আবদুস সালাম

  ২৮ জুন, ২০১৯

গল্প

দেয়াল

আসলাম হোসেন আর মজিদ মিয়া একই গ্রামে বসবাস করেন। তাদের বসবাসের বাড়ি পাশাপাশি। দুই বাড়ির মাঝে রয়েছে একটি দেয়াল। আসলাম হোসেনের এক ছেলে এক মেয়ে। মজিদ মিয়ার দুই মেয়ে। দুই পরিবারের আত্মীয়স্বজনের সংখ্যা অনেক। বলতে গেলে আত্মীয়স্বজন একই গ্রামে বসবাস করেন। আসলাম হোসেন গ্রামের বেসরকারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। পাশাপাশি রাজনীতিও করেন। তবে তিনি গ্রামে মাস্টার সাহেব নামে পরিচিত। আসলাম সাহেব বেশ কয়েকবার ইউপি চেয়ারম্যান ভোটে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু পাস করেননি। কারণ প্রতিবারই তার বিপক্ষে মজিদ মিয়া ভোটে দাঁড়ান। এক গ্রাম থেকে দুজন ভোটে দাঁড়ানোর কারণে গ্রামের ভোট দুই ভাগ হয়ে যায়। ফলে পাশের গ্রাম থেকে অন্য কেউ চেয়ারম্যান ভোটে পাস করে যান।

এদিকে মজিদ মিয়া গ্রামের বেশ প্রভাবশালী। তার কথায় অনেকে ওঠে-বসে। গ্রাম ও শহরে তার ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। বেশ টাকা-পয়সারও মালিক। মজিদ মিয়া অনেক দিন আগে একবার ইউপি চেয়ারম্যান ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারপর থেকে গ্রামের লোকজন তাকে চেয়ারম্যান সাহেব বলেই চেনেন। মজিদ চেয়ারম্যান নামেই পরিচিত। আসলাম হোসেনের বড় ছেলে সোহেল আর মজিদ মিয়ার বড় মেয়ে মৌসুমী একই স্কুলে পড়ালেখা করেছে। এখন তারা কলেজে পড়ে। একে অপরকে পছন্দ করে। পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে সম্পর্কটা তেমন করে গড়ে ওঠেনি। স্কুলে তাদের মধ্যে দু-একটি কথা বিনিময় হলেও বাড়িতে অবস্থানকালে কখনো একে অপরের সঙ্গে কথা বলার সাহস দেখায়নি। সোহেল এক দিন মৌসুমীর সঙ্গে পাশাপাশি হেঁটে কলেজে যাচ্ছিল। ঠিক তখন মৌসুমীর বাবা দেখে ফেলেন। এতে তার বাবা এতটাই রেগে যান যে, মৌসুমীর গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করেননি। এদিকে আসলাম হোসেনেরও কড়া নিষেধ ছিল সোহেল যেন মৌসুমীর সঙ্গে কথা না বলে।

গ্রামের যেসব লোক চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশত তারা আবার মাস্টার সাহেবের সঙ্গে তেমনভাবে মিশত না। কার্যত বলা যায়, গ্রামের লোক দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। গ্রামে কোনো ক্ষয়ক্ষতি বা চুরি ডাকাতি হলে একপক্ষ অপর পক্ষের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করত। এভাবে পারিবারিক দ্বন্দ্ব বেশ কয়েক বছর ধরে চলতে থাকে। এর ফলে গ্রামবাসী প্রায়ই বিপদে পড়ত। কিন্তু তাদের কিছুই করার ছিল না। কোনো না কোনো পক্ষকে সমর্থন করতেই হতো। নিরপেক্ষ থাকলে তারা তেমন সুবিধা পেত না।

আসলাম হোসেনের বড় ছেলে সোহেল বর্তমানে ডিগ্রি শেষবর্ষের ছাত্র। আর একই কলেজে মজিদ মিয়ার মেয়ে মৌসুমী এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তাদের মধ্যে গোপনে প্রায়ই দেখা সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হয়। কলেজ ছুটির পর তারা যে যার মতো বাড়িতে চলে যায়। সম্পর্কটা দিনে দিনে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। এই সম্পর্কের বিষয়টি দুই পরিবারের কেউই জানতে পারল না।

মৌসুমী যেমন সুন্দরী তেমনি মেধাবী। তার এখন প্রায়ই বড় বড় জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু মৌসুমী বিয়েতে রাজি হয় না। বাবাও চায় মেয়ে ভালোভাবে পড়াশোনা শেষ করুক। বিয়ের বিষয়ে মৌসুমীর ওপর চাপ রয়েছে তা সোহেলের জানা ছিল। কিন্তু সোহেলের পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না মৌসুমীকে বিয়ে করা। আর বাবা যদি জানতে পারে, সোহেলের সঙ্গে মৌসুমীর সম্পর্ক রয়েছে তা হলে আর রক্ষা নেই। তাকে বাড়িছাড়া করবে। কিন্তু তাদের কী করা উচিত, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এভাবে আরো

কিছুদিন চলে গেল।

সামনের বছর গ্রামে ইউনিয়ন পরিষদের ভোট হবে। আগে থেকেই আসলাম হোসেন এবং মজিদ মিয়া নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে গ্রামের লোকজন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। সুযোগমতো নির্বাচনের প্রচারণা চালাচ্ছে। যেভাবেই হোক ভোটে জিততে হবে। প্রয়োজনে তারা এর জন্য প্রচুর টাকা-পয়সা খরচ করতেও প্রস্তুত আছে।

এক দিন সোহেল ও মৌসুমী তাদের বাবাদের প্রতিযোগিতার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করল। এটা কীভাবে নির্মূল করা যায়, তার একটা উপায় বের করার চেষ্টা করল। অবশেষে তারা মনে করল, আমাদের বিয়েই হতে পারে একমাত্র সমাধানের উপায়। বাবা-মা রাজি হোক বা না হোক তারা একা একা বিয়ে করে ফেলবে। তবে একা একা বিয়ে করার আগে তারা চেষ্টা করবে পারিবারিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বিষয়টি সুরাহা করা যায় কি না। এক দিন সোহেল সাহস করে তার বাবাকে বলল, ‘আমি মৌসুমীকে ভালোবাসি। তাকে বিয়ে করতে চাই। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানালে খুশি হব।’ ছেলের কথা শুনে আসলাম হোসেন খুব রেগে যান। তিনি এ বিয়ে কখনো মেনে নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, মজিদ মিয়াকেও সাবধান করে দেন। মৌসুমী যেন কোনোভাবেই সোহেলকে বিয়ে করার চেষ্টা না করে। মজিদ মিয়া সবকিছু জেনে মৌসুমীকে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেন এবং তাকে কড়া নজরে রাখেন। সে যেন কোনোরকমে সোহেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে।

এভাবে আরো দু-এক মাস চলে গেল। এরমধ্যে শহরের এক উচ্চ বংশীয় পরিবারের ছেলের সঙ্গে মৌসুমীর বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। কিছুদিনের মধ্যে ছেলেপক্ষের লোকজন মৌসুমীকে দেখতে আসার কথা। মেয়ে পছন্দ হলে বিয়ে হয়ে যাবে। এই খবরটি মৌসুমী কৌশলে সোহেলকে জানিয়ে দিল। সোহেলও মৌসুমীকে একা একা বিয়ে করার প্রস্তুতি নিতে বলল। মৌসুমী তাতে রাজিও হলো। তারপর সুযোগমতো তারা এক দিন পালিয়ে বিয়ে করে ফেলল। বাবা-মা আত্মীয়স্বজন ছেড়ে তাদের চলে যেতে হলো সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা এক জায়গায়। নব দম্পতি যে জায়গায় বাসাভাড়া করে থাকে, তা পাশের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের রহিম স্যার জানতেন।

মৌসুমী ও সোহেলের এভাবে বিয়ে করায় দুই পরিবারের মাথা হেট হয়ে গেল। নিজ গ্রাম এবং আশপাশের গ্রামের লোকজনও বিষয়টি জেনে গেল। অনেকে এটি নিয়ে হাসাহাসি করল। আবার অনেকে খুশিও হলো। সোহেল ও মৌসুমী দুজনে ছিল রহিম স্যারের ছাত্রছাত্রী। পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় তিনি তাদেরকে খুব ভালোবাসতেন। তাদের বাবা আসলাম হোসেন ও মজিদ মিয়াকেও ভালোভাবে চিনতেন। রহিম স্যার গ্রামের কয়েকজন গণ্যমান্য লোক নিয়ে দুই পরিবারের সঙ্গে সমঝোতার জন্য চেষ্টা করলেন। এতে তারা সফলও হলেন। উভয়পক্ষ ছেলেমেয়ের বিয়ে মেনে নিল এবং তাদের বিয়ে বাজানোর জন্য দিন-তারিখও ধার্য করল।

বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানে গ্রামের সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হলো। অনুষ্ঠানের আগের দিন দুই বাড়ির মাঝে যে দেয়াল ছিল, তা দুই পক্ষের আত্মীয়স্বজন ভেঙে দিল। এই বিয়ের মাধ্যমে দুই পরিবারের দীর্ঘদিনের বৈরী সম্পর্কের অবসান ঘটল। আর গ্রামবাসীর মধ্যে যেসব ভেদাভেদ ছিল, তা দূর হলো। গ্রামবাসী আবার একসঙ্গে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে শুরু করল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close