মিরন মহিউদ্দীন

  ০২ আগস্ট, ২০১৯

রক্তকরবীর নন্দিনী

শ্রী প্রতাপ নারায়ণ বিশ্বাস মূলত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কতগুলো রবীন্দ্রবিষয়ক প্রবন্ধ লেখেন। পরে সেগুলো ‘রবীন্দ্রনাথ ও বিশ্বসাহিত্য’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। শ্রী বিশ্বাস তার প্রবন্ধগুলোতে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে কার্যত অস্বীকারের অভিযোগ এনেছেন। ‘রক্তকরবী’ নাটকটিকে তিনি স্ট্রিন্ডবর্গের ‘অ উৎবধস চষধু’ নাটকটির অনুকরণ করছেন। এমনকি উৎধস চষধু নাটকে চরিত্রটির অনুরূপ বলেছেন ‘নন্দিনী’কে। ‘উধঁমযঃবৎ’ ও ‘নন্দিনী’ শব্দ দুটির অর্থও যে এক, সে বিষয়েও তিনি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, প্রতাপ নারায়ণের দাবি মেনে নিলে নন্দিনীকে রবীন্দ্রনাথের আত্মজা বলা যায় না। অন্যদিকে কবি শঙ্খ ঘোষ ‘রক্তকরবী’র নন্দিনীর উৎস খুঁজতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ওই নামের একটি কবিতার কথা মনে করিয়ে দেন।

‘সে আনিয়া দেয় চিত্তে/কলনৃত্যে/দুস্তর প্রস্তর ঠেলা ফেনোচ্ছল আনন্দজাহ্নবী/বীণার তন্ত্রের মতো গতি তার সংগীতস্পন্দিনী/নাম কি নন্দিনী।’

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ১৩৩২ বৈশাখ সংখ্যায় লিখেছিলেনÑ ‘...রক্তকরবীর সমস্ত পালাটি ‘নন্দিনী’ বলে একটি মানবীর ছবি। চারিদিকের পীড়নের ভিতর দিয়ে তার আত্মপ্রকাশ।’

নাটকের মধ্যেই কবি আভাস দিয়েছেন, মাটি খুঁড়ে যে পাতালে খনিজ ধন খোঁজা হয় নন্দিনী সেখানকার নয়; মাটির উপরিতলে যেখানে প্রাণের, যেখানে রূপের মৃত্যু, যেখানে প্রেমের লীলা, নন্দিনী সেই সহজ সুখের সেই সহজ সৌন্দর্যের।

রবীন্দ্রনাথ যখন ‘রক্তকরবী’ নন্দিনীকে নির্মাণ করেছেন যেন তার চেতন বা অবচেতনে উৎবধস চষধু-এর উধঁমযঃবৎ ছিল কি না সে প্রশ্ন স্বতন্ত্র। যদি বা থেকে থাকে তা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী যে এ বাংলার মেয়ে আমাদের একান্ত আপনজন সে প্রতীতি আমাদের সহজেই আসে। নন্দিনী সহজ সুখ ও সহজ সৌন্দর্যের প্রতীক। সে সহজতা আমাদের জীবন থেকে চলে গিয়েছে। সহজতার অনুশীলন একান্তভাবে প্রয়োজনে টিকে থাকার জন্যে নয়, বেঁচে থাকার জন্যে। সে কথা বুঝেছিল রাজা। নিজের শক্তির অহংকারে রাজা নিজেকেই বন্দি করেছে। তার সে ‘বন্দিত্ব’ থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখাতে পেরেছে শুধু নন্দিনী। নন্দিনীকে আপনভাবে সবাই। নাটকের শুরুতেই আমরা দেখি ‘রক্তকরবী’ ফুল এনে দিয়ে কিশোর নন্দিনীকে বলে ‘কীসের দুঃখ’। একদিন তোর জন্যে প্রাণ দেব নন্দিনী, এই কথা কতবার মনে মনে ভাবি।’

কিশোরের সঙ্গে কথোপকথনের পরেই নাটকে অধ্যাপকের প্রবেশ ঘটে। অধ্যাপক নন্দিনীকে বর্ণনা করে যক্ষপুরের আচমকা আলো হিসেবে। অধ্যাপকের সঙ্গে কথোপকথনে আমরা বুঝতে পারি নন্দিনী এখানকার নয়। নন্দিনী এই অন্ধকারের বুকে আলোর ঝলসানি। রঞ্জনকে সে বুকে নিয়ে আছে। নন্দিনীর সংলাপেই আমরা প্রথম ‘রঞ্জন’ এবং ‘রক্তকবরী’ এই দুটি শব্দ শুনি। রঞ্জন মুক্তির অনুপ্রেরণা আর রক্তকরবী মুক্তির প্রতীক।

‘রঞ্জন আমাকে কখনো-কখনো আদর করে বলে রক্তকবরী। জানি নে আমার কেমন মনে হয়, আমার রঞ্জনের ভালোবাসার রঙ রাঙাÑ সেই রঙ গলায় পরেছি, বুকে পরেছি, হাতে পরেছি।’

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেনÑ ‘নন্দিনী সেই সহজ সুখের, সেই সহজ সৌন্দর্যের। নাটকে প্রতিটি চরিত্রের সঙ্গে সহজ আলাপচারিতা নন্দিনীর সেই সহজিয়া স্বরূপটিকে ফুটিয়ে তোলে।

নন্দিনী আমাদের কাছে আরো বেশি প্রকাশিত হয় রাজার সঙ্গে কথোপকথন সূত্রে। সমস্ত যক্ষপুরীর সঙ্গে রাজার সম্পর্ক ভয়ের। কিন্তু সহজিয়া সুরে নন্দিনী রাজাকে বলে দিতে পারেÑ ‘তুমি তো নিজেকেই জালে বেঁধেছ, তারপরে কেন এমন ছটফট করছ বুঝতে পারি নে।’

কিংবা

‘তুমি নিজেকে সবার থেকে হরণ করে রেখে বঞ্চিত করেছ সহজ হয়ে ধরা দাও না কেন?’

নন্দিনী নিজে সহজ হয়ে ধরা দিয়েছে প্রতিটি কোণে সহজ বিশ্বাসে, সে জানে রঞ্জন নিয়ে আসবে ছুটির বার্তা। রঞ্জনের কথা বলতে গিয়ে নন্দিনী আপ্লুত হয়ে পড়ে। তার স্থির বিশ্বাস রঞ্জন আসবে। কেউ তাকে আটকাতে পারবে না।

নন্দিনীকে কেন্দ্র করে ‘রক্তকরবী’ নাটকে যেন দুটি প্রেমের ত্রিভুজ অঙ্কিত হয়েছে। প্রথম ত্রিভুজটি নির্মিত নন্দিনী রাজা ও রঞ্জনকে নিয়ে। দ্বিতীয় ত্রিভুজটিতে আছে নন্দিনী রঞ্জন ও বিশু। বিশুর সঙ্গে নন্দিনীর অদ্ভুত মরমী সম্পর্ক। বিশুর গান আসে যেন নন্দিনীর উদ্দেশ্যে। বিশুকে নন্দিনী বলেছে, দুঃখটির গান তুমি গাও, আগে আমি তার খবর পাইনি।

নন্দিনীর সত্তা এমনি সহজিয়া সুরে বাঁধা যে সর্দারদের সঙ্গেও যেন তার ভাবের সম্পর্ক। সর্দারকে সে কুন্দফুলের মালা দিয়েছে। আসলে নন্দিনী এমনি এক নারী যা হৃদয়ে কারো প্রতি

বিদ্বেষ নেই।

সমস্ত ‘রক্তকরবী’ নাটকে নন্দিনী জড়িয়ে আছে। নাটকের প্রধান চরিত্রগুলোকে আমরা চিনেছি মূলত নন্দিনীর সঙ্গে কথোপকথনের সূত্রে। আর এভাবেই নন্দিনী নিজেও তার সম্পূর্ণ স্বরূপে পাঠক-দর্শকের কাছে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সহজিয়া নন্দিনী শুধু বিশু পাগলের কণ্ঠে গান জোগায় না, পরিস্থিতি সাপেক্ষে সে বিদ্রোহ জনতাকে নেতৃত্বও দিতে পারে। রাজার ঘরে রঞ্জনের মৃতদেহ দেখা নান্দনীর জীবনে চূড়ান্ত ট্র্যাজেডি। কিন্তু সেই বিপর্যের মুখে ভেঙে পড়া নয়, নন্দিনী বেছে নিয়েছে প্রতিরোধের পথ।

নন্দিনী ॥ রাজা, এই বার সময় হল।

রাজা ॥ কিসের সময়?

নন্দিনী ॥ আমার সমস্ত শক্তি নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার লড়াই।

রাজা ॥ আমার সঙ্গে লড়াই করবে তুমি। তোমাকে যে এই মুহূর্তেই মেরে ফেলতে পারি।

নন্দিনী ॥ তারপর থেকে মুহূর্তে মুহূর্তে আমার সেই মরা তোমাকে মারবে। আমার অস্ত্র নেই,

আমার অস্ত্র মৃত্যু।

নাটকের শেষে যক্ষপুরীর অচলায়তন ভাঙার অভিযানে নন্দিনী অগ্রবর্তিনী। রাজার ভাষায় ‘প্রলয়পথে আমার দীপশিখা’। ফাগুলালের পরামর্শে নন্দিনী নিজে নিরাপদ স্থানে যেতে চায়নি, বরং বলেছেÑ ‘দেখো, ওর বর্শার আগে আমার কুন্দফুলের মালা দুলিয়েছে। ঐ মালাকে আমার বুকের রক্তকরবীর রঙ করে দিয়ে যাব। Ñসর্দার আমাকে দেখতে পেয়েছে। জয় রঞ্জনের জয়।

রবীন্দ্রনাথ দাবি করেছেন নন্দিনী এক সম্পূর্ণ মানবীর ছবি। কিন্তু তার চরিত্রের গঠনটি এতটাই ত্রুটি রহিত এবং যেকোনো প্রকারের মানবীয় দুর্বলতা থেকে দূরবর্তী যে তাকে রক্তমাংসের মানবী বলার পরিবর্তে এই আইডিয়ার নাট্যরূপ বলে মনে হতেই পারে। রক্তকরবীর মতো সাংকেতিক নাটকের পরিম-লে নন্দিনীর মতো চরিত্র স্বাভাবিক। কিন্তু তাকে যদি কোনো বাস্তববাদী নাটকের পরিসরে ভাবা হয় তাহলে ঠিক ততটাই স্বাভাবিক মনে হবে না। এ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র বা চৎড়ঃধমড়হরংঃ অবশ্যই নন্দিনী। উৎবধস চষধু-এর ডক্টর চরিত্রের তুলনাতে নন্দিনীর বহুমাত্রিকতা প্রশ্নাতীত। নাটকের পরিণতিতে নন্দিনীর মৃত্যুর আভাস আছে। তাই প্রচলিত ট্র্যাজেডি তত্ত্বের নিরিখে নাটকটিতে ঝযব ঃৎধমবফু বলা যেতেই পারত। কিন্তু রক্তকরবীর মতো সাংকেতিক নাটকের মৃত্যু কোনো পতন নয় বরং ভিন্ন ব্যঞ্জনায় রঞ্জিত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close