অরূপ তালুকদার

  ০৮ মার্চ, ২০১৯

অন্তর্নিহিত শব্দের কুহক

কী লিখি বা কেন লিখিÑ এ দুটোই প্রশ্ন হতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এমন ধরনের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়া রীতিমতো কঠিন বলেই মনে হয় আমার কাছে। কারণ কী লিখি, সেটা লেখা শেষ হয়ে যাওয়ার পর বোঝা যায়, আসলে লেখাটা কী হলো।

কিন্তু এর ভেতরে যে আরেকটা প্রশ্ন বা কথা থেকে যায়; সেটা কিন্তু লেখক ছাড়া কেউই জানেন না। কথাটা হলো, সত্যিকারভাবে লেখক মনে মনে কী লেখার জন্য প্রস্তুত হয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন। পদ্য না কি গদ্য কিছুÑ সেটা বোঝা যায় লেখা শেষ হয়ে গেলে। এখানে একটা কথা বলা দরকার, পাঠক যদি এ লেখা পড়তে চান, তবে তা তিনি পড়ে ফেলতে পারেন; তাতে তার কতটা সময় লাগল, সেটা লেখার কলেবরের ওপর নির্ভর করে।

পড়ার পরে সেটা তার কতটা ভালো লাগল, কি লাগল না, সেটা তার ব্যাপার। কিন্তু তিনি কি একবারও ভাবেন যে, এই লেখাটা লেখার জন্য লেখককে কতটা সময়, মেধা, পরিশ্রম আর মনোযোগ খরচ করতে হয়েছে! মনে হয় না।

ওদিকে লেখকের আরো থাকে দায় এবং দায়িত্বও, যাতে এ লেখার জন্য তাকে কোনো রকম জবাবদিহির দায় নিতে হবে কি না বা অন্য কোনো সমস্যায় পড়তে হবে কি না!

এসবের পাশাপাশি লেখার ক্ষেত্রে এখন সত্য-মিথ্যার প্রশ্নও তোলেন কেউ কেউ। কিন্তু সেই সত্য-মিথ্যা নিরূপণের বা বিচারের ভারটা নেবেন কে?

লেখক নিজে শুধু জানেন তিনি যা লিখেছেন তার মধ্যে কতটুকু সত্য বা মিথ্যা জড়িয়ে আছে। অন্য কারোর জানার কথা নয়। কারণ, বাইরের কেউ কি তার মনের কথা অত সহজে জানতে পারেন!

আমরা যদি কবিতার কথা বলি, তাতে শব্দকল্পের বিষয়টি আসবে অনিবার্যভাবে। আসবে শব্দ ব্যবহারের কথাও। ‘শব্দ’ যেমন একটা বোঝার বিষয়, তেমনি ভাবনা বা ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করার বিষয়টা হচ্ছে কল্পনায় আবৃত কোনো অনুষঙ্গ যা নান্দনিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গড়ে তোলে নতুন কোনো ‘শব্দবন্ধ’। যার খোঁজে

ব্যাকুল হন কবি।

প্রকৃতপক্ষে যেহেতু ‘শব্দ’ থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে ভাষা প্রকাশের মাধ্যমটি; তাই শব্দ নিয়েই লুকোচুরি খেলে লেখকের দিন চলে যায়, একসময় সন্ধ্যা ঘনায়...।

গ্রিক ‘লোগোস’ ভাষান্তরিত রূপ হচ্ছে ইংরেজিতে ‘ওয়ার্ড’ আর আমাদের ভাষায় ‘শব্দ’। ব্যাকরণগত পরিভাষায় ‘লেক্সিস’, ‘লেক্সিকা’ বা ‘লেক্সিকন’; যার অর্থ শব্দকোষ বা অভিধান। এর বেশি প্রয়োজন নেই। তবে এখন ওয়ার্ড শব্দটি অনেক কিছু বোঝায়।

শব্দ নিয়ে এমন নিগূঢ় আলোচনা বা তর্ক কাব্য রচনায় খুব একটা কাজে লাগে না। কারণ নিশ্চিতভাবে কোনো কবি তার মনের কথাটি এভাবে কঠিন করে বলতে পারেন না। ফলে তার ‘ঝংকৃত হৃদয়ের অমৃত বাণী রয়ে যায় যেন অন্তরে অন্তরে নিভৃত যতনে...।

আরো কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, সত্য-মিথ্যার কথা, সে তো বহুরূপে ছলনাময়ী, তাকে যে যেভাবে দেখতে চায় বা দেখাতে চায় সেভাবেই তা প্রতিভাত হয়, কখনো সরল-সোজাভাবে, কখনোবা ছদ্মবরণে।

‘অ্যাবসোলিউট ট্রুথ’ বা ধ্র”বসত্য বলতে আসলে কি কিছু আছে? চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ তো পৃথিবী পৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে বলেন বিজ্ঞানীরা। এ সত্যকেও আমরা অস্বীকার করতে পারি না। আসলে সত্য-মিথ্যার বিষয়টা একান্তভাবেই প্রতিটি মানুষের নিজস্ব ব্যাপার। একজনের সঙ্গে আরেকজনের মেলে না। নিষ্ঠুর সত্য হয়তো এটাই।

একজন লেখক কী লিখবেন, সেটা নিয়ে তাকে যেমন ভাবতে হয়Ñ কেন, কী লিখবেন; সে ভাবনাটাও জড়িয়ে থাকে তার সঙ্গে অনিবার্য বন্ধনে। আমাদের চারপাশে যে অপার সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃতি, সে তো এক বিশাল সৌন্দর্যের আধার। যে ধারণ করে আছে আদিগন্ত বিস্তৃত মহাসাগর, সবুজ চাদরে মোড়া নিবিড় অরণ্যান্যেÑ এসব দেখতে দেখতেই তো এক জীবন চলে যায়। তবে কথা আছে, সবার দেখা এক রকম নয়। তেমনভাবে দেখার জন্য যে প্রাজ্ঞ দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন, তা কি সবার আছে?

একজন মানুষ যার ভেতরে আছে ঈশ্বর প্রদত্ত লেখার ক্ষমতা, আছে আবেগ আর হৃদয়ের ভেতরে পাওয়া না পাওয়ার বেদনা। আর কষ্টের আবহ, নিঃসন্দেহে বুঝি, তার আছে শিল্পী বিনোদ বিহারীর মতো ‘ভেতরের চোখ’, অন্ধ হয়েও যেসব সৌন্দর্যকে অবলোকন করতে পারেন সেই চোখ দিয়ে। কিন্তু তারপরও যে থেকে যায় আজীবনের অতৃপ্তি! তাহলে সে অতৃপ্তির টানেই কি এমন শিল্পী তার শিল্পকে মূর্ত করে তোলেন, কবি প্রতিষ্ঠা করে তার বাক প্রতিমা! এর কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যে; সেটা বুঝতে বুঝতে কত যে সময় চলে গেল, তার হদিস সহজে পেল কি কেউ!... রয়ে গেল তো সেই দুর্ভেদ্য শূন্যতাই, যে শূন্যতা একসময় নিঃসঙ্গতার অবয়বে কাছে চলে আসে... ‘যতটাই নিঃসঙ্গ হয়/মৃত্যু ততটাই তার কাছে আসে/পাশাপাশি হাঁটে’ (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)।

সময় চলে যায়, যেন বহতা এক নদী, আপন নিয়মে, সবার অলক্ষ্যেÑ এই কঠিন সত্যটি যখন আমাদেরকে বিপন্ন করে তোলে তখন বিনয়কে মনে পড়েÑ ‘নিজের নিরস্ত্র শোভা, উলঙ্গ অবস্থা নিয়ে আর কোথায়, কাদের দ্বারে উপস্থিত হব, হে সময়? (ফিরে এসো ঢাকা) একজন লেখক বা কবিকে এ পার্থিব জগতে কার সঙ্গে মেলানো যায়?

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close