জোবায়ের মিলন
আম্মা
আগেই জানতাম এবার ফার্স্টক্লাস আমারই হবে। তাই রেজাল্টের দিন তেমন পেরেশান না হয়ে আস্তে ধীরে বাসা থেকে বের হয়ে মোড়ে জগলুর দোকানে এক কাপ রং চা পান করে হাঁটা দিলাম চানখারপুলের দিকে। ভাঙাপ্রেস থেকে চানখারপুল কাছের পথ না। না হোক। আমার কিছু যায় আসে না। দুই চার কিলোমিটার পথ গ্রীষ্ম কি বর্ষায় পাড়ি দেওয়া কঠিন কিছু না। এটা আমার মাঝে-মধ্যের অভ্যাস অথবা ভালো লাগা। একবার কুমিল্লার শ্রী নারায়ণ কান্দি থেকে ভরদুপুরে হাঁটা দিয়ে ডেমরার রসুলবাগ পৌঁছে ছিলাম দুই প্রহরে। এসে যদিও চিকনগুনিয়া জ্বরের মতো গিঁটে গিঁটে ব্যথা আর সর্দি নিয়ে চার দিন বিছানায় পড়ে ছিলাম তাতে আমার ভোগান্তি মনে হয়নি বরং ন্যাচারাল বলে এ অভ্যাস বজায় রেখেছি। আছে। যখন যেদিন ইচ্ছা হয় সেদিনই এ কাজটা করতে আনন্দ পাই। আজ জ্যৈষ্ঠের মধ্য তারিখ। আম-কাঁঠাল পাকার রোদ ফোসকা ফেলে দিচ্ছে মনুষ্য চামড়ায়। উপড়ে যেমন গরম তেমনি পিচের থেকে উঠে আসা তাপ আর সহ্য হয় না। তাতে দ্বিধা নেই। আমি আমার মতো কখনো ফুটপাতে, কখনো রাস্তার পাশ ধরে হাঁটা শুরু করেছি। রিকশার টুংটাং, টেম্পোর ঘটঘট, বাসের হর্ন মানুষের ধাক্কা, বিরক্ত করে না আমাকে। আমি আমার মতো।
২.
সন্ধ্যা। ঠিক এক বছর আগে যে বাড়িটিতে আজকের দিনে হুল্লোড়ের কমতি হতো না, সে বাড়িতে সুনসান নীরবতা। অন্য পাঁচ-সাত দিনের মতো আলো জ্বলছে, ফ্যান ঘুরছে, টিভি চলছে। কোথাও কোনো ব্যতিক্রম নেই। শুধু দক্ষিণের যে কক্ষটিতে একটি মুখে মৃদু চিন্তাগ্রস্ত রেখা, চোখে জিজ্ঞাসা, মনে উদ্বেগ তার পা ছুঁয়ে জানালাম, ‘আম্মা আমি ফার্স্টক্লাস পাইছি। বলছিলাম না, আমিই পামু। সঙ্গে ডিটার্টমেন্টের রেকর্ড মার্কও ভাঙছি।’ আম্মার গাল গড়িয়ে কয়েক ফোঁটা চোখের জল গলা স্পর্শ করলে আমি আর সেখানে বসে থাকতে না পেরে আমার কক্ষে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। কতক্ষণ, তা আমার জানা নেই। আম্মা বিছানা থেকে উঠত পারলে এতক্ষণ দরজা বন্ধ রাখা সম্ভব হতো কি না জানি না। তিনি তার বিছানায়ই বসে রইলেন।
আব্বা গত হলেন যে এক বছর তারপর থেকে আম্বা শয্যাগত। ব্রেনস্ট্রোক করে বাকশক্তি হারিয়ে প্রায় অবশ শরীরটা নিয়ে বেঁচে থাকা মাত্র। অথচ একদিন তিনি ডিস্ট্রিক জজ থেকে যেমন পুরো জেলা সামলিয়েছেন কঠিন হাতে, তেমনি বিংশ শতাব্দীর নাগরিক জীবনে পাঁচ-পাঁচজন ছেলে মেয়ে উচ্চশিক্ষিত করেছেন নিজের শ্রম আর দক্ষতায়। এখন তারা কেউ নানা প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তা আবার কেউ নিজেরাই প্রতিষ্ঠানের মালিক। তাদের প্রত্যেকেরই এই শহরের অভিজাত এলাকায় বসবাস। আম্মা আব্বার গড়া এই বাড়িটা ছেড়ে কোথাও যেতে চাননি বলে কেউ তার সঙ্গেও থাকতে অপারগতা স্বীকার করেননিÑ স্ত্রী আর সন্তানদের সমূহ ভবিষ্যৎ ভেবে। আমরা পাঁচ ভাই-বোন এখানেই বড় হয়েছি। এ কথা আম্মা বলেন। পাশের ঘর থেকে আসা অনুচ্চারিত শব্দ শুনে নিজের চোখ মুছে আম্মার কাছে গিয়ে দেখলাম, আম্মাও জোরে জোরে কাঁদছেন। আমরা দুজনে একসঙ্গে আবার অনেকক্ষণ কাঁদলাম।
৩.
রাতের দ্বিপ্রহরে আমার ভাই বোনদের সেল নম্বর আমার ছোট্ট ফোনটিতে ভেসে উঠতে লাগলো। তারা সবাই আমাকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দিত করলো স্বরভরে কিন্তু কেউ আমাকে দেখতে এলো না। পরদিন সকালে আমি যখন আবার ক্যাম্পাসে উপস্থিত হলাম, রিতা আমাকে তিনশ তিনটি গোলাপ উপহার দিয়ে শুভেচ্ছা জানালো এবং একটি প্রস্তাব দিয়ে তার কথা শুরু করলো। গোলাপ আমার প্রিয় ফুল হলেও প্রস্তাব মতে রিতার বাবার সঙ্গে দেখা করা ও তাদের ‘চট্টগ্রাম ইস্পাত অ্যান্ড স্টিল মিলস্’-এ জয়েন করার কথাটি প্রিয় লাগলো না। জানিয়ে দিলাম, আম্মাকে ফেলে অতদূর গিয়ে চাকরি করা অসম্ভব। প্রেমিকার কোমল স্বরের প্রস্তাব প্রেমিক ফিরিয়ে দিলে প্রেমিকার মনের অবস্থা কী হয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রিতা সেই দিনের মতো আমার সঙ্গে আর তেমন কথা না বললেও পরের এক বছর বোঝাবার চেষ্টা করলো, এ না হোক অন্য কিছু? বেটার দ্যান প্রাইভেট টিউশন ওয়ার্ক! মেজো আপার শ্বশুর আমাকে স্নেহচোখে দেখেন অনেক আগ থেকেই। কন্যায় ভাবনাপ্রস্থ পিতা বলে কি না জানি না। তিনি জার্মান থেকে স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে ওখানেই আরো পড়াশোনার সুযোগ জানিয়ে যে ফোনালাম করলেন তা আমি সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করে ‘দেখি’ বলে কথা থামালাম। আমার বায়োকেমেস্ট্রি বিভাগের প্রধান রণোজিৎ স্যার তার সেলফোন থেকে কল করলেন কয়েকবার। দেখতে পাইনি। শেষবার কলটি রিসিভ করলে জানালেন, এ বছর আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড সুইডিশ কোম্পানি ‘অরবিট’ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে যে রিকোয়ারমেন্ট দিয়েছিল তার প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাইমারি রিসার্চার হিসেবে আমাকে মনোনীত করেছে এবং তারা চায় আমি যেন যতসম্ভব দ্রুত মতামত জানিয়ে মেইল করি। করিনি। বড় ভাইয়া, আমরা যাকে বড় দাদা বলে ডাকি, এসব শুনে অনেকটা রাগ করে আমাকে তার অফিসে ডাকলেন। ওইদিন বিকাল হবার আগেই আমি উপস্থিত হলাম এবং জানতে পারলাম, দাদা জরুরি মিটিংয়ে। অপেক্ষার ধৈর্য ক্ষীণ হয়ে এলে অবশেষে দাদা বের হয়ে আমার হাতে একটি খাম ধরিয়ে দিলেন। ‘এটা কী বড় দাদা?’ পড়ে দেখ। ‘আপনাকে পরবর্তী মাসের প্রথম দিন থেকে আমাদের সঙ্গে পেলে আমরা আন্তরিক খুশি হবো। আপাতত আপনাকে আমাদের খুলনাস্থ রাবার-বন প্রজেক্টে নিযুক্ত করা হলো।’ কম্পোজ করা সুশ্রী পত্রটি খামের ভেতর ঢুকিয়ে ফিরিয়ে দিলাম। বললাম, মনে হয় পারছি না। কেন? বিশেষ কোনো কারণ? ‘আম্মা’। শব্দটি শুনে বিগলতি হবার বদলে বড় দাদা উচ্চকণ্ঠেই বললো, ‘আম্মা’ বুঝি তোর একার? আমাদের না?... আমি মনে মনে বললাম, হ্যাঁ ‘আম্মা’ আমাদের সবার! সেই দিনই বনানী থেকে পায়ে হেঁটে বাসায় ফেরার পথে ছোট আপাকে দেখলাম, তারা শপিংয়ে যাচ্ছে। কথা হলো না। আমি বাড়ি ফিরে এলাম।
৪.
কখনো পুকুরের ছোট ছোট ঢেউ, কখনো নদীর মাঝারি ডাক, কখনো সৈকতে আছড়ে পড়া সাগর ঢেউয়ের মতো সময় চলতে থাকলো। এখন পথে নামতে আমার ভয় হয়। যার সঙ্গেই দেখা হয় সেই আমাকে কিছু না কিছু পরামর্শ দেয়। শিশু বা অবুঝ ভেবে গায়ে হাত দিয়ে অনেক কিছু বোঝায়। কেন চাকরি হচ্ছে না, কেন চাকরি করছি না, বিয়ে-শাদি করতে হবে, বয়স বেড়ে গেলে সমস্যা নানাবিধ সু-কথা। আমি শুনি। আমি বলি না। আমার ভয় হয়। চাকার ভেতর ঢুকলে যদি আমিও যান্ত্রিক চাকা হয়ে যাই, যেমন আমার ভাই বোনেরা! লোভের গহ্বরে প্রবেশ করলে আমিও যদি উচ্চশিক্ষিত অমানুষ হয়ে যাই! আমার প্রিয়তমাও যদি আমাকে নিয়ে একাকিত্ব চায়! আমিও যদি হয়ে উঠি অকৃতজ্ঞ সন্তান! আমার ভয় হয়!
দুই বছর পর। ক্লান্ত রিতা জানিয়ে দিলো, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা বা এর চেয়ে ঊর্ধ্বে আসীন করা তার দ্বারা সম্ভব নয়। সামনের শ্রাবণ শেষে বিয়ে। পাত্র বৈদেশে বিত্তবান।... আমি নিশ্চুপ শুনলাম। জানি, ‘অরবিট’-এ যাওয়া আমার দ্বারা যেমন সম্ভব হয়নি, রাবার প্রজেক্ট যেমন গ্রহণ করিনি, রিতার সম্ভবের মধ্যে প্রবেশ করাও আমার দ্বারা সম্ভব নয়। অসম্ভবের পথ আমি জেনে-শুনেই ঠিক করেছি।...রিতার চোখে জল। আমার চোখে জল। রিতা কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ‘আসি’ বলে পা বাড়ালো সামনে। আমি রিতার পেছনে। রিতা সামনে যায়। আমাদের দূরত্ব বাড়ে। বিএমডব্লিউ গাড়িটা ফুলার রোড থেকে নীলক্ষেতের দিকে টার্ন নিলে তাকিয়ে রইলাম ততক্ষণ যতক্ষণ গাড়িটা দেখা যাচ্ছিল। আমি রিতার মুখটা শেষবারের মতো চোখে ভাসাতে চেষ্টা করছিলাম কিন্তু আমার চোখে তিমি মাছের মতো বারবার ভেসে উঠছিল বিছানায় পড়ে থাকা প্যারালাইজ্ড সাবেক ডিস্ট্রিক জজ, পাঁচ-পাঁচজন উচ্চশিক্ষিত জনের জননী আম্বিয়া খাতুনের মুখটা। আমি আবার চেষ্টা করলাম, আবার আমার চোখের ভেতর ভেসে উঠলো আম্মার মুখটা।...আমি দেখছিলাম আমাকেও। আমার ভেতরের আমাকে। সে প্রচ- ঘামছে। লবণ জল তাকে ভাসিয়ে নিচ্ছে, সে দাঁতে দাঁত চেপে একটি অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ সইছে। কিন্তু সে কাঁদছে না। শুধু সে টের পাচ্ছে তার চোখের জল থেকে নাশিকা রন্ধ্রে প্রবেশ করছে তার আম্মার গায়ের গন্ধ।
"