পারিজাত ব্যানার্জী

  ১৯ এপ্রিল, ২০১৯

৩টি গল্প

ফ্ল্যাশলাইটের অন্ধকার

শুটিংটা আজ মাঝপথেই শেষ হয়ে গেল। কনকবালা দেবী চেয়ারটা টেনে নিয়ে বাইরেই বসলেন কিছুক্ষণ। মেকআপ আর্টিস্টকে ইশারায় ডাকলেন। সুকন্যা মেয়েটির বছর ছাব্বিশ বয়স। প্রায় দৌড়ে চলে এলো কনকবালার সামনে। ‘হ্যাঁ ম্যাডাম, বলুন। মেকআপ কি তুলে দেবো এখনই?’

একটু থামলেন কনকবালা। মনে মনে বেশ কিছু কথা গুছিয়ে নিলেন। ‘না না। সুকন্যা, বরং দেখে নাও তো একবার, আমার কোনো টচ্ আপ্ দরকার কি না? আসলে, আমার একটা ইন্টারভিউ আর ফটোশুট আছে আজ। দেখো, যেন কোনো বলিরেখা বেমক্কা বেরিয়ে না আসে ছবিতে।’

সুকন্যা মিষ্টি করে হাসে। ‘ও নিয়ে ভাববেন না একদম। যা সকালে অ্যাপ্লাই করেছি, তাতে অন্তত বারো ঘণ্টা তো আর কিছুই করতে লাগবে না। ও নিয়ে ভাববেন না!’

কনকবালা হাসলেন। ভাবতে হয়। ওই নিয়ে ভাবতে হয়। রুপালি পর্দার সামনে দীর্ঘ চল্লিশ বছরের তার অভিজ্ঞতা বলে, ভাবার সময়ও অনেকদিন পেরিয়ে এসেছেন তিনি। অনেকেই তো ঠাট্টা-তামাশা করে। বলে, ওনার এখন বাণপ্রস্থে যাওয়া উচিত। কিন্তু তিনি যে তা পারেন না কিছুতেই! আচ্ছা, এই লড়ে যাওয়াটাই

কি তার অপরাধ?

হাত নেড়ে সুকন্যাকে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত

দেন কনকবালা।

সুকন্যা গ্রিনরুমে ঢুকতেই বরুণ সেন হাঁক পারেন, ‘কী বলছিলেন রে আমার ‘মা’! মা-ই বটে, আমি কাস্ট করলে অবশ্য ওনাকে ‘গ্র্যান্ডমা’ করতাম।’

পাশ থেকে অমৃতা সিগারেট ঠোঁটে পুরে এসে দাঁড়ায়। ‘এই বয়সেও যা দেমাক ওনার! ঠাকুরমার রোল দিলে হয়তো সেটই ভাঙচুর করে দিতেন!’ বড় ধোঁয়ার এক ঘূর্ণি মিলিয়ে গেল। বরুণ সেন আবেশে নিঃশ্বাস নিলেন।

‘তুমি ভুলে যাচ্ছো, ওই ভদ্র মহিলা আর সুধাকর বাবুর স্ত্রী নন। এই ইন্ডাস্ট্রিতে সুধাকর বাবুর সম্মান আছে আজও। উনি তাড়িয়ে দেওয়ার পর কনকবালার আর কিচ্ছু নেই। ওনার স্ট্যাটাস আজ জুনিয়র আর্টিস্টদের থেকেও শেকি। এর কাজটা তো শেষ পরের সপ্তাহে, মনে রেখো অমৃতা, আমি লিখে দিচ্ছি, উনি কিন্তু

তারপর বেকার!’

সুকন্যার ভালো লাগে না এই আলাপ-আলোচনা। সে নিজে দেখেছে, কনকবালা যথেষ্ট প্রফেশনাল। এই বয়সেও কলটাইমের আগেই চলে আসেন, কোনো ব্যাপারে খুঁতখুঁত করেন না। ছোটদের যথেষ্ট স্নেহও করেন।

হালকা প্রতিবাদ করে সে। ‘কিন্তু বরুণদা, একটা কথা ভুল বললে তুমি, ওনাকে কেউ তাড়ায়নি, উনিই সবকিছু ছেড়ে এক বস্ত্রে বেরিয়ে এসেছিলেন বলে শোনা যায়। সুধাকর বাবুর সেক্রেটারির সঙ্গে দুর্বল কোনো মুহূর্তে ম্যাডাম জেনে যান সব। এ নিয়ে তো খুব লেখালেখিও হয়েছিল সে সময়!’

বরুণ কিছু বলতে যায়। কথা আর এগোতে পারে না যদিও, কারণ ঠিক তখনই ঘটে মেঘনার প্রবেশ। বছর পঁয়ত্রিশের মেঘনাকে দেখলে বোঝারই উপায় নেই তার আসল বয়স। সুন্দরী তন্বী এই মহীয়সী প্রায় গোটা এক দশক ধরে কাজ করেছেন ইন্ডাস্ট্রিতে। তারপর হঠাৎ করেই সব ছেড়েছুড়ে উনি পাড়ি দেন দুবাইয়ে স্বামী রণজয়ের সঙ্গে। মেঘনার শ্বশুরমশাই শশাঙ্ক শেখর তৎকালীন সেচমন্ত্রী। ওনার কড়া নির্দেশ ছিল, বিয়ের পর আর অভিনয় জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে না। রাখেনওনি মেঘনা। তাই স্বেচ্ছায় এই দূরদেশে যাত্রা।

তবে সব ভালো হলেও শেষটা কিছুতেই মেলাতে পারেননি মেঘনা। অচিরেই তিনি জানতে পারেন রণজয়ের পূর্বতন স্ত্রীর কথা, যে তখনো কলকাতার বসতবাটীতে বাস করে। শুধু তাই নয়, রীতিমতো রণজয়ের স্ত্রীর অধিকার নিয়েই সে থাকে। তাদের ডিভোর্সটাই যে হয়নি কখনো!

মেনে নিতে পারেননি মেঘনা। চার মাসেই তাই বিবাহ বিচ্ছেদ।

কলকাতায় ফিরে এসে কাজে তিনি যোগ দিয়েছেন ঠিকই, তবে এরই মধ্যে অনেক কিছু বদলে গেছে যেন। কাজের সংস্থান কমেছে, অনেকেই এখন নতুনদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে অল্প মজুরিতে। আগেও হয়তো করাতো, কিন্তু খ্যাতির শীর্ষে থাকায় মেঘনা কোনো দিন তা টের পাননি। যারা কাজ দিচ্ছে, তাদের চাহনিও যেন পাল্টে গেছে। ‘আপনি’ থেকে তাদের ডাক সরাসরি ‘তুমি’তে নেমে এসেছে। তবু, তাদের ভোগ্যপণ্য যেহেতু এখনো হয়ে উঠতে পারেননি মেঘনা, তাই সোজা কথায়, তার বাজার মন্দা।

বরুণ অমৃতাকে সরিয়ে এগিয়ে যায় মেঘনার দিকে। ‘কী ব্যাপার? বাড়ি যাওনি এখনো? অথচ আমি যখন জিজ্ঞাসা করলাম, শুটিংয়ের পর ফ্রি কি না, মুখের ওপর যে না বলে দিলে?’

মেঘনা কঠোর দৃষ্টিতে তাকান। ‘তোমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য ‘ফ্রি’ নই আমি। এবার আশা করি বুঝেছো?’ সামনে এগোনোর জন্য পা

বাড়ান মেঘনা।

বরুণ দাঁড়িয়ে পড়ে সামনে। ‘দেখো, রাজনৈতিক পরিবারের সঙ্গে এই জন্য জড়াতে নেই। আর জড়ালেও তাদের লেজে পা দিতে নেই। তুমি সেই ভুলটাই করেছো। তোমার শ্বশুরকে তোমার জন্য পদত্যাগ পর্যন্ত করতে হয়েছে, এরপরও তোমার মনে হয়, এত সহজে টিকে যাবে তুমি? উনি বা রণজয় কোনো প্রতিশোধ নেবে না?’

মেঘনার দৃষ্টি জ্বলন্ত। ‘ব্যস, আর একটাও কথা নয়। আমার ব্যক্তিগত জীবন আমি তোমার সঙ্গে ভাগ করতে চাই না।’

হেসে ওঠে বরুণ। ‘ভাগ কে করতে বলছে? এ সবই তো আমাদের জানা! শুধু তুমি যেটা জানো না, তা হলো, এখনো সময় আছে, রাজি হয়ে যাও আমার বিয়ের প্রস্তাবে। তারপর তোমার

ওঠা কে...।’

কথা শেষ করতে পারে না সে। তার

আগেই মেঘনা দৃঢ় পদক্ষেপে প্রস্থান করেন গ্রিনরুম থেকে।

বাইরে তখনো চেয়ারে একলা বসে কনকবালা। তার সময়ে মনে পড়ে, কিছুক্ষণ নিরিবিলি সময় বার করাটাই বেশ অসুবিধাজনক ছিল তার কাছে। সুধাকরকে তিনি দোষ দেন না। কনকবালা নিজেও তো সময় দিতে পারতেন না ওকে একদম। তার ওপর প্রথিতযশা নায়িকার স্বামী হিসেবেই তখন গোটা টলিউড চেনে তাকে, ওর মতো সফল নির্দেশক কীভাবে মেনে নিতেন তা? কনকবালার আজও মনে হয়, সুধাকর নিজেই একটু একটু করে তাই সবকিছু থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে।

আর আজ, একলা বসে আছেন তিনি শুটিং ফ্লোরে। রাস্তার আলোটা পর্যন্ত জ্বলছে না তার সামনে। কোথাও উন্মাদনা আর নেই তাকে নিয়ে। সবই কি বার্ধক্যের দোষ না কি বয়সকালে বিবাহবিচ্ছিন্ন নারীরা আজকের দিনেও ব্রাত্য?

যথারীতি, কথা দিয়েও পত্রিকার লোকজন আর আসেনি। আগে এক একদিনে চার-পাঁচটা করেও ইন্টারভিউ দিয়েছেন কনকবালা। আর এখন বোধহয় এই বুড়ির খবরে পাঠকদের আর কোনো টান নেই। তাই মিডিয়াও কোনো উৎসাহ দেখায় না আর তাকে নিয়ে। তবু যতদিন সুধাকরের স্ত্রী ছিলেন, কিছুটা লাইমলাইটে ছিলেন কনকবালা। হয়তো সবই তার স্বামীর প্রতিপত্তির জোরেই! তার নিজের মান হয়তো চলে গিয়েছিল অনেক আগেই তার যৌবনের সঙ্গে।

আজ যথার্থই নিঃসঙ্গ তিনি। নাহ্, তবু শেষ না দেখে হার মানবেন না কোনোমতে।

উঠতে যাবেন কনকবালাÑ ওমনি ঝড়ের মতো দৌড়াতে দৌড়াতে মেঘনা চলে আসেন তার সামনে। শেষ বিকেলের আলোয় স্পষ্ট, তার চোখে জল। কনকবালা তাড়াতাড়ি উঠে যান মেঘনার সামনে। ‘কী হয়েছে সোনা? তোমার চোখে জল কেন? কেউ কিছু বলেছে?’

থমকান মেঘনা। ক্যামেরার সামনে যিনি তার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন, আজ সেই ভদ্র মহিলাই সবচেয়ে কাছের মানুষ বলে মনে হয় তার। হঠাৎই আবেগের কাছে হার মেনে জড়িয়ে ধরেন তিনি কনকবালাকে।

‘আমি আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। সাফল্য চাই। তবে কারো দয়ায় নয়, নিজের পরিশ্রমে। এই কি আমার দোষ ম্যাডাম? তবে কেন বারবার কৈফিয়ত দিতে হবে আমায় গোটা সমাজের সামনে দাঁড়িয়ে? আমার ব্যক্তিজীবন কেন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে আমার দক্ষতাকে? কেন?’

কনকবালা পরম মমতায় মেঘনার কোঁকড়ানো ঘন চুলে হাত রাখেন। বিষণœতা গ্রাস করে তাকে একটু একটু করে। চোখের সামনে যেন মেঘনা নয়, বসে আছেন তিনি নিজে। জবাব চাইছেন, কিছুটা কৈফিয়তও, কিন্তু উত্তরটা যে এখনো খুঁজে ওঠা হয়নি তার নিজেরই! এতটা লড়াই করতে গিয়ে ভেবে দেখার সময়টুকুও যে তিনি পাননি! তবু তার সামনে বসে থাকা এই মেঘনা যখন তারই পথের পথিক, তখন তাকে টেনে তুলে নিজের পায়ে আবার দাঁড় করানোর দায় যেন কোথাও একটা থেকেই যায় তারও!

‘আমরা এই যে এত ধারাবাহিকে কাজ করি মেঘনা, প্রায় প্রত্যেকটাতেই প্রধান যে নারী চরিত্র, সে দেখা যায় সব অন্যায় মেনে নিয়ে মুখ বুজে সকলকে মানিয়ে গুছিয়ে চলে। তাই সে ভালো, লক্ষ্মীমন্ত। মুখে যতই এই মেগাসিরিয়াল কালচারের নিন্দা করুক লোকে, মনে মনে ঘরে ঘরে এমনই ঘরনি আজও চায় সবাই যাকে অধীনস্ত করা সোজা। আমরা এখানেই ব্যতিক্রমী। আমরা নিজেদের দুর্বল ভাবতে শিখিনি। ভেঙে পড়েছি যেই মাটিতে, সেখানেই আবার মহিরুহ হয়ে দাঁড়িয়েছি। নিজেদের যেটা সঠিক মনে হয়েছে, তাকেই পূর্ণ সমর্থন করে গেছি আজীবন। বুঝলে, এই হলো আমাদের ‘দোষ’। তাই স্বাবলম্বী এই নারীরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখবে, নেগেটিভ, শেডি চরিত্র পান এসব গল্পে। আসলে লোকে যা ভাবে, যেটাকে মেনে নেয়, তাতেই তো টি আর পি, তাই না! ওসব একদম ঝেড়ে ফেলো নিজের মন থেকে মেঘনা। সবার সব ভাবনা মেনে নেওয়ার দায় শুধু আর তোমার তো নয়?’

মেঘনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকে কনকবালার দিকে। দুজনের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলে একযুগ পার্থক্য। তবু, সব শাখা যেমন ধেয়ে চলে মূল নদীর দিকে, যতই পার্থক্য থাকুক না কেন তাদের মধ্যেÑ মেঘনাও যেন মিশে যেতে থাকে কনকবালার সঙ্গে একটু একটু করে।

সব কাজ গুছিয়ে সুকন্যা যখন বের হয় সেটের চৌহদ্দি থেকে বাইরে গাছতলায় দুটি চেয়ারে সে কিছু কস্টিউম আর মেকআপসামগ্রী পড়ে থাকতে দেখে। মেঘনার সবুজ কাঞ্জীভরম শাড়ি আর কনকবালার দুধে আলতা ঢাকাই চিনতে অসুবিধা হবার কথা নয় কখনো তার। আজ সকালে সেই যে যতœ নিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল তাদের!

হঠাৎ আসা ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ে যায় দুই স্বাবলম্বীর পরচুলা। আর ওসব নাটুকে বাস্তবতার বাস্তবিকই, খুব একটা প্রয়োজন নেই যে তাদের!

সুকন্যা পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটা বের করে। এখনই একবার ডিরেক্টরকে সব জানানোটা খুব দরকার! না হলে আর জ্বলবেই না যে রাস্তার ধারের আলোটা!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close