সাইফুদ্দিন সাইফুল

  ২১ জুন, ২০১৯

স্বপ্নবাদী কবি সমুদ্র গুপ্ত

সদা প্রাণোচ্ছল মানুষ ‘রোদ ঝলসানো মুখ’-এর কবি সমুদ্র গুপ্ত। ‘শেকড়ের খোঁজে’-এর একজন কবির নাম সমুদ্র গুপ্ত। অন্যতম শক্তিমান কবি সমুদ্র গুপ্ত। তিনি ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কবিতা গল্প সমালোচনা প্রবন্ধ নিবন্ধ সাহিত্যবিষয়ক বৈচিত্র্যময় সৃজনশীল রচনা লেখালেখি শুরু করেন। সেই সময়ে নিজেকে সাহিত্যাকাশে এক উজ্জ্বল কবি নক্ষত্র হিসেবে স্থান করে নেন। সমুদ্র গুপ্ত মূলত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রোদ ঝলসানো মুখ’ ১৯৭৭-এ প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে কবি খ্যাতি লাভ করেন। এবং তার একমাত্র পরিচয় তিনি কবি, শুধুই কবি, কবি ছাড়া আর কিছু নন। কেননা, কবি হিসেবেই তিনি তার সমসাময়িক সময়ে শক্তিমান কবি হিসেবে পাঠক-লেখক মহলে পরিচিত লাভ করেন।

সমুদ্র গুপ্ত সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার পাখি ডাকা ছায়াঘেরা হাসিল গ্রামে ১৯৪৬ সালের ২৩ জুন জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিকভাবে দেওয়া কবির আসল নাম আবদুল মান্নান। অবশ্য বাল্যকালে বাদশা নামেও পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে সাহিত্যচর্চা করতে এসে এবং কমিউনিজম চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং সেসময়ে কবি আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন বেছে নেন। তখন থেকেই সমুদ্র গুপ্ত এই ছদ্মনাম ধারণ করেন। পরে এই ছদ্মনামেই সাহিত্যাঙ্গনে অধিক পরিচিত এবং

প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন।

সমুদ্র গুপ্ত তার সৃজনশীল ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে বাঙলা সাহিত্য ভান্ডারকে গতিশীল সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় করে তুলেছেন। তার কবিতার বড় কারিশমা, তিনি কবিতাকে কোনো কঠিন কিংবা জটিলতার চাদরে আবৃত করেননি। তিনি কবিতাকে সরল সাবলীল ও সহজপাঠ করে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। যেহেতু চলমান যান্ত্রিক সভ্যতার গ্যাড়াকলে পড়ে মানুষেরা এক কঠিন যান্ত্রিক জীবে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে, সেখানে একজন সমুদ্র গুপ্ত মানুষের সত্তাকে, বোধকে, চিন্তাকে, ভাবনাকে ধারণ করে শিল্প সাহিত্য কবিতা নিরলসভাবে উর্বর জমিতে কৃষকের মতো চাষ করে নিজেকে কবিতার দক্ষ চাষি হিসেবে তৈরি করেছিলেন। আর এখানেই একজন মানুষ এবং কবির মধ্যে দিব্য ঢের পার্থক্য চমৎকারভাবে বিদ্যমান এবং তা ফুটে উঠেছে। কবি সমুদ্র গুপ্তকে পাঠ করতে গিয়ে যতটুকু জানা যায়, সমাজ-সংসারে প্রচলিত আচার বিধিবিধান নিয়মের দ্বারা বেষ্টিত ধর্মকর্মের প্রতি তার তেমন একটা আগ্রহ না থাকলেও জীবনে তিনি সততা আদর্শ নির্ভীকতা ন্যায়নিষ্ঠা উদারতা মানবিক মূল্যবোধে নিবেদিত একজন

সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন।

সমুদ্র গুপ্ত একদিকে যেমন মাটি প্রকৃতি বৃক্ষ নদী ও পাখির কবি ছিলেন আবার তিনি গণমানুষের কবিও ছিলেন। গণমানুষের কথা ভাবনা ইচ্ছা চেতনার কথা তিনি তার কবিতায় সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন। কবিতাকে গণমানুষের কণ্ঠ করে তুলেছিলেন। আর এজন্য তিনি তরুণদের কাছে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় কবি ও ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এখানেই তার কবি জীবনের সার্থকতা। কবি সমুদ্র গুপ্ত তিনি জীবন স্মৃতিকে আটপৌরে শক্ত দড়িতে বেঁধেছেন। এই ক্ষণজীবনের স্মৃতিকে একজন সচেতন কবি তার দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে শব্দচয়নে ভাবে ভাবনায় শিল্পের নানা রঙে জীবন্ত করে তুলেছেন। কবি ‘বিভ্রম’ কবিতায় এভাবে উচ্চারণ করেছেনÑ ‘ছেলেবেলায় একবার এক/সম্পন্ন আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে গিয়ে/কারুকার্যময় আলমারির ভেতরে রাখা/সুন্দর পুতুল দেখে হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়ে/আলমারির কাঁচ ভেঙে ফেলেছিলাম...। ’

অনেক দারিদ্র্যের মধ্যে সমুদ্র গুপ্তের জীবন কেটেছে। আর এই জীবনকালে বিভিন্ন পেশার মধ্য দিয়ে কবি জীবন পার করেছেন। যেমন, তিনি তার বর্ণাঢ্য কবি জীবনে বিভিন্ন পর্যায়ে বেঁচে থাকার তাগিদে কর্মময় জীবন কখনো প্রেসের কর্মচারী, করাতকলের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন আবার কখনো ওষুধ ও চিকিৎসার ব্যবসা করেছেন। তিনি এসবের পাশাপাশি উন্নয়ন সংগঠনের নির্বাহী, জুটমিলের বদলি শ্রমিক, প্রুফ রিডার হিসেবেও কাজ করেছেন। এ ছাড়া সাংবাদিকতা, কবি এবং পেশাদার লেখক হিসেবেও জীবনের চাকা ঘুরিয়েছেন। ফলে কবি সমুদ্র গুপ্তকে জীবনচলার পথে পেশাগত বিভিন্ন সমস্যা ও জটিলতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়েছে। আর তাই একান্তে আশাবাদী বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও এই কবি নিরন্তর কাব্যচর্চায় একাগ্রচিত্তে নিজেকে অনেকটা মনোনিবেশ করে উঠতে পারেননি। তারপরেও তিনি সাহিত্যচর্চা থেকে এতটুকু পিছুপা হননি। বলা যেতে পারে, জীবনের শেষকাল পর্যন্ত কাব্যচর্চায় নিজেকে নিরেট দক্ষ শ্রমিকের মতো নিয়োজিত রেখেছিলেন। আর্থিক দারিদ্র্যের কাছে কখনো মাথা নত করেননি। জীবনচলার পথে কঠিন বাস্তবতাকে হাসি মনে মেনে নিয়ে মাথা উঁচু করে কবিতাকে সৃষ্টি করেছেন। মোটকথা, তিনি তার হৃদয় দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে বিশ্বাসের অবস্থান থেকে কবিতা নির্মাণ করেছেন। কবিতাকে করে তুলেছেন জীবনের একমাত্র সাধনার বস্তু। এখানেই কবি একজন এবং অনন্য হয়ে পাঠককুলে মহাকায়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে গোটা বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় মুক্তির আকাক্সক্ষায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন। আর এ থেকে একজন স্বাধীনতাপ্রিয় কবি সাহিত্যিক লেখকও পিছিয়ে ছিলেন না। সমুদ্র গুপ্ত মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। বাঙলার কবিরা সেদিন তাদের কবিতাকে স্বাধীনতার রঙে রাঙিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয় মানসপটে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন। সেসময় কবিতা হয়ে উঠেছিল এক একটা বারুদের মতো। সমুদ্র গুপ্ত দেশকে খুব ভালোবাসতেন, দেশের মাটিকে জননীতুল্য ভাবতেন। এজন্য তিনি দেশের তরে মহান একাত্তরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেও দ্বিধাবোধ করেনি। আমাদের প্রিয় এই বাংলার মাটিকে অনেক অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জন করতে হয়েছে। তিনি এই বাঙলার মাটিকে রক্তে ভেজা মাটির চোখে দেখেছেন। তিনি তার ‘এই বাংলার মাটি’ কবিতায় লিখেছেনÑ ‘আদর্শ বর্গ আয়তনে/সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র পরিমাপের/একখন্ড মাটি নিয়ে হাতে তুলতেই সন্দেহ হলো/লাল নাকি! মাটির মতো লোহাও লবণ!/...মাটি মাটিতে রাখলে মাটি/হাতে তুলে নিলে এই বাংলার মাটি/রক্তে ভিজে যায়...।’

সমুদ্র গুপ্ত তার কবিতাকে তথাকথিত আধুনিক বাঙলা কবিতার যে দুর্বোধ্যতা তা অতিক্রমের মধ্য দিয়ে ‘সহজ ও আপন সুর অন্বেষণ’ দ্বারা বর্তমান কালের অতীব উপযোগী করে তুলেছেন এবং তা অধিক বিবেচিতও বটে। আমরা তাই দেখতে পাই, তিনি সর্বদা শিল্পের দায়বদ্ধতা থেকে তার কবিতা নির্মাণ করেছেন; কবিতার বিশাল শরীর এঁকেছেন ভালোবাসা বিশ্বাস আর বোধের বৈচিত্র্যময় নানা রঙে। তিনি তার ‘পাথরসন্দেহ’ শিরোনাম কবিতায় লিখেছেনÑ ‘অবিশ্বাস সন্দেহ আর ঘৃণার/নড়বড়ে পাথরে পা রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি/ঐ বৃক্ষ পত্রপুষ্প/চাঁদের ঘোলা আলো তার ওপারে/অগুনিত পাখিদের ঘুম আমাকে আটকে রাখে কেনো/...সন্দেহ দানা বাঁধে আমি কি পাখি নই/আমার দাঁড়ানোটাও কি পাথরের উপরের নয়...।’

সমুদ্র গুপ্ত নিজেকে আপাদমস্তক একজন সত্যিকার কবিরূপে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর এই কারণেই তিনি তার সৃষ্টিশীল শিল্প সাহিত্যকর্মে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে যেমনÑ (১) হুমায়ুন কবীর স্মৃতি সাহিত্য পদক, (২) লেখক শিবির সাহিত্য পদক, (৩) যশোর সাহিত্য পরিষদ পদকসহ দেশের বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেছেন। এমনকি তিনি তার কবি প্রতিভাকে সম্মান হিসেবে দেশের বাইরেও অন্যান্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। ভারতের কবি বিষ্ণু দে সাহিত্য এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সরকার প্রদত্ত ভাষা দিবস পুরস্কারও অর্জন করেছেন। এসব পুরস্কার যা আমাদের সাহিত্যে দেশের সম্মান বয়ে এনেছে। মূলত বাঙলা কাব্যে অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন এই পুরস্কার মূলত তার কাব্যপ্রতিভারই স্বীকৃতি স্বাক্ষর রেখেছে। যদিও তিনি বিগত ৪ দশক ধরে কাব্যচর্চা করেছেন। এক মনে এক ধ্যানে নিরলসভাবে কবিতা লিখেছেন। এই মহান কবিকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জাতীয় কোনো পুরস্কারে (একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক) মনোনীত করা হয়নি। এমনকি বাঙলা একাডেমি পুরস্কার পর্যন্তও তাকে দেওয়া হয়নি। কিন্তু কেন এমনটা তার বেলাতে করা হলো আমাদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার না। হ্যাঁ! এটা ঠিক যে, কোনো পুরস্কারের লোভে কবিরা কবিতা লেখেন না, কিন্তু ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ কোনো সম্মাননা দিলে দোষটা কোথায়। অথচ যারা জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার কোনো যোগ্যতাই রাখেন না, দেখা গেছে যে, তাদেরকেই এসব পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। আর এর জন্য কোনো গুণী ব্যক্তিকে যথাযথ সম্মান দিলে, কদর করলে সমাজের জন্য, দেশের জন্য, মানুষের জন্য ভালোই হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close