সোহেল নওরোজ

  ১৯ জুলাই, ২০১৯

হুমায়ূন আহমেদের অদ্ভুত কাণ্ড

আমেরিকায় পিএইচডি করার শুরুতে হুমায়ূন আহমেদ বেশ অর্থকষ্টে ছিলেন। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। এমন সময় তার বড় মেয়ের জন্মদিন চলে এলো। তারিখটা বেকায়দা ধরনের। ২৮ আগস্ট। মাসের শেষ দিকে। বেতনের চেক পেতে আরো তিন দিন লাগবে। হাতের সব ডলার শেষ। মেয়ের মার মেয়ের প্রথম জন্মদিন নিয়ে নানা পরিকল্পনা। হুমায়ূন আহমেদ উপহার হিসেবে কিনে নিয়ে এলেন দুই কেজি ময়দা। মেয়ে ময়দা ছানতে পছন্দ করে। তিনি প্যাকেট খুলে মেয়ের চারপাশে ময়দা বিছিয়ে দিলেন। সে মহা-আনন্দে দুই হাতে ময়দা ছানাছানি করতে লাগল। সে যতই আনন্দে হাসে, মেয়ের মা ততই দুঃখে কাঁদে। মেয়ের প্রথম জন্মদিনে বাবা দিল দুই কেজি ময়দা!

দুই.

মুহসিন হলে থাকাকালীন ঘটনা। এক রাতে হঠাৎ হইচই শুরু হলো। ঘটনা কী?

ঘটনা জটিল এবং অবিশ্বাস্য। হুমায়ূন আহমেদকে হলের একটি ছেলে খুব বিরক্ত করত। শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি ছেলেটিকে জাদুর মাধ্যমে চেয়ারের সঙ্গে আটকে দিয়েছেন। ছেলেটি আর নড়াচড়া করতে পারছে না, কথাও বলতে পারছে না। জড় পদার্থের মতো সে চেয়ারে বসে আছে।

খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে হাউস টিউটর এলেন। এ দৃশ্য দেখে তিনিও কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

অবশেষে ছেলেটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলো। ইনজেকশন দেওয়ার পর ছেলেটির

চৈতন্য ফিরল।

আসল ঘটনা হলো, ছেলেটির পীড়াপীড়িতে হুমায়ূন আহমেদ তাকে হিপনোটাইজ করেছিলেন। এটাই তার প্রথম এক্সপেরিমেন্ট। কিন্তু এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার উপায় না জানা থাকার কারণে এমন কা-!

তিন.

এক সাংবাদিক হুমায়ূন আহমেদের ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন।

: সুনীলদার ‘পূর্বপশ্চিম’ পড়েছেন?

: পড়েছি।

: আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে তিনি এত বড় একটা কাজ করে ফেললেন। আপনি পারলেন না কেন?

: তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধ দেখেননি বলে লেখাটা তার জন্য

সহজ হয়েছে।

: না দেখলে লেখা সহজ!

: অবশ্যই। মীর মোশাররফ হোসেন কারবালার যুদ্ধ দেখেননি বলে ‘বিষাদসিন্ধু’ লিখে ফেলতে পেরেছেন।

: আপনার কিন্তু উচিত ‘পূর্বপশ্চিম’-এর মতো একটা উপন্যাস লেখা।

: ভাবছি লিখব। নামও ঠিক করে ফেলেছি।

: কী নাম?

: নামটা একটু বড়। ‘পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ,

ঊর্ধŸ-অধ্ব’।

চার.

হুমায়ূন আহমেদ প্লেনে করে দেশের বাইরে যাচ্ছেন।

ওনার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস সম্পর্কে তো কম বেশি সবারই জানা আছে। প্লেনের মধ্যে হঠাৎ তার সিগারেট খাওয়ার নেশা চেপে বসল।

হুমায়ূন আহমেদ এয়ার হোস্টেসকে ডেকে বললেন, ‘সিগারেট খাওয়া যাবে?’

এয়ার হোস্টেস উত্তরে বললেন, ‘না। প্লেনের ভেতর ধূমপান করলে ২০০ ডলার ফাইন।’

হুমায়ূন আহমেদ ৪০০ ডলার দিয়ে বললেন, ‘আমি এখন দুটা সিগারেট খাব।’

এয়ার হোস্টেস ছুটে গেল পাইলটের কাছে। পরে পাইলট হুমায়ূন আহমেদকে ডেকে পাঠালেন ককপিটে। তার পর বললেন, ‘ডলার দিতে হবে না। তুমি এখানে বসে

সিগারেট খাও।’

পাঁচ.

হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্র বানাবেন। ‘আগুনের পরশমণি’-এর প্রধান চরিত্র বদিউল আলমকে খুঁজছেন। এক দিন শিল্পী ধ্রুব এষকে দেখে তিনি সেই চরিত্রের জন্য তাকে পছন্দ করে ফেললেন। কারণ, বদিউল আলমের নির্লিপ্ত ভঙ্গি ধ্রুব এষের মধ্যে পুরোপুরিই আছে।

প্রস্তাব শুনে ধ্রুব এষ বললেন, ‘অসম্ভব! আমি জীবনে অভিনয় করিনি।’

হুমায়ূন আহমেদ মুচকি হেসে বললেন, ‘তাতে কী! আমিও তো জীবনে সিনেমা বানাইনি!’

ছয়.

এক দিন এক যুবক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে এলো। যুবকের হাতের লেখা অবিকল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো। সে কিছু নমুনাও নিয়ে এলো। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, দেশ পত্রিকার সাগরময় ঘোষ তোমাকে পেলে লুফে নিতেন। একের পর এক রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত চিঠি প্রকাশ করতেন। যুবককে দিয়ে তিনি নিজের জন্য রবীন্দ্রনাথের একটা সার্টিফিকেট লিখিয়ে নিলেন।

সেখানে লেখাÑ

শ্রীমান হুমায়ূন আহমেদ,

তোমার কিছু রচনা পাঠ করিয়া বিমলানন্দ পাইয়াছি।

তোমার কিছু শব্দের বানান বিষয়ে আমার কথা আছে।

সাক্ষাতে বলিব।

ইতি

শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সাত.

শিরীন নামে এক মেয়েকে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার একটা গল্প শুনিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তারপর থেকে যেখানেই তার সঙ্গে দেখা হতো, সে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ত এবং বলত, ওই গল্পটা আরেকবার বলেন, প্লিজ।

সেই সময়কার কথা, নিতান্ত উপায়ান্তর না দেখে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ব্লাডারের প্রেসার কমাচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ, মনে মনে প্রার্থনা করছেন যেন পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা না হয়। ঠিক তখন তার পেছনে একটা রিকশা থামল। হুমায়ূনের বুক ধক করে উঠল। শিরীনের আদুরে গলা, হুমায়ূন ভাই, এখানে কী করছেন? দ্রুত জিপার লাগাতে গিয়ে আরেকটা অ্যাকসিডেন্ট হলো। তবু ফ্যাকাশে হেসে বললেন, তারপর কী খবর, ভালো তো?

শিরীন বলল, এ হচ্ছে আমার বান্ধবী লোপা। আপনি একে ওই গল্পটা বলেন তো।

সেই থেকে তিনি রসিকতা ছেড়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। যে কাজে হুমায়ূন আহমেদ পুরোপুরি

ব্যর্থ বলাই যায়।

আট.

সালেহ চৌধুরীকে হুমায়ূন আহমেদ নানাজান বলে ডাকতেন। একসময় ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁক ছিল সালেহ চৌধুরীর। খেয়াল চাপলে অনেকের পার্শ্বপ্রতিকৃতি দ্রুত আঁচড়ে এঁকে নিতেন। আদলটা অন্তত অনেক সময়ই এসে যেত। বইমেলায় সব্যসাচী স্টলে তিনি আড্ডা দিচ্ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে। একসময় সস্ত্রীক রফিক আজাদ হাজির হলেন। সালেহ চৌধুরী তার ছবি আঁকতে উদ্যত হলেন। হুমায়ূন আহমেদ হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে রফিক আজাদকে লক্ষ্য করে বলে উঠলেন, ‘কবি, নানাজি আপনার ছবি আঁকতে যাচ্ছেন। আপনার জেনে রাখা দরকার, উনি মন্দ আঁকেন না। তবে যাদের ছবি উনি আঁকেন তারা কিছুদিনের মধ্যেই মারা যান।’ কবি দম্পতি সবে বসতে যাচ্ছিলেন। হুমায়ূনের কথা শেষ হতেই কবির স্ত্রী স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরে দ্রুত ওখান থেকে প্রস্থান করলেন। অন্যরা হাসিতে ফেটে পড়লেন। একটা বিদেশি ভৌতিক গল্প আছেÑ একজন চিত্রকর যাদের ছবি আঁকেন তারা অচিরেই মারা যায়। কিংবা চিত্রকর তাদেরই ছবি আঁকেন যাদের মৃত্যু আসন্ন। চমৎকার গল্প। গল্পটা হয়তো হুমায়ূন আহমেদের পড়া ছিল। রস সৃষ্টির উপলক্ষে ভৌতিক গল্পকে তিনি হাসির উপাদান করে নিলেন।

নয়.

হুমায়ূন আহমেদ তার বড় মেয়ের বিয়েতে বিশেষ কোনো উপহার দিতে চেয়েছিলেন। শাড়ি, গহনা, ফ্রিজ, টিভির বাইরে কিছু। কী দেবেন তা নিয়ে ভাবতে লাগলেন। নোভার অতি প্রিয় লেখকের নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, নোভার বিয়ের আসরে তার প্রিয় লেখককে হাজির করাবেন। এই উপহারটি হয়তো তার পছন্দ হবে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং তার স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়কে নিমন্ত্রণ জানালেন। তাদের জানালেন, মেয়ের বিয়েতে গিফট হিসেবে তাদেরকে প্রয়োজন। হুমায়ূন আহমেকে অবাক করে দিয়ে দুজনেই চলে এলেন। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি বিয়ের আসরে উপস্থিত হলেন। নোভা তার বরকে নিয়ে স্টেজে বসেছিল। বিয়ের এবং উৎসবের উত্তেজনায় সে খানিকটা দিশাহারা। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, মা তোমার বিয়ের গিফট দেখে যাও। নোভা তার অতি প্রিয় লেখককে বিয়ের আসরে উপস্থিত দেখে চমকে উঠল।

মানুষকে চমকে দেওয়ার বিশেষ ক্ষমতা হুমায়ূন আহমেদের মধ্যে বরাবরই ছিল।

দশ.

পিএইচডি শেষ করে হুমায়ূন আহমেদ দেশে ফিরেছেন। পুরোদমে লেখালেখি করছেন। তার অনেকগুলো বই বের হয়ে গেছে। পত্রপত্রিকায় ইন্টারভিউ দিতে তিনি খুবই আগ্রহী। কিন্তু কেউ ইন্টারভিউ নিতে আসে না। হঠাৎ বিচিত্রা পত্রিকা থেকে ডাক পেলেন। তাকে এবং সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে তারা একটা কভার স্টোরি করতে চাচ্ছে। দেশের প্রধান ঔপন্যাসিকের সঙ্গে তরুণ ঔপন্যাসিকের কথোপকথন। তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে রাজি হলেন।

কথোপকথন শুরু হলো। মডারেটর ছিলেন আরেক ঔপন্যাসিক মঈনুল আহসান সাবের। সৈয়দ শামসুল হক হুমায়ূন আহমেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, হুমায়ূন, বলুন তো আপনার লেখাগুলো সব সময় ফর্মা হিসেবে বের হয় কেন? এরচেয়ে বড়ও হয় না, কমও হয় না। কারণটা কী?

হুমায়ূন আহমেদ সৈয়দ হককে বললেন, হক ভাই, আপনি তো সনেট লেখেন। সনেটগুলো ১৪ লাইনে শেষ হতে হয়। আপনি যদি আপনার ভাবনা নির্দিষ্ট ১৪ লাইনে শেষ করতে পারেন, আমি কেন আমার ভাবনা ফর্মা হিসেবে শেষ করতে পারব না?

সৈয়দ শামসুল হক খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন। এই উত্তর তিনি আশা করেননি। হুমায়ূন আহমেদ অবশ্য পরে স্বীকার করেছেন, সৈয়দ হককে তিনি প্যাঁচে ফেলতে চাননি। সৈয়দ হক যে প্যাঁচ তৈরি করেছিলেন, তার ভেতর থেকে তিনি বের হতে চেয়েছিলেন।

সূত্র : হুমায়ূন আহমেদের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ বলপয়েন্ট, কাঠপেন্সিল, ফাউন্টেনপেন, বসন্ত বিলাপ ও হুমায়ূন আহমেদ স্মারকগ্রন্থ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close