পারিজাত ব্যানার্জী

  ১৪ জুন, ২০১৯

অপূর্ণতাগামী নন্দনতত্ত্ব ও তার রূপ লেহন

আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। সেই সময়টাকে ভোর বলাও ঠিক হবে না বোধহয়। রাত্রির শেষ প্রহর। পাখিগুলি ঘুম ভেঙে ওঠেনি, ভোরের প্রথম আলোর ছটার আড় ভাঙতে তখনও বেশ দেরি। তবু ঘুম আর আসতে চাইল না কিছুতেই। কোনো এক স্বপ্নের ভেতর থেকে হঠাৎ ছিঁড়ে যাওয়া ঘুমের টান কেমন যেন দিশাহারা করে দিয়েছিল আমায়। কেমন যেন এক অপ্রাপ্তির স্বাদ জিভে লেগে রয়েছে তখনওÑ হঠাৎ পাওয়া নিজের সঙ্গে কিছুক্ষণের এই অবসরেও তাই জেগে উঠছে অপূর্ণতা। স্বপ্নের অধরা রঙিন কাব্যিদের এভাবে উড়ে যাওয়া যে বিষাদের সৃষ্টি করেছে এই ব্রহ্ম মুহূর্তে, তাও কী সর্বান্তঃকরণে সুন্দর নয়? এই না পাওয়ার যন্ত্রণার যে আবেগ, যে আবেশÑ তাকে নিয়ে ঠিক কী অভিমত দর্শনশাস্ত্রের? নন্দনতত্ত্বইবা ঠিক কি আঙ্গিকে দেখে এই আপাত অপূর্ণ ভাবাবেগকে?

বিছানা ছেড়ে উঠেই পড়লাম এমন অনিন্দ্য অবসরে। ঘরের আলো না জ্বালিয়েই বসে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। পাশে অঘোরে নিদ্রাচ্ছন্ন স্বামীর মুখে ফুটে ওঠা অপার্থিব নিশ্চিন্ততা আর সারল্যর খেলাÑ সারা দিনের চিন্তা আর ক্লান্তির ফাঁকে এমনভাবে আর কবে ঠিক পেয়েছিলাম ওকে, মনে পড়ে না। ভালো করে ঝুঁঁকে পরে ওর মুখমন্ডল দেখলাম, চোখের মধ্যে অপূর্ব এক প্রাণোচ্ছলতা খেলে বেড়াচ্ছেÑ হয়তো স্বপ্নের কোনো অজানা স্তরে পরম নিশ্চিন্তে যাপন করছে ও ওর অলস অনাড়ম্বর তন্দ্রা! কিছু প্রাপ্তি নেই সেখানে, সারা দিন কর্মব্যস্ততায় অর্জিত সময়কে হেলায় হারিয়ে নতুন করে কিছু করারও নেইÑ এই না পাওয়াটাই নিভু নিভু রাতের কোলে আশার চাদরে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরেছে ওর সত্তা, থমকে যাওয়া এই নিস্তরঙ্গ মহত্তম সৌন্দর্য আর কিসেইবা ফিরে ফিরে আসে?

টেবিলের ওপর উল্টানো আধ পড়া বইটা চোখ টেনে নিল এ অসময়। ভাবলাম একবার যাই, উঠেই যখন পড়েছি ঘুম থেকে, গিয়ে পড়েই ফেলি না বরং ওর শেষ কয়েকটা পাতাও। কিছুই তো বিশেষ করার নেই এখন। তখনই গাড়ি চালানো শেখাতে আসা বনমালীদার কথাখানা মনে পড়ে গেল হঠাৎÑ ‘আসতে চালান ম্যাডাম গাড়িখানা। যত বেশি জোরে চালাবেন, তত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাবে তো রাস্তা!’

সত্যিই, এমনভাবে ভেবে দেখিনি তো আগে! পরে থাকা শেষ কয়েক পৃষ্ঠা যেই পড়ে ফেলব, ওমনি তো পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটবে তার। ‘ফুরিয়ে যাবে রাস্তা!’ তার চেয়ে এই না পড়ে ওঠা অপ্রাপ্তি ঢের বেশি মানানসই। বাসনা বেঁচে থাকে শেষ পর্যায় পৌঁছানোর। আবার খুব বেশি তাড়াও থাকে না। তাড়িয়ে তাড়িয়ে আলসেমি মেখে বেশ উপভোগ করা যায় না-পাওয়ায় মজে থাকা নব্যপ্রাপ্ত সৌন্দর্যদর্শন!

মুখে চোখে জলের ঝাঁপটা দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। এমন সময় আগে কখনো এই চৌখুপিতে আসিনি। কেন? এই আলতো মিঠে হাওয়া, শেষ রাতের প্রকৃতির চন্দ্রালোকিত অবগাহন, শুকতারার মিঠে ঝিকমিক, কালপুরুষের কোমরবন্ধ দেখার ইচ্ছা হয়নি বুঝি আগে কখনো? নাকি দিনের চপলতা চঞ্চলতা আর রৌদ্রার্পিত তেজস্বিতায় এমন পূর্ণায়ত হয়ে যায় জীবনমন্ডলী, মুদ্রার উল্টো এই পিঠটাকে অবলোকন করার সময়ই হয় না কিছুতেই! আসলে সব কিছুই আজকাল পরিমাপ করে নিই আমরা প্রয়োজনের নিরিখে। দিনের আলোকোজ্জ্বল পরিধির মধ্যে বিচরণ করেই সব সাধ পূরণ করতে এতটাই উঠেপড়ে লাগি, কিছু অপ্রাপ্তিরও যে চাহিদা থেকে যায় দিন শেষে, ভুলে যাই তাও। অথচ কত কিছুই তো দেওয়ার থাকে এই শ্যামলাভ রাত্রিনন্দিনীর! তার ফিসফিসানি কত অজানা কথাই তো বলে চলে নিশির ডাকের মোড়কেÑ হোক না তা অপূর্ণ, নাইবা থাকল তাতে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের উদ্বেলতা প্রাপ্তিÑ তবু তার ঢিমে মধুরতায় ভরা অর্ধেক কলসিও তো মনোরম, স্নিগ্ধ, তৃষ্ণার্ত বক্ষে মধুচঞ্চারকারীÑ তাই না! তবে কি সব পাওয়া, সব দেখা, সব জানার মধ্যেই কেবল সমাহিত নন্দনতত্ত্বের গুরুদায়ভার? না থাকা, না দেখার, না পাওয়ার যে বিহ্বলতাÑ তা বুঝি সুন্দর নয়?

তাইবা কি করে হয়? রাধারানীর যে প্রেম জন্ম নিয়েছিল পূর্বরাগে, যে আবেশ ঘনীভূত হয়েছিল প্রেমিকযুগলের অসমতায়, যেই সব অলঙ্ঘনীয় বাধার বাঁধনে নেমে এসেছিল প্রণয় (রাধাকৃষ্ণর কাব্য প্রত্যক্ষ করলে দেখা যায়, রমণীশ্রেষ্ঠ শ্রীরাধিকা আমাদের কানাইয়ের থেকে বয়সে ছিল বড়, তখনকার আলাপনের বিচারে যা নিতান্তই বেমানান। এমনকি, তাদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্কও ছিল পুরোদস্তুর। রাই তো সামান্য কোনো গো পালিকা কিশোরীও ছিলেন না, তিনি ছিলেন আয়ান ঘোষের ঘরণী)Ñ সেই সময়ের আলেখ্যে নিশ্চিত রূপেই তা কল্পনাতীত। তবু এই মিলনসাধন অসম্ভব জেনেও তো আন্দোলিত হয়েছিল যমুনার জল তাদের রসকেলীতেÑ নিবিড়চিত্তে নির্জনে জ্ঞাত তাদের অপ্রাপ্যনীয় চপলতা অবশেষে তবু স্থিত হয়েছিল অপূর্ণতার ঘেরাটোপেই। তাদের যে প্রেমিকযুগল মূর্তিটি প্রায় প্রতিটি নাটমন্দির আলো করে রাখে, তারও উপস্থাপন তো প্রেমবৈচিত্র্যের রসে আরক্ত হয়েইÑ এর চেয়ে সুন্দর, নান্দনিক আর কিছু হয় কি? ভালোবাসা সুন্দরÑ সেই পথ নাহয় হলোইবা একসঙ্গে চলার জন্য অনুপযোগী! অপূর্ণতা সেখানে চন্দ্রবৎ আলো আঁধারির কারিগর। পূর্ণিমার আকাশে টইটম্বুর চাঁদ যুগে যুগে শোভালালিত এবং সমাদৃত ঠিকই, কিন্তু দ্বিতীয়বার চাঁদের একচিলতে কনে দেখা আলোর মতো তা কমনীয় কী? তর্কাতীত অবশ্য এই সব দ্বিমুখিতা।

আকাশের কোল আলো করে রাতের এক ছটাক নির্মেদ চন্দ্রলেহন এসব এলোমেলো বাতাসরাজির মতোই হঠাৎ ধরা দিল আমার দৃষ্টিকল্পে। মনে পড়ে গেল, আজই তো দ্বিতীয়া! চাঁদের শরীরের লুকিয়ে পরা টুকরোগুলো সবেমাত্র আবার নিজেদের গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে অম্বরের নিভৃত আঙিনায়। তার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ মনে হলো, আমি তো কেবল এক ফালি চাঁদ দেখতে পাচ্ছি না! বরং যা আমার এই মুহূর্তের দৃষ্টি আকর্ষিত এবং রোমাঞ্চিত করছে, তা ওই আলোর চপলতার থেকে অনেক নিবিড়Ñ এক পূর্ণাবয়ব গহন আঁধারাকৃতি যেন শেষ রাতের নিস্তব্ধতায় ধ্যানগরিমায় উপবিষ্ট। যার মেঘবৎ কুন্ডলীকৃত জটায় স্বয়ং শোভিত পাচ্ছেন সদ্য কেতুর কবল থেকে মুক্তির আশ্বাস মাখা চন্দ্রদেব! শিবশম্ভূর এই অকষ্মাৎ আগমনে বিহ্বল হয়ে পড়লাম খানিক। মনে হলো যেন কে জানে কত প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বাকি রয়ে গিয়েছিলÑ মুশকিল একটাই, মনের গূঢ়তম স্তর থেকেও এই এক লহমায় যেন মুছে গেল সেই প্রশ্নচিহ্নরাও।

শঙ্কর স্বয়ং কালÑ এ জগতের সমস্ত কিছুর সময় নির্ধারণ করেন তিনি নিজেই। তার সত্তাই পরিমাপ করে ধ্বংসের সঠিক আবহ। আবার করালবদনা কালী স্বয়ং এই জগৎ-ধাত্রীÑ মহাবিশ্বের সকল মায়াজাল বিস্তারিণী। তাকেও নিজের বুক দিয়ে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে রেখেছেন সদাশিবÑ যাতে ধ্বংসকে নিয়ন্ত্রণ করে এই ঘোর তমসাবৃত অন্ধকারেই সৃষ্টির প্রথম আলো জন্ম নেয় নারী জঠরে। এই ধূসরবর্ণ অপূর্ণতার আগ্রাসন যদি নাই থাকত এ ব্রহ্মান্ডে, কীভাবে জন্ম নিত নান্দনিক, যা কিছু গ্রহণযোগ্য রয়েছে এই ধরাধামে?

প্রশ্নরা তবু ফিরে ফিরে আসে অচেতনে। শিব তো স্বয়ম্ভূ। তিনি নিজেকে নিজেই সমস্ত অপার্থিব সুপ্রশস্ত বিন্যাসে সম্পূর্ণতা প্রদান করতে পারতেন, তাই তো! অথচ তিনি কোমরে জরিয়ে নিলেন এক নিতান্ত সাদামাটা বাঘছাল, গায়ে মেখে নিলেন শ্মশানের ছাইভস্ম, টান দিলেন কল্কে হুঁকোয়, সাধারণের দলে ভিড়ে। নিমীলিত করলেন তৃতীয় চক্ষু এমনভাবেই যাতে তা থাকে সর্বদা অন্তর্¯úর্শীÑ বাইরের চাকচিক্যময় ভোগসুখ থেকে সর্বদাই কোনো বিপরীত পন্থায়। মাথায় যেই গঙ্গা ধারণ করলেন, তিনিও সবার সব কালিমা ধুয়েমুছে দেওয়ার প্রয়াসেই ব্রতী সর্বদা। আর চাঁদ? পূর্ণিমার সুডৌল চাকচিক্যরহিত এক ফালি কলেবরেই তার রূপের যে প্রকৃত বিকাশÑ তা বুঝেই যেন হেলায় একপাশে ফেলে রাখলেন এই চপল দামাল উপগ্রহকে। এই নিরাভরণ স্নিগ্ধমধুর সমন্বয়ই তো প্রকৃত অর্থে সর্বাংশে সুন্দরÑ এই অর্ধেক কক্ষপথেরই যে এমন আকাশছোঁয়া ব্যাপ্তি! এর চেয়ে সত্যইবা আর কী হয়? এমন সৌন্দর্যানুরাগই কি নন্দনতত্ত্বের মূল আধার স্থাপন করে না? তাইতো এককথায় বলা যায়Ñ ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’। যা সত্য, তাই শিব, তাই-ই সুন্দর, আর শুধু সেটুকুুই নান্দনিক। পূর্ণতার লোকমতগ্রাহী মাপকাঠির সেখানে আদপেও কোনো স্থান নেই কোথাও।

রাতের আঁধার আচ্ছন্ন এই শেষ প্রহর যাপনকালে যেই সত্য আমার চোখের সামনে উদ্ঘাটিত হলো, কই দিনের আলোয়ান মোড়া রঙচঙে মুহূর্তগুলোয় তো এমন নিপুণভাবে হয় না সেই সৌন্দর্যদর্শন! সেখানে শুধু নিহিত থাকে তাকে খোঁজার আবেগÑ আর তা না পাওয়াজনিত নিবিড় হতাশা। অথচ, এই নিরাশা, অপারগতা, ক্লান্তি, বিরহাতুর অপূর্ণতাÑ এদের ফাঁকেফোকরেই কিন্তু বাসা বাঁধে যা কিছু নন্দন, রুচিশীল। ‘যাহা না পাইবার, তাই কোথা পাই গো! পাবো না পাবো না’Ñ রবিঠাকুরের এই হাহুতাশে কোনো খেদ কিন্তু উঁকি দেয় না সেভাবেÑ পড়ে থাকে কেবল না পাওয়ার মাঝেই পাওয়ার ঠিকানা খোঁজা, ঈশ্বরবাদ আর প্রগাঢ় দর্শন।

আমরা ভুলটা কোথায় করি, তা হঠাৎ করেই যেন আলতো ধরা দিয়েই মিলিয়ে গেল আঁধারে সেই বারান্দায় বসে থাকতে থাকতেই ভোর হওয়ার প্রাকলগ্নে। আসলে আমরা সবকিছুর একখানা মনমতো মাপকাঠি স্থির করে ফেলি প্রতিটি ক্ষণে। প্রতিটি মানুষের আবার এমনই সব আলাদা আলাদা পরিধি তাদের নিজেদের বিচার, বুদ্ধি, বিবেচনার আঙ্গিকে। যেমন, একটি মেয়ের সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ করা হয়, তার প্রোজ্জ্বলিত গায়ের রঙ এবং সমাজ অনুশাসিত সুশ্রীতার দন্ডে। পুরুষের সৌন্দর্যের মাপাঙ্ক নির্ধারিত হয় পৌরুষের প্রাবল্যে। শুধু কি তাই, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবার, সমাজ, দেশ, মূল্যবোধÑ খুঁটিনাটি এমন অনেক কিছুর ওপর ভিত গড়েই প্রত্যেক পরিচিত মানুষকে (সময়বিশেষে জীবজগৎ এবং উদ্ভিদকুলও রক্ষা পায় না) এমন দুরূহ অগ্নিবৎ পরীক্ষার সম্মুখীন করাই। বাদ দিই না নিজেকেও। রূপকথার গল্পসদৃশ বারবার জানতে চাই এক টুকরো কাঁচরূপী আয়নার কাছে, ‘বল না কে সবচেয়ে সুন্দর এই পৃথিবীতে?’ এ ক্ষেত্রে আয়নাটি অবশ্য নিতান্তই ঠোঁটকাটা। এক রকম মুখের ওপরেই সে বলে বসে, ‘সে আর যেই হোক না কেন, তুমি নও।’

আমি নই? তবে কে সুন্দর? বা প্রকৃতপক্ষে কী এই সৌন্দর্য? যাকে নিয়ে কালের পর কাল ধরে শিল্পীরা রচনা করে গেছেন একের পর এক ভাস্কর্য, কবিরা লিখে গেছেন পদ্য-কবিতা, নাটকীয়ভাবে উত্থান হয়েছে কত শত কুলশ্রেষ্ঠের, যাদের বর্ণনাতীত সৌন্দর্য এবং সৌন্দর্যানুরাগ আজও বিভিন্ন সভাকক্ষ ভরাট করতে যথেষ্ট!

শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে যায়, কুরূপতা থেকে মুখ ঘুরিয়ে অট্টহাস্য করে ওঠে তথাকথিত ভদ্রসমাজ, ‘সরে যাও আমার সামনে থেকে! জানো না, আমি কেবল সৌন্দর্যেরই উপাসক! সেই অসীম প্রভা নাই বা পূর্ণ লালিমায় ধরা দিয়ে থাকুক আমায় আমার নিজের এক টুকরো কাঁচের ডগায়Ñ তবু সেই নিষিদ্ধ অমৃতময় সুধার নেশাতেই বুঁদ থাকি আমি অহর্নিশ। জানো না? সরে যাও। সরে যাও বলছি!’

আপাতভাবে কুরূপতা এত অবহেলা শেষে কি আর দাঁড়িয়েও থাকে কারো চোখের সামনে? সে যেন নিজেই তখন মস্ত কোনো অপরাধে অভিযুক্ত, দোষী। লজ্জায় ঘৃণায় সে ভেঙে দেয় নিজের হাতের ছোট্ট নিটোল আয়নাটিকেই। হাজার কাঁচের টুকরো অবশ্য মার্জনা করে না তার ধৃষ্টতা। চিৎকার করে জানিয়ে দেয় তারা ‘সু’ মন্দ্রিত সমাজকে, ‘কে কোথায় আছো? দেখে যাও এর কদর্যতা! ধিক্কার জানাও একে। এতো সাহস এর, সুন্দরতার মাঝেই মুখ লুকিয়ে বাস করে এ! পূর্ণতাপ্রাপ্তির কয়েক হাত দূরে দাঁড়ানো ‘সভ্যভব্য’ এ সমাজে একি অনাসৃষ্টি!’

কুরূপতা এসব শুনে স্তম্ভিত হয়ে থমকায় কয়েক মুহূর্ত। তারপর এক এক করে সার বেঁধে তারা ঝাঁপ দেয় আগুনেÑ ধুয়েমুছে দিতে রূপের রূপকসদৃশ অস্থিময় তাদের উপস্থিতিকেও।

তবে কি সত্যিই অপূর্ণতা বেমানান এক অসুখ কেবল? এর সঙ্গে নন্দনতত্ত্বের নেই কোনো সম্পর্ক? তবে এই যে এতক্ষণ যা ভাবলিপি নথিভুক্ত করলাম নিজ হৃদয়াঙ্গনে, সবই বুঝি কেবল কাব্যিক? বাস্তবে অগ্রহণীয়! সেখানে নিখুঁত অবয়ববিশিষ্টরই শুধু জয়জয়কার! গোহারা হেরে যায় অসামঞ্জস্যরা অনান্দনিক বিষাদময়তায়?

অবচেতনের গভীর এই ভারকে সঙ্গে করেই কখন যে হিমেল হাওয়ার নান্দনিকার রেশ গায়ে মেখে চোখ দুটো জুড়িয়ে এসেছিল, তা ঠিক মন নেই এখন আর। আলগা অগোছালো স্বপ্নের জাল কেটে ঘুম ভাঙল চকিতে, পায়ের কাছে খুট করে কিছুর একটা শব্দ হওয়ায়। চোখ মেলতেই জেগে ওঠে ভোরের গন্ধমাখা কলকাতার আকাশ অচিরেই, আমার চোখের সামনেই। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়প্রমাণ হাইরাইজের চোখরাঙানিতে সরাসরি সূর্যের আলো আমার বারান্দায় হয়তো পড়েনি এসে, কিন্তু ছোটখাটো এসব বাধায় কিছুই যায় আসেনি অরুণদেবের। তাকে ভয় পাই, ভালোবাসি বা ভক্তি করিÑ শীতে অপেক্ষায় দিন গুনি বা গ্রীষ্মে মুখ ঘুরিয়ে নিইÑ তিনি সবেতেই তাও সমান অপ্রতিরোধ্য। আমাদের এই নশ্বর সব মাপকাঠির অনেক ঊর্ধেŸ ওনার বিচরণস্থান। তিনি তেজস্বী পূর্ণতা-অপূর্ণতার আঁধারের বিচারের অনেক ওপরে আসীন।

এ যুগে সোশ্যাল মিডিয়া কোথাও গিয়ে আমাদের সমাজকে অলিখিতভাবে বোধকরি নিয়ন্ত্রিত করে চলে সর্বদা। সেখানে একদিকে যেমন ঘরের মেয়ে মানুষী চিল্লরকে নিয়ে শুরু হয় উন্মাদনা, তেমনই এই নিগ্রো মেয়েটিকে নিয়ে বসে ব্যঙ্গবিদ্রƒপের আখড়াও। ‘এই কালো কাক কি ভেবে বিউটি কন্টেস্টে গিয়েছিল?’, বা ‘ভাব যদি রাতে ঘরে ঢোকে, বাবারে!’ ‘এ যদি আমার বৌ হতো, সে বাড়ি থেকে রাতের বেলাই পালাতাম’Ñ এমন অরুচিকর অশালীন সব মন্তব্য ও মন্ত্রণার মাঝেই মাথাচাড়া দিয়েছিল খুব নিরীহ অথচ দৃঢ়মূল এক প্রশ্নÑ তবে কি সমাজের মাপকাঠিতে কারো সৌন্দর্য যদি না ধরা দেয়, তার নিজের মতো করেই বেড়ে ওঠে জংলা জমিতে কোনো চারাগাছ আপন মহিমা অবলম্বন করে, তাকেই কি আমরা তথাকথিত অপূর্ণতার তকমা এঁটে দিতে পারি? সৌন্দর্যদর্শনের আলোচনার ক্ষেত্রে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় কি এমন সব দ্বিচারিতা এবং বৈষম্যসূচক প্রহসন থেকে? শুধু যে বর্ণ বা রূপবৈষম্যÑ তা কিন্তু নয়, নান্দনিকতার আপাত সামাজিক সংজ্ঞা থেকে এদিক-ওদিক হলেই কিন্তু দেখছি আর নিস্তার যায় না কেউই।

অথচ সমাজ নিজেই তো পরিবর্তনশীল। এক দেশ থেকে অন্য দেশ, এক সম্প্রদায় থেকে অন্য সম্প্রদায়, এক ঘর থেকে অন্য ঘরে তার আলাদা রকমভাবে নিবাস। আমাদের কাছে আজ যা সুন্দর, অন্যের কাছে তাই কুৎসিত, আমাদের কাছে যেটা প্রিয়, পরের কাছে তাইতো অবহেলিত। তাই মানুষী শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পরিহিত হয়েও সমালোচিতÑ ‘সেই, এখন তো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তৃতীয় বিশ্বের মেয়েদের মধ্যেই এই লড়াই হয়ে থাকে, এ আর নতুন কী?’ ‘ইংল্যান্ড বা মেক্সিকোর মেয়েটি তো আরো সুন্দরীÑ তা হলে আবার ভারত কেন?’ ইংল্যান্ড মুকুট পরলে নিশ্চয়ই তখনো ভ্রু কুঁচকোতো, ‘বড় বড় দেশের ব্যাপার। কেন যে ভারত, কেনিয়া প্রতি বছর নাম লেখায় তাও এসব প্রতিযোগিতায়!’ আমাদের যে স্বস্তি নেই কিছুতেই।

মূল বিষয় হলো, আমাদের ধ্যান এবং ধারণাতীত কোনো কিছু হলেই তা আমাদের মধ্যকার ছককাটা ঘরগুলোকে ওলটপালট করে দেয়। নতুন করে সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা রচনা করতে অক্ষম আমাদের অকর্মণ্য শিথিল মস্তিষ্কÑ তাই বিদ্রুপ আর ভর্ৎসনা দিয়েই নিজের নিম্নগামিতার সুষ্ঠু পরিচয় প্রদান করে চলি দিনের পর দিন। মা কালীর রূপের বিচার করি না পরিতাপের আর দেবরোষের ভয়েÑ তা বলে কালো মেয়েকে ঘরণী করি না ভুলেও। দেবতা আর মানুষের নন্দনচর্চার রূপও বুঝি ভিন্নতাকে প্রশ্রয় দেয়? নাকি এ সেই ভাঙা কাঁচের অট্টনিনাদেরই কম্পন, যে আমাদের মুখের ওপর বলেছিল, ‘আর যেই হোক, তুমি সুন্দর নও!’

কোনো একটি সংজ্ঞা কি তা হলে নেই নন্দনতত্ত্বের? কোথাও তার নিয়মের বেড়াজালে আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত লাগাম পরাচ্ছি, কোথাওবা করে দিচ্ছি শিথিল নিজেদের দরকার মতোই। কোথাও অপূর্ণতার আলাদা বিচারভেদ করছি না, আবার নিজস্ব ঘেরাটোপে তার তুল্যমূল্য বিচার করতেও ছাড়ছি না সময়বিশেষে।

তা ভালো। এটুকু বোধ যেন তবু হয়, নন্দনতত্ত্ব ক্রম পরিবর্তনশীল এক দর্শনশাস্ত্রের অন্তর্গত শাখা যেখানে মূল ভাবধারাটি সৌন্দর্যানুরাগে ব্যাপৃত থাকলেও, সেই সৌন্দর্যের পরিভাষাগত বিভেদ সব দেশে সব সমাজে উপস্থিত। অপূর্ণতারও অবশ্য প্রভেদ রয়েছেÑ নিজস্ব স্বার্থেই তা আমরা স্বীকার করে নিই কোথাও, কোথাও আবার মুখও ফেরাই।

বিভেদ আসলে অপূর্ণতা আর নন্দনতত্ত্বজনিত শাখা দুটির মধ্যে অবস্থান করে না। অবস্থান করে আমাদের মননশীলতা আর ভাবনার পরিশীলিত বিচক্ষণতায়। নিজেদের হাতেই যে আয়না ভেঙে দিয়ে থাকি আমরা, তার প্রচ্ছন্ন পরিহাস বুঝতে পারলে কবেই অবশ্য শেষ হয়ে যেত এই দ্বন্দ্ব। নিজের পরিপূর্ণতার মধ্যে নয়, সৌন্দর্য খুঁজে নিতে হয় বলিরেখায়, পাকা চুলে, পঙ্গুতায়, অযতেœ আর বাস্তবধর্মিতায়। এই এক একটি অপূর্ণতাই এক একটি বৈশিষ্ট্য আমাদের, যা বিবিধের মাঝেও তুলে ধরে অমৃতসোপান।

তাই সব পরিহাসকে হেলায় হারিয়ে সৌন্দর্যের নিরিখে জিতে যায় মানুষী, ম্যাগলিনরাÑ জিতে যায় অপূর্ণতা, আর অবশ্যই জিতে যায় অ্যাস্থেটিকসÑ ‘নন্দনতত্ত্ব’।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close