অলোক আচার্য

  ২১ জুন, ২০১৯

সুফিয়া কামালের সাহিত্য সংগ্রামী জীবন

আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা/তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা/আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি/তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি। কবি সুফিয়া কামালের ‘আজিকার শিশু’ কবিতার অংশবিশেষ। সুফিয়া কামালের কবিতায় মিশে আছে আবেগ, অনুভূতি, সরলতা, ভালো লাগা ও নারীর আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করার মনোবল। বেগম সুফিয়া কামালকে কেবলই কবি বললে তার কর্মের জগতকে ছোট করে দেখা হবে। তিনি ছিলেন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, সমাজসেবক, শিক্ষক এবং সর্বোপরি একজন সংগ্রামী। কর্মপরিসর ছিল বিশাল। তার লেখায় যেমন বড়দের জন্য পাঠের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে; তেমনি ছোটদের জন্য তার কলম সৃষ্টি করেছে কালজয়ী সব লেখা। সেই যে ছোটবেলায় পড়া ‘গোল করো না গোল করো না/ছোটন ঘুমায় খাটে।/এই ঘুমকে কিনতে হলো/নওয়াব বাড়ির হাটে’ ছড়াটির কথা মনে পড়ে? আবার বিখ্যাত প্রার্থনা কবিতায় স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা ‘তুলি দুই হাত করি মোনাজাত/হে রহিম রহমান/কত সুন্দর করিয়া ধরণী/মোদের করেছ দান।’ তার কবিতার স্তবকে মিশে আছে প্রেম, প্রকৃতি, ব্যক্তিগত অনূভূতি, বেদনাময় স্মৃতি, স্বদেশের প্রতি মমতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা এবং আবেগ। বেগম রোকেয়ার পাশাপাশি নারী আন্দোলনের অগ্রদূত হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশে নারীর অধিকার আদায়ে যিনি সংগ্রাম করেছেন তিনি বেগম সুফিয়া কামাল। পরাধীন দেশে তিনি নারীকে আলোর পথ দেখিয়েছিলেন। অন্যায়, অসততা, অসত্য আর অশিক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল তার চিরকালের। পাশাপাশি তিনি ছড়িয়েছেন মানবতার আলো, থেকেছেন সত্যের সঙ্গে, লড়াই করেছেন দুর্নীতি আর অমানবিকতার বিরুদ্ধে। এর পাশাপাশি তিনি লড়াই করেছেন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের বিরুদ্ধে, তার অবস্থান ছিল মৌলবাদের বিপক্ষে, রাজপথে নেমে আন্দোলনকে বেগবান করেছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে কার্ফু উপেক্ষা করে রাজপথে নেমেছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও রাজপথে ছিলেন সোচ্চার। তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদেও আন্দোলনে নেমেছেন। ছিলেন সুস্থ সামাজিক চেতনায় বিশ^াসী একজন মানুষ। এতসব মানবিক গুণে গুণান্বিত কবি ও সাহিত্যিক সুফিয়া কামালের জন্ম ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদের একটি অভিজাত পরিবারে। তার এই সাহসী কর্মের জন্য বাংলার মানুষ তাকে ‘জননী সাহসিকা’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

মুক্তবুদ্ধির এবং মুক্তমনের চেতনার একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন সুফিয়া কামাল। তিনি চেয়েছিলেন প্রথাগত গন্ডির ভেতর থেকে নারীদের মুক্ত করতে। তিনি নিজে এ শৃঙ্খল ভেঙেছেন, জাগিয়েছেন অন্য নারীদের। বেগম রোকেয়ার পাশাপাশি তার নামও নারী আন্দোলনের অগ্রপথিক হিসেবে উচ্চারিত হয়। লেখনীর মাধ্যমেই তিনি সীমাবদ্ধ থাকেননি। অথচ তার জীবনের শুরুটা হয়েছিল কষ্টে। তার সময়ে তার পরিবারে শিক্ষা বিশেষ করে বাংলা চর্চা করা ছিল প্রায় এভারেস্ট জয় করার মতো ব্যাপার। তিনি তাই করে দেখিয়েছেন। যখন মাত্র সাত বছর তখন তার বাবা নিরুদ্দেশ হন। ফলে তার মা সন্তানদের নিয়ে আশ্রয় নেন নানাবাড়িতে। সুফিয়া কামালের শৈশব কাটে সেখানেই। তার লেখাপড়া বা সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণবোধ বা ভালোবাসার শুরুটা হয় এই মামাবাড়িতেই। তার মামার একটা বিশালাকার লাইব্রেরি ছিল। সেখানে মামার উৎসাহ পেয়ে বই পড়া শুরু করেন। কিন্তু মাত্র ১৩ বছর বয়সেই মামাত ভাই সৈয়দ নেহালের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়। খুব অল্প সময়ের জন্য তার বই পড়ায় ছেদ পরে। এ সময় তার সাহিত্যচর্চায় নতুনত্বের প্রকাশ ঘটে। কারণ স্বামী নেহাল ছিলেন আধুনিক মনস্ক। তিনি সহধর্মিণীকে সাহিত্যচর্চার ব্যাপারে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। স্বামীর বিপুল উৎসাহেই বিবাহ-পরবর্তী জীবনে সাহিত্যচর্চা শুরু হয় এবং এ সময় থেকেই তার লেখালেখির জগতে পরিচয় ঘটে। স্বামীর সৌজন্যে সুফিয়া কামালের সঙ্গে সাময়িক পত্রিকার যোগাযোগ ঘটে।

সুফিয়া কামালের জীবনে একটি বড় প্রভাব রেখেছেন বেগম রোকেয়া। তার সঙ্গে বেগম রোকেয়ার সাক্ষাৎ ঘটে কলকাতায়। সুফিয়া কামাল ১৯১৮ সালে কলকাতায় গেলে সেখানে বেগম রোকেয়ার সঙ্গে দেখা হয় এবং চিন্তা জগতে পরিবর্তন ঘটে। যার প্রভাব তার কাজেও দেখা যায়। তার স্বামীর অনুপ্রেরণাতেই তিনি সাহিত্য রচনা শুরু করেন।

এই সাহিত্যচর্চার ফলস্বরূপ তার প্রথম কবিতা বাসন্তী সেসময়কার জনপ্রিয় সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে। তার কবিতা ছিল সহজ, কিন্তু আবেগী, মননশীল শব্দচয়ন। এভাবে বেশ চলছিল। সাহিত্যচর্চা আর সামাজিক কর্মকান্ড সব ভালোই এগোচ্ছিল। তবে সে পথে বাধা আসে ১৯৩২ সালে। তার স্বামী নেহাল হঠাৎ মারা যান। স্বামীর মৃত্যুতে তিনি প্রচন্ড আঘাত পান। এ সময় তার জীবনে অর্থ সংকট দেখা দেয়। এ সংকট মোকাবিলায় শিক্ষকতার পেশা বেছে নেন। এত কিছুর মধ্যেও তার সাহিত্যচর্চা চলছিল। স্বামীর দেখানো পথে অনেকটাই এগিয়ে যান। ১৯৩৭ সালে তার গল্প সংকলন কেয়ার কাঁটা প্রকাশিত হয়। এর পরের বছরই ১৯৩৮ সালে কাব্যগ্রন্থ সাঁঝের মায়া প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থটি বোদ্ধামহলে প্রশংসা কুড়ায় এবং সুফিয়া কামালের সাহিত্য প্রতিভা সবার নজরে আসে। তার কাব্য প্রতিভার জন্য তিনি অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে গণ্য হন। ১৯৫৬ সালের ৫ অক্টোবর তার বাসভবনে প্রগতিশীল শিশু সংগঠন ‘কচি কাঁচার মেলা’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ছিলেন। অন্য শিশু সংগঠন ‘চাঁদের হাট’-এর সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন।

সাঁঝের মায়া কাব্যগ্রন্থটির মুখবন্ধ লিখেছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কাব্যের প্রশংসা করেছিলেন। সুফিয়া কামালের সাহিত্য জীবনের গতি কিছুটা পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন কবি নজরুল। তিনি সুফিয়া কামালের কবিতা পড়ে বিশেষভাবে মুগ্ধ হন।

গ্রন্থের সংখ্যা দিয়ে কবির কবিত্ব পরিমাপ করাটা বোকামি। আজ পর্যন্ত কোনো কবির প্রতিটি কবিতাই সমানভাবে পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কোনো কোনো কবিতা কবিতাপ্রেমীদের মনে দাগ কেটে যায়। সুফিয়া কামালের কিছু কিছু কবিতা পাঠকের অন্তরে ঠাঁই করে নিয়েছে। তার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যাই বেশি। তার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছেÑ সাঁঝের মায়া, মায়া কাজল, মন ও জীবন, প্রশস্তি ও প্রার্থনা, উদাত্ত পৃথিবী, দিওয়ান, অভিযাত্রিক, মৃত্তিকার ঘ্রাণ ও মোর জাদুদের সমাধি পরে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর লেখা ভ্রমণকাহিনি সোভিয়েতের দিনগুলি, ১৯৭১ সালের স্মৃতিকথা একাত্তরের ডায়েরি, আত্মজীবনীমূলক রচনা একালে আমাদের কাল, শিশুদের জন্য তার রচনা ইতল বিতল, নওল কিশোরের দরবারে। এ ছাড়া তার সাঁঝের মায়া গল্পগ্রন্থটির অনুবাদ হয় ১৯৮৪ সালে। সব পরিচয় ছাপিয়ে কবি সুফিয়া কামাল হিসেবেই সবাই তাকে সর্বাধিক চেনে। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। তার সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close