের পড়াশোনার বিষয়ে খুবই সচেতন ছিলেন বলে স্যার বললেন।

স্যারের জন্ম তারিখ ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯। আমি বললাম, স্যার আমারও জন্মদিন আপনার পরের দিন। ‘তাই নাকি’ বলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন। ‘আচ্ছা, মীম মিজান! তুমিতো ফারসির গবেষক। দেখতো এটা কার মূর্তি?’ আমার হাতে স্যার আবক্ষ একটি মূর্তি দিলেন। সফেদ বরণ। মুখভর্তি দাড়ি। আমি দেখেই চিনে ফেললাম যে, এটি ইরানের মহাকবি হাফিজ সিরাজির। স্যার পাশের তাক থেকে একটি কফি রঙের বই আমাকে দেখিয়ে বললেন সেটি আনতে। আমি বইটি হাতে নিয়ে দেখি ‘দিওয়ানে হাফিজ’ লেখা। ফারসির ছাত্রের কাছে তিনি ফারসির মূল বই দেখিয়ে বললেন, ‘জানো, এটা কে দিয়েছে? এটা ফজলে হোসেন বাদশা দিয়েছে। সে ইরানে গিয়েছিল। সেখান থেকে আমার জন্য নিয়ে এসেছে।’

আমি একটু বাড়িয়ে গল্প পাতলাম। বলে উঠলাম স্যার, আমিও কিন্তু ২০১২ সালে ইরানে গেছিলাম। ‘ও তাই! তাহলে তো তুমি অনেক কিছু দেখেছ?’ আমার উত্তর ছিল, জি স্যার আপনাদের দোয়ায় গিয়েছিলাম। স্যার ইরানের নামাজ ও আজান সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমি সেখানখার আমার ঈদের নামাজের বিচিত্র অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম। বললাম, তারা আজানে আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ দুবার বলার পর আশহাদু আন্না আলিয়ান অলি আল্লাহ দুবার বলে। নামাজ তিনবারে পড়ে। ওজু করার সময় পায়ের মোজা না খুলেই মাসেহ করে। মাথার মাঝখানে একটু আলতো ছোঁয়া দেয়। অনেক মসজিদ ছাদখোলা।

তিনি সোৎসাহে জানতে চাইলেন ইরানের সিনেমা ও সে দেশের মেয়েদের চলাফেরা সম্পর্কে। আমি সুন্দরভাবে গুছিয়ে বললাম। ইরানিদের সিনেমা বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছে। তারা অস্কার ও কান পুরস্কার পায়। সিনেমার গল্প শেষ হতেই আমি স্যারের কাছে কিছু বিষয় জানতে চাইলাম। যেমন- তার প্রাথমিক জীবনে লেখা উপন্যাস ‘মাটি ও মানুষ’ প্রকাশ করবেন কি না? তিনি জানালেন, ‘না, না! যে পুরাতন ধাচের উপন্যাস। ওটা আর আসবে না।’

স্যারের আরাম কেদারার ডানপাশে তার বন্ধু রাজা। আর আমি বামপাশে। টোটন আপু একটি ট্রেতে করে তিন বাটি ছোলা আর একটি ছোট্ট গামলায় মুড়ি এনে দিলেন। রাজা ভাই তার ভাগের ছোলা খেয়ে ফেললেন। আমিও পেটুক খেয়ে ফেললাম গাপুসগুপুস। হাসান স্যার সম্পূর্ণ ছোলার বাটির মাত্র এক চামচ মুখে দিয়ে সেই গল্পে মশগুল। আমাদের খাওয়া শেষ। তিনি একহাতে চামচ আর অন্যহাতে ছোলার বাটি নিয়ে। ছোলার বাটিটা আমার দিকে এগিয়ে বললেন, ‘নাও তুমি খেয়ে নাও! অনেকদূর থেকে এসেছ। আর শোনো, মুড়ির বেচে যাওয়া মুড়িগুলোও তোমার। তোমায় আদর করে খেতে দিলাম। সবটুকুই খাবে।’

যিনি বর্তমান কথাসাহিত্যের গুরু। যার দ্বারা প্রতিনিধিত্ব হয় সাহিত্যের এ অন্যতম অনুষঙ্গের। তার আদর ও স্নেহাশিস পরম সম্মান ও পুলকিত হৃদে গ্রহণ করলাম। রাত গভীর হতে যাচ্ছে। আমি আর থাকতে পারলাম না। ফিরে যেতে হবে বিনোদপুরে। পরদিন সকালে বাসে করে রওনা দিই সিরাজগঞ্জের উদ্দেশে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close