শরাফত হোসেন

  ০২ আগস্ট, ২০১৯

মহাদেব সাহার কবিতা

সৌন্দর্যচেতনা ও সম্প্রীতির প্রেরণা

জীবনবোধ ও সৌন্দর্যচেতনায় দীক্ষিত মহাদেব সাহা বাংলা কবিতায় বোধদীপ্ত চেতনার স্ফুরণ ঘটিয়েছেন। মানবতা যার মূল প্রেরণা। কবিতার শব্দ নির্বাচনে মহাদেব সাহা ভীষণ সচেতন, খুঁত খুঁতে স্বভাবের, শব্দপ্রয়োগে পুনর্বিবেচনা করেন কবি। ভাবেন বাক্যে শব্দটি কতটা উপযোগী, এর চাইতে গ্রহণযোগ্য শব্দ আর হতে পারে কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে তার কাব্যভাষা লাভ করেছে স্বতন্ত্ররূপ। লাবণ্য এবং সৌন্দর্যকে ধারণ করে আছে তার কবিতা। মহাদেব সাহা এত প্রেমের কবিতা লিখেছেন, তবু যৌনাক্রান্ত শব্দের ব্যবহার নেই তার কবিতার পঙ্তিতে। কবিতায় তিনি যখন সঙ্গম শব্দটি ব্যবহার করেন, এর সঙ্গেই জুড়ে দেন সৎকার, প্রেম ইত্যাদি শব্দ। এখানেই তার বোধ-বোধি, চিন্তা-দর্শন ও মন-মননের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

নবীনের প্রতি কবির অগাধ আস্থা ও ভালোবাসা, এই ভালোবাসা নারীর প্রতি, মানুষের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি। দায়বোধ থেকেই কবিতার ভাষা ও বিষয়বস্তু নির্বাচন করেন তিনি। মহাদেব সাহা তার সমগ্র জীবন কবিতার ধ্যানে মগ্ন থেকেছেন মন-প্রাণ উজাড় করে দিয়ে, সাধনা করেছেন, এখনো করছেন সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে, ডুবে থেকে রচনা

করেছেন কবিতা।

কবি হওয়া যায় না, হয়ে ওঠে। মহাদেব সাহা কবি হয়ে ওঠেছেন। শীলন ও সাধনায় আধুনিক বাংলা কবিতায় তিনি স্বীয় অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। জয় করেছেন অগণিত পাঠকহৃদয়। তার বইয়ের নামকরণ খেয়াল করলেই বোঝা যায় কবির চিন্তা-দর্শন, কেন তিনি আলাদা। তার প্রথম কবিতার বই ‘এই গৃহ এই সন্নাস’ সময়েরই প্রতিরূপ। এরপর একে একে ‘মানব এসেছি কাছে’, ‘চাই বিষ অমরতা’, কী সুন্দর অন্ধ’, ‘ধুলোমাটির মানুষ’, ‘ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস’, ‘লাজুক লিরিক’, ‘আমূল বদলে দাও আমার জীবন’, ‘অন্তহীন নৃত্যের মহরা’, ‘একবার নিজের কাছে যাই’, ‘পাতার ঘোমটা-পরা বাড়ি’, ‘স্বপ্নে আঁকি সুন্দরের মুখ’, ‘বহুদিন ভালোবাসাহীন’, ‘সব দুঃখ ভুলে যাই প্রেমের গৌরবে’, ‘সোনালি ডানার মেঘ’, ‘শুকনো পাতার স্বপ্নগাথা’, ‘দুঃসময়ের সঙ্গে হেঁটে যাই’, ‘সন্ধ্যার লিরিক’, ‘অন্ধের আঙুলে এত জাদু’, ‘অক্ষরে বোনা স্বপ্ন’, ‘মাটির মলাট’Ñ এ-ই মহাদেব সাহা। কবির অনুভূতি অতি সূক্ষ, তার কবিতায় স্বপ্ন ও জিজ্ঞাসার ছাপ থাকে, পড়তে পড়তে টের পাওয়া স্পন্দন, শব্দের ব্যঞ্জনার ফলে হৃদয় মিশে থাকে মহাদেব সাহার কবিতায়, পাঠক হিসেবে আমাকে

আচ্ছন্ন করে।

ব্যক্তিজীবনে মহাদেব সাহা প্রচ- আবেগী, অভিমানীও বটে। সামান্যেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন, উদ্বেল হয়ে ওঠে তার হৃদয়, সে-তো কবিরই হৃদয়। অভিমান আবার আক্ষেপও কিছুটা। জীবনের ছন্দ নানা দ্বন্দ্বের বেড়াজালে জৌলস হারায়। আবার ছোট ছোট স্বপ্নে নান্দনিক আখ্যান, কবিতা তো জীবনেরই নান্দনিক প্রকাশ। এ রকম রূপায়ণই দেখি তার ‘এইসব গল্পগাথা’ কবিতায় ‘কতদিন দগ্ধ অনুভূতি নিয়ে গেছি আমি/মানুষের কাছে, মানুষ বোঝেনি/আমার চোখের দিকে চেয়ে কেউ বোঝেনি কিছুই/কেউ বলেনি এমন কোনো সান্ত¦নার বাণী,/...মানুষ বুঝেও ঠিক কিছুই বোঝে না/এই সব গল্পগাথা, দুঃখ-ভালোবাসা।’

মহাদেব সাহার কবিতা তার জীবনেরই প্রতিরূপ। তিনি জীবন থেকে গ্রহণ করেন কবিতার বিষয়বস্তু, শব্দ। ফলে কবিতা হয়ে ওঠে জীবন্ত। স্বচ্ছ আয়নার মতো, পাঠক জীবনের ছোট ছোট খ-চিত্র পর্যবেক্ষণ করে কবিতায়, হাতরে বেড়ায় স্মৃতির জলসাঘর। আশাহত সময় প্রাণ ফিরে পায়, হতাশার চিত্র উজ্জল হয়ে ওঠে, আবার আত্মবিশ্বাসী কবি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হন, ‘যত দুঃখ দেবে’ কবিতায় ‘ভেবো না দুঃখ দিলে আমি কোনো ফুল ফোটাবো না/ভেবো না আঘাত দিলে আমি কোনো কবিতা লিখবো না,/আমাকে দুঃখ দেবে আমি তাতে পরাস্ত হবো না/যত দুঃখ দেবে আমি ততো লিখবো কবিতা।’ বাস্তবতাও তাই বলে। সমস্ত জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন কবিতাকে ভালোবেসে, সমর্পণ করেছেন, সমর্পিত হয়েছেন কিন্তু আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি কখনোই। কবিতাকে আঁকড়ে থেকেছেন, আপস করে নয়, লড়াই করে। অনাহুত দুঃখের মাঝেও মহাদেব সাহা ডুবে থেকেছেন কবিতা সৌন্দর্যে।

‘অন্তর ভালো না, পুষ্প ভালো না’ কবিতায় সহজ উচ্চারণ ‘ভালো, তোমাদের সবকিছু ভালো,/শরীর স্বাস্থ্য ভালো, বেশভূষা ভালো/কথা ভালো, ততোধিক কপটতা ভালো,/কিন্তু হৃদয় ভালো না, কিছুতেই না।’ আবার ‘সত্যভঙ্গ করেছে মানুষ’ কবিতায় ‘মানুষের হাত আজ কলঙ্কিত করেছে মানুষ/তুমি আর সেই হাতে জলস্পর্শ কখনো করো না,/মানুষ মেখেছে রক্ত, মানুষ ধরেছে বিষফণা/এই হাতে গোলাপ স্পর্শ আর করো না, করো না/মানুষের চোখ আজ কলুষিত করেছে মানুষ/...সত্যভঙ্গ করেছে মানুষ, মানুষ করেছে প্রতারণা/এই মুখে ভালোবাসি উচ্চারণ করো না, করো না’। প্রতারক আজ সমাজ প্রভাবিত করছে, করছে কলুষিত। ফলে এই সময়ে মানুষে মানুষে অবিশ্বাস কেবল বেড়েই চলেছে, যুক্তিহীন, সমাধানহীন। কবিহৃদয় এতে ব্যতিব্যস্ত, ব্যাকুল-সত্যসঙ্গ খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত। পরিশ্রান্ত মন নিয়েও লিখে চলেছেন কবিতা। কবিতায় তুলে ধরছেন অসংগতির কথা, মানুষের স্বপ্ন, বাস্তবতার কথা। নিরন্তর আলোক হাতে ছুটে বেড়ান হৃদয় হতে হৃদয়ে। সুন্দরের ছোঁয়ায় প্রাণ সঞ্চার করেন, নান্দনিকতায় বিমুগ্ধ হন নিজেও।

মহাদেব সাহা সমাজ সচেতন, রাজনীতি সচেতনও। কবিতায় তিনি যেমন সমাজের অসংগতি, মানুষের নৈতিক স্খলন ইত্যাদি চিত্রিত করেছেন, তেমনি সহজ-সরল ঢঙে রচিত তার রাজনৈতিক কবিতাগুলি পাঠে স্বদেশের প্রতি কবির ভালোবাসা, স্বজাতির মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, সমাজ ভাবনা ও রাজনীতি সচেতনতা সহজেই অনুমেয়। দেশভাবনা প্রবলভাবে ঘিরে আছে এই কবিকে। তিনি নিজেই বলেন, ‘আমি পৃথিবীর

বিভিন্ন শহরে গেছি, কিন্তু ঢাকার আকাশ ছাড়া আমি কবিতা লিখতে পারি না’। স্বৈরাচার, সামরিক শাসন-নির্যাতন, মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির রাজনৈতিক উত্থান, জনকহত্যা, রাষ্ট্রের সংকটময় সময়, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, মূল্যবোধের অবক্ষয় নানা অসংগতি চিত্রিত করেছেন কবিতায় শিল্পগুণ অক্ষুণœ রেখে। আপদমস্তক কবি বলেই সম্ভব হয়েছে বিষয়গুলোর চমৎকার চিত্রায়ণ। সহজ-সরল প্রাঞ্জল ভাষার কবিতাগুলো পাঠে পাঠকহৃদয় অশ্রুসিক্ত আবেগী হয়ে ওঠেন, কখনো হয়ে ওঠেন প্রতিবাদী। ‘অন্ধ’ কবিতায় তার সোচ্চার উচ্চারণ ‘আমরা এমনি অন্ধ কিছুই দেখি না!’ আবার তিনি এ-ও বলেন, ‘আরো কত নত হলো ফুল আর কত বিদ্ধ হলো পাখি/আরো কত আহত হলো ওরা,/...আরো কত পাখির পালক ঝরার শব্দে উঠে গেল গ্রাম/দেখো পাখি ও প্রকৃতির মতো শুদ্ধ আরো কত মানুষ লুকালো।’ (কল্যাণকুশল হন্তা তোমাদের)।

‘ওরা আহত মানুষ ওরা’ কবিতায় ‘কিছু চেয়ো না মানুষ এমনি সেরে উঠুক/মানুষ উঠে দাঁড়াক আবার’। মহাদেব সাহার কবিতার মর্মে মর্মে গাথা আছে পুনর্জাগরণের আহ্বান। ‘দেশপ্রেম’, ‘তোমার জন্য’, ‘স্বাধীনতার প্রতি’, ‘একদিন এই ঢাকা’, ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই’, ‘এই দুঃখী পাখি ও মানুষ’, ‘তারা বন্দি কেন’, ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘সেই কবিতাটি লেখা হয় নাই’, ‘জুঁইফুলের চেয়ে শাদা ভাতই অধিক সুন্দর’, ‘আফ্রিকা তোমার দুঃখ বুঝি’, ‘অস্ত্র নয় ফুলই আজ অধিক জরুরি’, ‘যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমি’, ‘অস্ত্র নয়, অহংকার নয়’, ‘ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস’, ‘কী যেন বলতে চায় বন্দি স্বদেশ’Ñ এসব কবিতায় বারবার প্রতিধ্বনিত জীবন, জীবনের সুধা-গন্ধ সংকট ও উত্তরণের গল্প ছড়িয়ে আছে। এ-ই মহাদেব সাহার কবিতার সার্থকতা, কবি হিসেবে মহাদেব সাহার সার্থকতা।

দেশপ্রেম, রাজনীতিনিষ্ঠা মানুষের মুক্তির সরল পথÑ এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন মহাদেব সাহা। সেই বিশ্বাস কবিতার মাধ্যমে মানুষের মনে প্রবাহের চেষ্টা করেছেন নিরলস। এই চেষ্টা মানুষের মুক্তির চেষ্টা, কল্যাণের চেষ্টা। ভালোবাসায় অসম্ভবকেও জয় করা যায়, পাঠকের মনে এই বিশ্বাস সঞ্চার করেছেন কবিতার মাধ্যমে। তার কবিতা পাঠে একজন পাঠক আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরে আসতে পারে, এ রকম বাস্তব উদাহরণও আছে। মানুষের অসহায়ত্ব কবিকে বিচলিত করে তুলে, ‘মানুষের বুকে কেন মমত্ব দেখি না’ কবিতায় লিখেছেন, ‘আজ কেন এত হত্যা দেখি, রক্তপাত দেখি, চোখে কোনো অশ্রু দেখি না’। ব্যক্তি-অস্তিত্বের প্রসঙ্গ মহাদেব সাহা কবিতায় যেরূপে চিত্রিত করেছেন, সেখানে সমষ্টির চেতনাও সমানরূপে উপস্থিত। স্বদেশ ও ঐতিহ্য, জাতির শৌর্যবীর্য আর সংগ্রামী চেতনা স্পর্শ করে তার কবিতা, ফলে কবিতা মানব-হৃদয়ে উদ্দীপনা জাগায়, সম্প্রীতির প্রেরণা জোগায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close