অলোক আচার্য

  ২৬ এপ্রিল, ২০১৯

সাহিত্যে রসামৃত

সাহিত্যে রসবোধ নিয়ে ছোট্ট একটা কৌতুক আছে। সেটা দিয়েই শুরু করি। একবার এক রাজা এক লাইনের কবিতা লিখে আনতে বললেন। কিন্তু কবিতার ভেতর রস এবং চরণ থাকতে হবে। বাঘা বাঘা কবিরা রাজাকে হতাশ করলো। এক বুদ্ধিমান ব্যক্তি শুধু এক লাইনের কবিতা লিখে আনলো। কবিতাটা ছিল ‘বিড়াল মিষ্টি খায়’। কবিতা শুনে রাজা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। কবিতায় রস কোথায়? রাজা প্রশ্ন করলেন। বুদ্ধিমান ব্যক্তি বললেন, কেন মহারাজ, মিষ্টিতে তো যথেষ্ট রস রয়েছে। রাজা হতভম্ভ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে কবিতার চরণ কোথায়? এবারও বুদ্ধিমান ব্যক্তিটির উত্তর, ‘মহারাজ ভুলে গেলেন বেড়ালের চারটি চরণ রয়েছে।’ তা হলে আর চরণ দিয়ে কী হবে? এই কৌতুকটা অনেকেরই জানা আছে। তবে প্রাসঙ্গিকক্রমেই আনলাম। মিষ্টির মতো রস আস্বাদন সাহিত্য থেকে করা যায় কি না, তা অবশ্য ব্যক্তিবিশেষের ব্যাপার। তবে সাহিত্যপ্রেমিক মাত্রই সেই রস আস্বাদন করে থাকেন এবং তৃপ্তি পেয়ে থাকেন। সাহিত্য মাত্রই রস থাকবে। খুব দুর্বোধ্য টাইপের কোনো বিষয় হলে সেখান থেকেও কেউ কেউ রসের স্বাদ পান। তবে এই স্বাদ জিহ্বার নেওয়া স্বাদ নয়। মনের খোরাক জোগাতে, আত্মার পরিতৃপ্তি সাধনের জন্য এই স্বাদ গ্রহণ। পেটের ক্ষুধার আপাত সীমাবদ্ধতা থাকলেও মনের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন চলে না। তা চলতে থাকে অবিরাম। ভালো ভালো খাবার সামনে পেলে জিহ্বা যেমন সত্তর সেগুলোর স্বাদ আস্বাদন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তেমনি সাহিত্য নামক মনের খোরাক সামনে পেলেও অন্তর্দৃষ্টি সেগুলোর স্বাদ নিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। সাহিত্যে শরীর ভালো রাখার উপায়ও কিন্তু রয়েছে। মজার কোনো গল্প, কবিতা বা ছড়া যদি পাঠ করি, তা আমাদের প্রাণ খুলে হাসাতে পারে। আর হাসি হার্টের জন্য উত্তম চিকিৎসা। আবার এ রকম মজার কোনো কিছু পাঠ করেও কেউ মুখ গোমড়া করে থাকেন। কিছুতেই তার মন ভালো হয় না। তিনি হলেন গোমড়ামুখো লোক। তিনি সাহিত্যের রস আস্বাদনে ব্যর্থ। সাহিত্যের রস আস্বাদনের ক্ষমতা সবারই থাকে না। আবার যারা একবার এই রসের স্বাদ আস্বাদন করেন, তারা সাহিত্যেই মজে থাকেন সারাক্ষণ। এদিক থেকে বাংলা সাহিত্যের রম্য লেখকরা এগিয়ে আছেন। কারণ রম্য লেখকদের লেখায় রসের পরিমাণ একটু নাকি বেশিই থাকে। উদাহরণস্বরূপ সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘রসগোল্লা’ রচনার কথা উল্লেখ করা যায়। বাংলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি রসগোল্লায় যে পরিমাণ রস রয়েছে লেখকের রচনাতেও তার থেকে কম রস নেই।

যারা নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করেন, সেটা তার কাছে একটা নেশার মতো। একজন কবি কবিতা লিখে যান, গল্পকার গল্প লিখে যান, ঔপন্যাসিক উপন্যাস লিখে যান মনের আনন্দে। জন্ম হয় ‘পদ্মা নদীর মাঝির’ মতো কোনো অমর সৃষ্টি। যা পাঠক পাঠ করে রস আস্বাদন করেন। লেখায় আকর্ষণের ক্ষমতা অবশ্য লেখক-কবিভেদে কম-বেশি হয়ে থাকে। লেখা ক্রমাগতভাবে পাঠককে ভেতরের দিকে টানবে। রসের খোঁজে গভীর থেকে গভীরে নিয়ে যাবে। সব লেখকের সে ক্ষমতা থাকে না। ঠিক যেমন কোনো সুস্বাদু খাবার পেলে সেটা গোগ্রাসে গিলতে থাকে তার স্বাদ আস্বাদনের নিমিত্তে, ঠিক তেমনি করেই কোনো ভালো লেখা অবশ্যই পাঠককে টানবে যতক্ষণ না তা শেষ হচ্ছে। বহু বছর আগে ‘আরণ্যক’ বইটি আমাকে যেভাবে টেনেছিল। প্রথম দিক থেকে যত ভেতরের দিকে যাচ্ছিলাম, কী এক দুর্নিবার আকর্ষণ আমাকে টানছিল ভেতরের দিকে। বারবার মন বলছিল এ স্বাদ তোকে নিতেই হবে। তাই শত কাজ ফেলেই শেষ করেছিলাম বইটি। তারপর বহুবার বহু বইয়ের ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে। আজকাল বহু সাহিত্যচর্চা হচ্ছে। সাহিত্যচর্চার প্ল্যাটফরমও বেড়েছে অনেক। বইমেলায় বইয়ের স্টল বরাদ্দের সংখ্যা বছর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রচুর বই আসছে। নতুন নতুন লেখকও আসছেন। আসছেন আবার মিশেও যাচ্ছেন। আসলে লেখক তো কাগজের পাতায় থাকেন না, লেখকদের বাঁচতে হয় পাঠকের হৃদয়ে। আজকাল সেই চেষ্টা না করে বরং বইয়ের পাতার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। বই বের করাটাও আজকাল বেশ সহজ। বহু প্রকাশনী আছে। বই প্রকাশ করার জন্য মুখিয়ে থাকে। মোটা পকেটওয়ালা লেখক নিজের টাকায় বই প্রকাশ করেন। তারপর সেসব বইয়ের কয়েকটা সৌজন্য কপি পরিচিতজনদের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করেন। বইমেলায় তার বই কত কপি চলেছে, আদৌ কেউ কিনেননি তার কোনো হিসাব রাখেন না। দরকারও হয় না। কারণ তার উদ্দেশ্যই ছিল বই প্রকাশ করা। লেখক বা কবি হওয়া নয়। উদ্দেশ্য তো পূরণ হয়েছে। প্রকৃত পাঠক অবশ্য সেই রসের খোঁজেই ঘুরে বেড়ায়। যে বই থেকে সে রস পায়, তাই কিনে বাড়ি ফেরে। সে কোনো অখ্যাত লেখক কবি হলেও।

সাহিত্যে রসবোধ নিয়ে বহু কথা হলো। প্রকৃত কথা হলো, সাহিত্যের ভেতর কেউ আনন্দ পান, কেউ পান না। যারা পান না তারা এর রসের খোঁজ পান না। এ যুগে অবশ্য সেই সংখ্যাই বেড়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা হওয়াতে বই পড়ার পাঠকের সংখ্যা কমে গেছে। বইয়ের কাজটা মোবাইল বা ট্যাবে করে নিচ্ছে। তবে সেই সঙ্গে কমেছে পাঠকের সংখ্যা। সবাই যদি লিখতে চান, তা হলে পাঠক কে হবেন। কবির বেঁচে থাকার জন্য যে পাঠকের খুব দরকার। দেশের সবাই গায়কের মতো দু-চার লাইন কবিতা যে লিখি না তা নয়, কিন্তু সেসব অন্যকে বোঝানোর জন্য আবার ফেসবুকে ছেড়ে দেই। তাতে আবার বুঝুক বা না বুঝুক লাইকের হিড়িক পড়ে যায়। সেখানেও কিন্তু রসবোধ আছে। রস না থাকলে কি আর কেউ যায়!

শেষমেশ সাহিত্যে রসের খোঁজ দিয়ে শেষ করি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তৈলবিষয়ক একটি রম্য রচনা রয়েছে। এ রচনার প্রতিটি লাইনেই রসের উপস্থিতি। তৈল রচনার একটি অংশ এ রকমÑ ‘কে যে তৈল দিবার পাত্র নয় তাহা বলা যায় না। পুঁটে তেলি হইতে লাট সাহেব পর্যন্ত সকলেই তৈল দিবার পাত্র। তৈল এমন জিনিস নয় যে নষ্ট হয়। একবার দিয়া রাখিলে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ফল ফলিবে। কিন্তু তথাপি যাহার নিকট উপস্থিত কাজ আদায় করিতে হইবে, সেই তৈলনিষেকের প্রধান পাত্র। সময়-যে সময়েই হউক, তৈল দিয়া

রাখিলেই কাজ হইবে। কিন্তু উপযুক্ত সময়ে অল্প তৈলে অধিক কাজ হয়।’ সময় পাইলে তৈলবিষয়ক রচনার পুরোটা পড়িয়া রস আস্বাদনের জন্য তৈল দিয়া রাখিতেছি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close