আহমেদ শরীফ শুভ

  ২৬ এপ্রিল, ২০১৯

নন্দিতা নাজমার গল্পের অন্দরমহল

কবি, গল্পকার ও কথাসাহিত্যিক দীলতাজ রহমানের বদান্যতায় নন্দিতা নাজমার গল্পগ্রন্থ ‘প্রত্যাবর্তনের পর’ হাতে পেলাম। নন্দিতা নাজমার গল্প আগে পড়া হয়নি। পড়ে চমৎকৃত হলাম।

নয়টি গল্পে সাজানো হয়েছে ‘প্রত্যাবর্তনের পর’। প্রতিটি গল্পের প্রায় সবগুলো অনুষঙ্গই উঠে এসেছে নামগল্পে। এ গল্পের নামেই বইটির নামকরণ তাই যথার্থ মনে হয়েছে। নন্দিতা নাজমার গল্প বলার একটি নিজস্ব ঢং আছে, যা পাঠককে সহজেই আকৃষ্ট করে, গল্পের গভীরে নিয়ে যাবে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সদর দরজা দিয়ে না ঢুকে গল্পের অন্দরমহলে প্রবেশ করতে হচ্ছে পার্শ্ব-দরজা কিংবা জানালা দিয়ে।

পাঠককে বিকল্প পথে অন্দরমহলে টেনে আনার কৌশলটি ভালো লেগেছে। প্রবেশপথেই একটা রহস্যের হাতছানি, যদিও গল্পগুলোকে ‘রহস্য গল্প’ বলা যাবে না। লেখিকার গল্প বলার ঢংই এমন। প্রথম থেকেই একধরনের রহস্যময়তা কাজ করবে। পাঠকের আকৃষ্ট না হয়ে আর উপায় থাকে না।

গল্পগুলোর বিষয়বস্তু পরিচিত ঘটনা। এসব ঘটনা আমাদের চারপাশে ঘটলে আমরা কখনো দেখে না দেখার ভান করি, কখনো অতিপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি আবার কখনোবা খরগোশের মতো নিজের মাথা লুকিয়ে রেখে বাস্তবতা অস্বীকার করি। কিন্তু নন্দিতা নাজমা এ বাস্তবতার রোজনামচাগুলোই গল্পের মতো করে আমাদের সামনে তুলে এনেছেন। পড়তে পড়তে মনে হবে, ‘আরে, এটা তো আমার অমুক বন্ধুর ঘটনা কিংবা পাশের বাড়ির

গল্প। এমনটা যে হতে পারে, তা তো

ভেবে দেখিনি!’

এসব ভাবতে ভাবতেই পাঠক পাশর্^-দরজা দিয়ে পরের গল্পে ঢুকে যাবেন। গল্পগুলোর গতিপথ মসৃণ হলেও তাতে ক্ষণেই ক্ষণেই বাঁক দেখা যাবে। এ বাঁকগুলোই গল্পকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। একেবারে শেষ দিকে পাঠক যখন গল্পটির পরিণতি সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ঠিক তখনই গল্পকার তীক্ষè একটি বাঁকের অবতারণা করে তাকে

চমকে দিয়েছেন।

নন্দিতা নাজমার গল্পে সমকালীন সমাজের চালচিত্র ও অবক্ষয়, অসংগতি, নৈতিকতার দ্বন্দ্ব, সম্পর্কের বিন্যাস ও টানাপড়েন উঠে এসেছে স্বাচ্ছন্দ্যে। কোথাও কোথাও পরাবাস্তবতাও উঁকি দিয়েছে, কোথাও আবার একটি সামাজিক সমস্যা ও তার সম্ভাব্য সমাধানের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। তবে গল্পগুলোর একটি বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে মনোদৈহিক মনোস্তত্ত্ব ও দ্বিধার সংঘাত। কিন্তু কখনো কখনো মনে হয়েছে তিনি সজ্ঞানেই এ সংঘাতের একটি সমাজগ্রাহ্য পরিণতি দিয়েছেন। কিন্তু মনোদৈহিক দ্বন্দ্বের আবর্ত কখনো-সখনো সমাজগ্রাহ্যতাকে উপেক্ষা করে, বিষয়টি তিনি সযতেœ এড়িয়ে গেছেন। এখানে এসে পাঠকের একটু খটকা

লাগতে পারে।

লেখকের শব্দবিন্যাস আধুনিক হলেও প্রাঞ্জল। আমাদের চিরচেনা বাচনরীতিকেই তিনি অবলম্ব^ন করেছেন। ‘ফষ্টিনষ্টি, ব্যক্কল, কারেন্ট চলে যাওয়া’ (শুদ্ধতর ‘ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়া’ নয়) শব্দগুলো পড়লে মনে হবে আমরা আমাদের ড্রয়িং রুমে বসে গল্পের চরিত্রগুলোর সঙ্গে সংলাপ কিংবা ভাব বিনিময় করছি। কোথাও কোথাও অবশ্য প্রচলিত অভিব্যক্তি প্রকাশে অসংগতি লক্ষ করা গেছে। ‘চেনা অচেনা মানুষ’ গল্পে ‘বারংবার’-এর বদলে ‘বারবার’ কিংবা ‘সে এক অলৌকিক সুবাস’ গল্পে ‘রেখে আসমু’র বদলে ‘রেখে আসবো’ বা ‘রাইখা আসমু’ অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো বলে মনে হয়। কাহিনিবিন্যাস প্রায় সর্বত্র নিখুঁত হলেও ‘ঊর্মিলা এবং ঢেউ’ গল্পে কবিরের কাছে ঊর্মিলার শারীরিক আত্মসমর্পণের গতি একটু বেশি ত্বরিত মনে হয়েছে। তবে গল্পগুলোর সামগ্রিক মানের কাছে এসব আপাত অসংগতি একেবারেই গৌণ।

ছয় ফরমার ‘প্রত্যাবর্তনের পর’ প্রকাশ করেছেন প্রকাশ পাবলিকেশন্সের পক্ষে শফিক হাসান। মোস্তাফিজ কারিগরের আঁকা প্রচ্ছদ বইটির সৌন্দর্যকে ধারণ করেছে যথার্থভাবে। অঙ্গসজ্জায় যতেœর ছাপ আছে। গল্পগ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করি। গল্পকার নন্দিতা নাজমার প্রতি শুভ কামনা। তার আরো গল্প পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close