মৃণাল বসুচৌধুরী

  ০১ মার্চ, ২০১৯

স্বতন্ত্রধারার কবি বীরেন মুখার্জী

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশা থেকেই শুরু হয়েছিল তাকে অনুসরণ না করে কবিতা লেখার প্রয়াস। বাংলা কবিতার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসেই সে কথা স্পষ্ট। পারিপার্শ্বিক তিক্ত অভিজ্ঞতা, পৃথিবীজুড়ে বিশৃঙ্খলা, হতাশা, সুকুমার মনোবৃত্তির লাঞ্ছনায় সর্বক্ষণ পীড়িত বলেই রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যচেতনার সঙ্গে একাত্ম হতে পারেননি কবি জীবনানন্দ দাশ। স্বতন্ত্র এক জগতে নিজস্বতার আরাধনা করেছিলেন নিঃসঙ্গ এই কবি। বিশ শতকের প্রতিটি দশকের কবিরাই নিজস্ব কাব্যভাষা অর্জনের চেষ্টা করেছেন, স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল হয়ে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছেন বাংলা কবিতাকে। দুই বাংলার কবিদের নিরন্তর এই প্রয়াসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা বরং চোখ রাখি বাংলাদেশের কবিদের কাব্যপ্রয়াসের দিকে। আশির দশকের কবিদের কবিতায় আত্মমুখিনতার পাশাপাশি অবচেতন চেতনা, নারীবাদী চেতনা এবং স্বদেশচেতনার প্রকাশের সঙ্গে স্পষ্ট হয় শব্দ, ভাষা ও প্রকাশ ভঙ্গি নিয়ে নানারকম ভাবনাচিন্তা। সেøাগান, বিবৃতি, কাহিনি থেকে দূরে থাকার প্রয়াস। পরবর্তী সময়ের কবিরা আরো বেশি আত্মমুখী। কোনো কোনো কবির রচনায় অবচেতনার স্তরটিও খুব স্পষ্ট। স্বাভাবিকভাবেই চিন্তা, ভাষায় এসেছে জটিলতা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্মুখী কবিতার বিশুদ্ধ রূপ এবং নতুন ভাষার সন্ধান করেছেন কবিরা। আপাত জটিল এই ভাষায় অভ্যস্ত করে তোলার চেষ্টা করছেন পাঠকদের। কবি বীরেন মুখার্জী নব্বইয়ের দশকের কবি। এভাবে দশক বিভাজনে বিশ্বাস না করলেও শুধু তার সৃষ্টির সময়কাল চিহ্নিত করার জন্যই এই উল্লেখ। বিভিন্ন পত্রিকায়, অন্তর্জালে তার কবিতা পড়েছি। শব্দচয়ন ও অভিনব প্রকাশ ভঙ্গির মাধুর্যে আকৃষ্ট হয়েছি। কিছুদিন আগে তার ‘জতুগৃহের ভস্ম’ পা-ুলিপি পড়ার সুযোগ হয়েছে। এটি তার নবম কাব্যগ্রন্থ। তাই তার কবিতার কিছু বিশেষ দিক নিয়ে আমার অপার মুগ্ধতার কথা জানাতেই এই সামান্য প্রয়াস।

২.

কবি বীরেন মুখার্জীকে পাই নির্লিপ্ত পরিক্রমাতে বিশ্বাসীরূপে। তিনি লিখেছেনÑ ‘অরণ্য প্রাচীন হলে, তার ছায়াতলে, জেনেছিলামÑ গড়ে ওঠে পরিবর্তিত বসতি। কথারও অলংকার আছে, সময়ের মোচড়ে ধ্বনিত হতে পারে প্রত্যাশিত রাগিণী ফের; চলো, নির্লিপ্ত হেঁটে যাইÑ ধূলিরাঙা গোধূলির পথে...।’ [চলো, নির্লিপ্ত হেঁটে যাই]

কবির এই কয়েকটি পঙ্ক্তি আমায় কবির মনোজগতের দরোজাটি বোধ হয় চিনিয়ে দিয়েছে। দ্বিধাহীনভাবেই বলতে পারি, কবি বীরেন মুখার্জী প্রকৃত অর্থেই এক পরিবর্তিত বসতির বাসিন্দা। তার কবিতায় শব্দেরা বেজে ওঠে সময়ের মোচড়ে। নিরন্তর শব্দ-সন্ধানী এই কবির প্রতিটি কবিতাই আত্মিক শব্দের মূর্ছনা। নির্লিপ্ত

কিন্তু অনিবার্য।

শব্দ-সাধনা, আমার দীর্ঘ জীবনজুড়ে। আমি বিশ্বাস করি শব্দের অসীম জাদু, যার ছোঁয়ায় অলৌকিক হয়ে ওঠে ভাষা। শব্দচিত্রের অভিনবত্ব কবিকে স্বতন্ত্র করে। মনে পড়ছে, কবিতার ভাষা এবং শব্দ প্রসঙ্গে বিখ্যাত কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, তার ‘শব্দ, পুরান, মুখচ্ছদ’ প্রবন্ধে লিখেছেনÑ

‘...আধুনিক কবিতায় শব্দই সমগ্র ভাষাকে কোণার্ক কিন্নরীর চিবুকে ক্ষোদিত করে তুলে ধরেছে। অনন্ত শূন্যের দিকে মালার্মে সাদা কাগজ মেলে রেখেছিলেন ভাষার ভাষা, পরম শব্দকে অভ্যর্থনা করে নেবেন বলে...।’ সেই শব্দের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে এই উদাসীন, মায়াহীন কবির চোখের নির্লিপ্ত ছায়ায় খেলা করে ‘অক্ষরের শব’ যা কোন শব্দ-নির্মাণের কাজে লাগে না। আর তাই কবির দীপ্ত উচ্চারণÑ

‘এভাবেইÑ হাঁটতে হাঁটতে ভেঙে ফেল অক্ষরের শব আর কাচের মহিমা; প্ররোচনা এড়িয়েÑ ভাবে ও আচারে পুনরাধুনিক হয়ে ওঠাই বরং শ্রেয়তর!

৩.

প্রত্যেক বিশিষ্ট কবির নিজস্ব ভাষাশৈলীই তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। কবিতার সঙ্গে শব্দের সম্পর্ক, শব্দের মূলশক্তি ইত্যাদি তত্ত্বকার মধ্যে না গিয়েও এ কথা তো বলাই যায় যে, শব্দের মাধ্যমেই তৈরি হয় কবির নিজস্ব ভাষা নির্মাণশৈলী। আবার এ কথাও ঠিক, শুধু শব্দ নয়, বিষয়, ভাবনাচিন্তা অনুভব দিয়ে শব্দের সমস্ত সম্ভাবনা যাচাই করেই তা ব্যবহার করতে হয় কবিতায়। শব্দ নিয়ে এ সব কথা বলার একটাই কারণ। কবি বীরেন মুখার্জীর শব্দচয়নের দক্ষতা। এমন অনেক শব্দ তার কবিতায় অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছে, যা অনেকেই ব্যবহার করার আগে কয়েকবার ভাববেন। অদ্ভুত সাহসে তিনি এইসব শব্দমালা দিয়ে তৈরি করার চেষ্টা করেছেন এক স্বতন্ত্র

কাব্যভাষা। যেমন-

ক. মনে করো- কল্পনাপ্রসূত এই দৃশ্য ভবিতব্যসম্মত, কোনো এক নোনা ধরা রাত্রির বিবিধ বিউগলে গীত হবে যার সবটুকু।

খ. প্রকৃতি এমনই ছদ্মবেশী; কোনো কোনো রাতে, হয়তো বা ফিরে আসবে তুমিÑ মুখরা ময়ূর! [মুখরা ময়ূর ]

এই দুটি উদ্ধৃতি থেকে তনিষ্ঠ পাঠক নিশ্চয় জেনে যাবেন কবির নিজস্ব অঙ্গনের প্রকৃত চেহারা। বিষয়ের সঙ্গে ভাষার স্বভাবী মিলন তার কবিতাকে দিয়েছে এক অনন্ত বিস্তার। অনুভূতি নির্ভর এই কবির আত্মমগ্ন অন্বেষণ শেষে ‘দ-িত পৃথিবী’র মুখোমুখি হওয়া, ‘ঝিনুক কুড়ানো বিকেল’ আঁকার প্রয়াস, ‘নিখিলের ঘুম’ উড়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করার মুহূর্তগুলোর সাক্ষী থাকতে চাই।

কবিতা চিৎকার না নিবিষ্ট উচ্চারণ, কারিগরি নির্মাণ না শিল্পসৃষ্টি, বিবৃতি প্রচার না নিবিড় অভিজ্ঞতা, বুদ্ধির চমক, না অন্তর অভিজ্ঞতার শব্দায়ন তা নিয়ে অনেক আলোচনাই পড়েছি আমরা। কবির আত্মিক বিশ্বাস যাই হোক না কেন তা প্রকাশের জন্য চাই সঠিক প্রকাশ ভঙ্গি, সার্থক শব্দচয়ন, শব্দের অন্তর্গত ধ্বনির জন্য চাই ছন্দ, এবং... এবং... এ রকম কোনো একটা ‘এবং’ এর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে কবিতার প্রাণভোমরা। গদ্যের ভাষার সঙ্গে কবিতার ভাষার পার্থক্য বোঝাতে চঅটখ ঠঅখঊজণ বলেছিলেনÑ ‘ঢ়ড়বঃৎু রং ঃড় ঢ়ৎড়ংব ধং ফধহপরহম রং ঃড় ধিষশরহম’. কবিতার ছন্দনির্ভর ভাষা বা ধ্বনিগত কাঠামোই তাকে গদ্যের ভাষা থেকে আলাদা করেছে। কবি বীরেন মুখার্জীর কবিতার জাদু, পাঠককে নিয়ে যায় এক নিাংদিষ্ট সময়ের আলো আঁধারিতে, হয়তো বা পরাবাস্তব এক ঘোরের মধ্যে ভেসে আসে কবির উচ্চারণÑ ‘যে ভাবেই দেখোÑ জীবন এক প্ররোচনাময় টগবগ, কতিপয়

ঘোরেই সুস্থির।’

৫.

বীরেন মুখার্জীর রহস্যময় অনুভূতির জগত বড়ই মায়াবী। চিত্রভাষাও। এক চিত্রকল্প থেকে অন্য এক চিত্রকল্পে যাওয়ার প্রক্রিয়াও খুব অনায়াস। স্বপ্নময় সৌন্দর্যের মোড়কে ঢাকা অবিশ্বাস, ভয় ও অনিশ্চয়তা সাবলীলভাবে লুকিয়ে আছে তার উচ্চারণে। আছে শীতল শব্দহীন বিস্ফোরণের মর্মভেদী চিৎকার। অশালীন নয়, মার্জিত। ধ্বনিময়। জীবনানন্দ বলেছিলেন কবিকে ‘কোবিদ’ হতে হয়। ‘কোবিদ’ অর্থাৎ জ্ঞানী। পারিপার্শ্বিক জীবন থেকে আহরিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লালনের স্বতন্ত্রতায়, প্রকাশভঙ্গীর মাধুর্যে, আঙ্গিকের অভিনবত্বে কবিরা হয়ে ওঠেন নিজস্ব কাব্যভাষার অধিকারী। দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি, বীরেন মুখার্জীর কবিতার ভাষা, প্রকাশ ভঙ্গিমা একেবারেই স্বতন্ত্র। তার কবিতার অমোঘ মূর্ছনা অলৌকিক আনন্দের ছোঁয়ায় মুগ্ধ করবে পাঠকদের।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close