আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

  ১৫ মার্চ, ২০১৯

ব্যঙ্গাত্মক রসবোধে সমাজের আখ্যান

দুরাগত এক রোগ, যাকে সবাই ‘রিডিং ব্লক’ নামেই ডাকেন। সেই সংক্রমণে ভুগছিলাম বেশ কদিন ধরে। সেলফভর্তি অপঠিত বই। এটা ছুঁঁই, ওটা ছুঁঁই। কিন্তু কোনেটাতেই মন বসে না। এরই মধ্যে হাতে এলো ব্যাগভর্তি আরো কিছু নতুন বই। ব্যাগ খুলতেই নজর পড়ে গল্পকার ও ঔপন্যাসিক রোকন রাইয়ানের ‘ভ্যারাইটিজ স্টোর’-এ।

তাই ভাবাভাবি বাদ দিয়ে প্রথমেই ভ্যারাইটিজ স্টোর হাতে নিই। ফ্ল্যাপ পড়েই বুঝতে পারি বইয়ের অদ্ভুত এই নামকরণের কারণ। লেখক জানান, ‘সেই কবে থেকে এক কাপে সাতরঙের চা পাওয়া যায়। অথচ এক বইয়ে দুই স্বাদের বিষয় পাওয়া যায় না। এটা কি হলো? ভ্যারাইটিজ স্টোরে সেই ভিন্নতা পাবেন’।

ভ্যারাইটিজ স্টোরের প্রথম গল্প ‘শেখ আফজাল আবারও নির্বাক হয়ে গেলেন’। এটি একজন খ্যাতিমান সংস্কৃতিকর্মীর গল্প। যিনি ৫৭ বছর বয়সে হঠাৎ নির্বাক হয়ে যান। তার এই হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়ার পেছনে কী এমন রহস্য? এটা কি ‘পিকস ডিজিজ’? না কি কোনো অসম্ভবের নীরব প্রতিবাদ? এই গূঢ় রহস্য উন্মোচন করতেই পাঠক একের পর এক পৃষ্ঠা পড়তে থাকবেন আর বাস্তব-পরাবাস্তবের মিশেলে অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনার সঙ্গে ধাক্কা খাবেন। ধাক্কা খাবেন এ জন্য বলছি, লেখক এখানে সমাজ প্রবাহের এমন সব অসঙ্গতিকে দাঁড় করিয়েছেন, যেসবের সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়তই ধাক্কা খাচ্ছি।

ভ্যারাইটিজ স্টোরের পরের গল্প ‘সেকেন্ডহ্যান্ড বুকসেলফ’। অতি প্রাকৃত এই গল্পে সদ্য গজানো শিমের চারার মতো নিয়াজ-নবমি’র সংসারে আলাদীনের প্রদীপ হয়ে প্রবেশ করে একটি সেকেন্ডহ্যান্ড বুকসেলফ। বুকসেলফকে ঘিরেই নিয়াজের উত্থানপতন। কিন্নরকণ্ঠী নবমিকে ইলিশ খাওয়ানোর সাধ থাকলেও সামর্থ্য নেই যেই নিয়াজের, সেই নিয়াজই রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায় এই বস্তুটির অলৌকিকতায়। অথচ এই সেকেন্ডহ্যান্ড বুকসেলফটিকে দুই চোখে দেখতে পারে না নবমি। তার কাছে এটি ছাইপাঁশ বৈ কিছু নয়। তাই মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত হতেই একরকম ঝেঁটিয়ে বিদায় করে সেকেন্ডহ্যান্ড বুকসেলফটিকে। আর বিদায় করার পরই ঘটতে থাকে একের পর এক দুর্ঘটনা। তারপর একদিন এক আশ্চর্য মানুষের সঙ্গে দেখা হয় নিয়াজ নবমি’র।

ঘোরগ্রস্ত এই গল্পের অনুরণ শেষ না হতেই আরেক রহস্যময় কাহিনি শুরু হয় ক্লাসের সবচেয়ে হ্যাংলা পাতলা ছেলে আদনানকে নিয়ে। লম্বা টিংটিংয়ে আদনান পড়ালেখায় যেমন এক নম্বর, তেমনই খেলাধুলাতেও চ্যাম্পিয়ন। সবচেয়ে গাধা টাইপের ছেলেদের নিয়েও কি করে যে আদনান বরাবরই বিজয়ী হয়, সেই রহস্য শত চেষ্টা করেও জানা হয় না পরাজিতদের।

সাপবন্ধুর পরের গল্প ‘লজিং মাস্টার’। ১০ বছর বয়সী মাদরাসা পড়–য়া মতিনকে নিয়ে এই গল্প। মতিনের মুখস্থ শক্তি অসম্ভব। মাত্র দুই মাসে ১০ পারা মুখস্থ করে ফেলে সে। সহপাঠীরা থ্রেট দেয়। মতিন সেসবে গা করে না। বরং মুচকি হেসে বলে, ‘রক্ত-মাংসের মানুষ। ডাল-চাক খেয়ে থাকিস। তোদের মাথায়

আর কি থাকবে!’

তবে কি মতিন মানুষ নয়? মানুষ না হলে কী? ভ্যারাইটিজ স্টোরে আরেক ভৌতিক গল্প ‘রিকশা মনছুর’-এ লেখক অতিপ্রাকৃত বলতে আসলেই যে কিছু আছে তাই বোঝাতে চেয়েছেন। পরপর তিনটি ভৌতিক গল্প থাকলেও স্বাদ কিন্তু ভিন্ন। এমনই ভিন্ন স্বাদের ১৮টি গল্প রয়েছে ভ্যারাইটিজ স্টোরে। প্রতিটি গল্প নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। সেসব গল্পে যেমন রয়েছে ব্যঙ্গাত্মক রসবোধ, তেমনই প্রাধান্য পেয়েছে মানুষ, পরিবার, সমাজ রাজনীতি ও রাষ্ট্রের নানা অসঙ্গতির উপাখ্যান। রয়েছে সম্পর্কের নামে জালিয়াতি, অসততার নিদারুণ চিত্র। মোটকথা আমরা এখন যে সময়ের পিঠে দাঁড়িয়ে আছি, তারই বাস্তবচিত্র শব্দের বিনি সুতোয় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ভ্যারাইটিজ স্টোরে। বইটি পড়তে পড়তে পাঠক যেমন শিহরিত হয়ে ওঠবেন ভৌতিক গল্পে। তেমনই জীবন প্রবাহের গল্পের প্লটে এসে হারিয়ে যাবেন ভাবনার গলিতে। বোধের দরজায় ঠক ঠক করে কড়া নাড়বে বিবেক। এটাই লেখকের স্বকীয়তা। এখানেই লেখক সফল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close