আবদুস সালাম

  ১৯ এপ্রিল, ২০১৯

আশ্রয়

ছেলেবেলার স্মৃতিবিজড়িত শশীপুর গ্রামের কথা মনে পড়লে শাহেলের হৃদয়ের এক প্রান্ত হু হু করে ওঠে। শশীপুরে যাওয়ার জন্য তখন তার মনটা আনচান করতে থাকে। ঠিক একই সময় হৃদয়ের অপর প্রান্ত চোখ রাঙিয়ে বলে, ‘খবরদার যাবি না! তোর মায়ের নিষেধ আছে। ওখানে গেলে তোর মায়ের আত্মা কষ্ট পাবে।’ শাহেল নিজেকে প্রশ্ন করে আর ভাবে, মা যেসব কারণে আমাকে শশীপুরে যেতে নিষেধ করেছিল তার মধ্যে প্রধান কারণ ছিল আমার নিরাপত্তা। কেউ যেন আমাকে গালি দিতে না পারে। গায়ে হাত তুলতে না পারে। জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তার মা যে এসব কথাগুলো বলেছিল তা বুঝতে শাহেলের আজ আর কষ্ট হয় না। তার বাবা জয়নাল সরকারকে গ্রামের লোকে এখনো এক নামে চেনে। সে একসময় গ্রাম সরকার ছিল। সেই সুবাদে গ্রামে তার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। আর তার মা ছিল দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তবে বেশ সুন্দরী ছিল। বাবার নজর যে ধনসম্পদের দিকে ছিল না তা খুব সহজেই বোঝা যেত। বাবার দেখানো সুখস্বপ্নের কথা বিশ্বাস করে শাহেলের মা জয়নাল সরকারকে বিয়ে করেছিল ঠিকই কিন্তু স্ত্রীর হিসেবে কোনো অধিকার স্বামীর কাছ থেকে আদায় করতে পারেনি। এমনকি শাহেলের জন্মের পরও তার মা সেই অধিকার আদায় করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। স্বামী, সতীন ও তাদের ছেলেদের নানারকম নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। নির্যাতন সহ্য করেও শাহেলের মা চেষ্টা করেছিল স্বামী সংসারে একটু ঠাঁই করে নিতে। বুকের মধ্যে পরমযতেœ বপন করা ভালোবাসার বীজ কখনো অঙ্কুরিত হয়নি। কিন্তু সেই পরিস্থিতি তো এখন আর নেই। তা হলে কেন যাব না শাহেল? হৃদয়কে সে অনেকবার প্রবোধ দিয়েছে। অনেকবার মনে মনে করেছে অন্তত একবারের জন্য হলেও শশীপুরে যাবে। দেখে আসবে কে কেমন আছে। হৃদয়ের দো-টানায় শেষ পর্যন্ত তার আর যাওয়া হয়নি।

দাফতরিক কাজে শাহেল গত দুই দিন আগে খুলনাতে এসেছে। গ্রামের বাড়ি খুলনা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তাই খুলনাতে এলে তার গ্রামের কথা খুব মনে পড়ে। হঠাৎ সাতসকালে কে যেন তার মোবাইলে বারবার কল দিচ্ছে। অপরিচিত নম্বর হওয়ায় সে কলটা রিসিভ করছে না। কিন্তু তাতে কী হয়েছে? কলটা রিসিভ না করায় তার মনটা বড্ড অস্থির অস্থির লাগছে। এবার রিংটোন বাজার সঙ্গে সঙ্গে শাহেল মোবাইলটা রিসিভ করে। অপরপ্রান্ত থেকে একটা পুরুষকণ্ঠ বলে, ‘বাবা, শাহেল বলছ?’ ‘জি বলছি।’ ‘আমি শশীপুর থেকে তোমার ছোট চাচা রইছ উদ্দিন বলছি। একটা সংবাদ দেওয়ার জন্য খুব কষ্ট করে তোমার নম্বরটা জোগাড় করলাম।’ ‘জি বলেন?’ ‘আজ ভোররাতে তোমার বাবা মারা গেছে। জোহরের নামাজের পর মাটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি আসতে চাইলে আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করব।’ হঠাৎ দুঃসংবাদ শুনে তার হৃদয়টা দুমড়ে-মুচড়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তরে বলল, ‘অপেক্ষা করার দরকার নেই। আমি তার আগেই পৌঁছে যাব।’ খুলনা থেকে শশীপুর ঘণ্টা তিনেকের পথ। দেরি না করে সে অফিসের গাড়ি নিয়ে শশীপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়। অনেক দিন পরে আজ সে গ্রামে যাচ্ছে। মাথায় দুশ্চিন্তার পাহাড়। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে সে গ্রামের ভেতর প্রবেশ করল। শাহেলের হৃদয়ে বিশ বছর আগের শশীপুরের যে পথ-ঘাট, ঘরবাড়ি ও গাছপালার চিত্র অঙ্কিত আছে তা আজ বাস্তবের সঙ্গে কোনোই মিল নেই। সবকিছুই তার কাছে অপরিচিত। পথচারীদের কাছে জিজ্ঞাসা করেই শেষ পর্যন্ত তাকে বাবার বাড়িতে পৌঁছাতে হলো।

শেষবারের মতো বাবার মুখটা দেখে নিল শাহেল। খাটিয়ার পাশে বৈমাত্রেয় ভাইবোনদের আহাজারি। পাড়ার মুরব্বিরা সৎমাকে সান্ত¡না দিচ্ছে। কান্নার শব্দে চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। কিন্তু শাহেল চেষ্টা করেও কাঁদতে পারে না। এক ফোঁটাও অশ্রু জমা হয়নি চোখের কোণে। তাই নিজেই নিজেকে নিঠুর বলে ধিক্কার দিচ্ছে। উঠানের একপ্রান্তে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। ওদিকে শাহেলের আসার কথা শুনে তাকে একনজর দেখার জন্য গ্রামের লোকজনরা ভিড় করতে থাকে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকজনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বাবার মৃত্যুতে তার চোখে জল না থাকার কারণে অনেকে আবার কটূক্তি করতেও ছাড়ছে না। নানানজন নানান কথা বলে। অনেক কথা বাতাসে ভর করে তার

কানে প্রবেশ করছে।

যথাসময়ে বাবার দাফন হওয়ার পর শাহেল আবার বাড়িতে ফিরে আসে। তাকে আসতে দেখে কে যেন বাড়ির ভেতর থেকে একটা চেয়ার বের করে দিল। সে বুঝতে পারে ঘরের ভেতরে এখনো তার বসার অধিকার নেই। সে বাবার বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে করতে ভয় পাচ্ছে। শাহেল যখন চেয়ারে বসেছিল তখন ব্যথাতুর স্মৃতিগুলো স্মৃতির আঙিনায় নৃত্য করতে শুরু করে। ঘুমটা খুলে স্মৃতি একের পর এক উঁকি মারে। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠেÑ বৈমাত্রেয় বড় ভাই এবং সৎমায়ের চুলের মুঠি ধরে তার মাকে বেদমভাবে প্রহার করার দৃশ্য। আর তা দেখে ভয়ে পালিয়ে যায় সে। ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে একসময় ভয়ে ভয়ে আবার বাড়িতে ফিরে আসে। তার বাবা সবকিছু জানার পরও কিছু না বলে চুপ করে থাকে। বাবার বাড়ি থেকে মায়ের সঙ্গে বিদায় নেওয়ার দৃশ্যটাও চোখের সামনে অবিকলভাবে ভেসে ওঠে। শরীরটা ভালো না থাকায় সেদিন তার খুব ইচ্ছা করছিল একটু দুধ পান করার। সামান্য পরিমাণ দুধ বাটিতে নিয়ে তার মা তাকে পরমযতেœ খাওয়াচ্ছিল। সৎমা দেখে ফেলায় তার মায়ের ওপর ভীষণ রেগে যায়। দুধের বাটিটা লাথি মেরে ফেলে দেয় মাটিতে। কুরুচিপূর্ণ বিষবাক্যের কষাঘাতে তার মাকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। মা এর প্রতিবাদ করলে বড় ভাই তার মাকে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকে। একপর্যায়ে দুজন মিলে তাদেরকে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বাড়ির বাইরে বের করে দেয়। সেদিনও তার বাবা বাড়িতে উপস্থিত ছিল। কোনো প্রতিবাদ করেনি। নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে সবকিছুর মৌন সম্মতি জানিয়ে ছিল। মা কাঁদতে কাঁদতে তাকে নিয়ে সোজা নানার বাড়ি চলে যায়। এরপর থেকে আর কোনোদিন তারা শশীপুরে ফিরে আসেনি। শাহেলের সৎমা অনেকবার অভিযোগ করে তার মাকে বলেছে, ‘তুই জেনে শুনে সতীনের ঘর করতে এলি কেন? তুই আমার কপাল পোড়ালি কেন? এর জন্য তোকে সারা জীবন শাস্তি পেতে হবে।’ এসব কথার মানে সেদিন কিছুই বুঝত না শাহেল। তার মা বিদায় নেওয়ার পর থেকে আর কোনো অন্যায় শাস্তি মাথা পেতে নেওয়ার জন্য আর কোনো দিন ফিরে আসেনি এই বাড়িতে। সেই ঘটনার দিন দশেক পর তার মা শহরে এক সাহেবের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নেয়। সাহেব-বিবি দুজনাই ভালো ছিল। তারা তাদের খুব ভালোবাসতো। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে তার মা এক হাঁড়ি দুধ কিনে আনে শাহেলের জন্য। সে যখন দুধ খেয়ে শেষ করতে পারে না তখন কাঁদতে কাঁদতে তার মা অভিমানের সুরে বলেছিল, ‘খাবিনি কেন বল? এই দুধের জন্যই তো স্বামীর ঘর ছাড়েছি। এখন কেন বলছিস খাবি না?...’ উত্তরে সে বলেছিল, আর কোনো দিন দুধ খাব না, মা। আর কোনো দিন না।’ এই কথা শুনে সেদিন তার মা তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল। সাহেবের বাড়িতে কাজ নিয়ে তাদের ভালোভাবেই দিনগুলো চলে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই সুখও তাদের কপালে বেশি দিন টেকেনি। বছরখানিক পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার মা মারাত্মকভাবে জখম হয়। বলতে গেলে টাকার অভাবে এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় তার মা মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুর আগে তার মা সাহেবকে অনুরোধ করেছিল দয়া করে আমার ছেলেকে যেন একটু আশ্রয় দিয়েন। সাহেব তার মায়ের কথা রেখেছিল। মায়ের মৃত্যুর মাস তিনেক পর সাহেব যখন ঢাকাতে বদলি হয়ে গেল তখন তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। তারা কখনো তাকে মা-বাবার অভাবকে বুঝতে দিত না। নিজের ছেলের মতো করে মানুষ করেছে। তাই আজ সে প্রতিষ্ঠিত। বেদনাপূর্ণ স্মৃতিগুলো নদীর ঢেউয়ের মতো তার হৃদয়পাড়ে আছড়ে পড়ছে ক্ষণে ক্ষণে। অনেক দিন চেষ্টা করেছে এসব বেদনাবিধুর স্মৃতি ভুলে যেতে। কিন্তু ভুলতে পারেনি। নিষ্ঠুর স্মৃতিগুলো এভাবেই তাকে শাস্তি দিয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে। বাবার বাড়িতে বসে সেসব স্মৃতি শাহেলের খুব মনে পড়ছে। হাজার স্মৃতির সাগরে ডুবে থাকে সে।

কখন যেন আকাশের সূর্যটা পশ্চিমাকাশে পা বাড়িয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই আঁধারের অতল গহিনে হারিয়ে যাবে। একটা নারী কণ্ঠস্বর তার চেতনার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে বলে, ‘আজকে না হয় থেকে যেও?’ মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে একজন ভদ্র মহিলা তার পাশে দাঁড়িয়ে। শাহেল ওই ভদ্র মহিলাকে চিনতে না পারলেও একটু দূরে যে দাঁড়িয়ে ছিল তাকে ঠিকই চিনতে পারে। সে হলো তার সৎমা। এ ছাড়াও চেনা অচেনা অনেক মুখ তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। শাহেল মনে মনে ভাবে, আজ এই বাড়িতে থাকলে পুরাতন স্মৃতি তাকে দংশন করতে থাকবে বারংবার। না, তার মোটেও এখানে থাকা ঠিক হবে না। তাছাড়া মায়ের অধিকার ছিল না যে বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার, সেখানে আমি কোন অধিকারে থাকব? তাই শাহেল উত্তরে বলল, ‘আমাকে এক্ষুনি উঠতে হবে। অনেক দূর যেতে হবে।’

বাবার মৃত্যুর কথা শুনে শাহেলের চোখে পানি আসেনি ঠিকই। কিন্তু বাবার বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার সময় শত চেষ্টা করেও সে নিজেকে সংবরণ করতে পারে না। তার দুচোখ জলে ভরে যায়। দুচোখ মুছতে মুছতে গাড়িতে গিয়ে ওঠে। ধীরগতিতে গাড়ি চলতে থাকে। তার কাছে মনে হচ্ছিল, ভয়ংকর অক্টোপাস তার বুকের মধ্য থেকে কলিজা ধরে টানছে। সেদিন যাওয়ার পর আর কোনো দিন শাহেল শশীপুরে ফিরে আসেনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close