গিরীশ গৈরিকের
একগুচ্ছ মেডিটেশন
প্রার্থনা
পৃথিবীতে আবার একটি নতুন সকাল এসেছে
‘আবার’ শব্দটি প্রমাণ করে পূর্বে আরেকটি সকাল ছিল।
এভাবে ‘আবার ও আরেকটি’ শব্দদ্বয় প্রমাণ করে
নতুন একটি সকালের প্রত্যাশা।
নতুন সকালে তুমি আসবে
আমরা সেই প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে আছি।
ফুল ফোটে ফুল ঝরে যায়
আমরা তোমার প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে আছি।
আলো এসে আঁধারে লীন হয়ে যায়
তবুও তোমার প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে আছি।
আমরা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখিÑ
অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমস্ত সকাল
তোমার অপেক্ষায় করজড়ো দাঁড়িয়ে আছে।
আত্মদীপো ভব
রক্তক্ষরণের দিনলিপি নিমগ্নতার জ্বলে ভিজে কী পবিত্র হয়!
জীবনের এমন একটি প্রশ্ন : আরেকটি প্রশ্নের মুখোমুখি হলেÑ
হয়তো-বা উত্তরের অন্বেষণ প্রশ্নদ্বয়ের অন্তরভেদী স্তব্ধতা
কিংবা জন্ম ও মৃত্যুর অজানা কুয়াশা।
জন্মের সত্যতা নিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মনে হয়Ñ
কেন এই মায়াজাল, কেন জীবনের ভেতর-বাহিরজুড়ে স্তব্ধতা!
জীবনের কলকাকলিÑ সুখ ও দুঃখের কলতান
শিশিরের জলে খলবলিয়ে হাসে
আবার সূর্যতাপে কেঁদে কেঁদে বিলীন হয়ে যায়।
বিলীন হয়ে কোথায় যায়?
আবার কেমন করে ফিরে আসেÑ
নদীর তীরে
পাখির কূজনে
ঝর্ণার সিঞ্চনে
ভূমিষ্ঠ শিশুর আনন্দ চিৎকারে।
ব্যাকরণ
তুমি দাঁড়িয়ে আছোÑ অকারণে
ধ্যানী বুদ্ধের মতো নীরব হয়ে।
কারণেরও কারণ থাকেÑ অকারণেরও কারণ
তাই তুমি বুদ্ধÑ বোধের অতীত।
আমি দাঁড়িয়ে আছিÑ কারণে
তুমি দাঁড়িয়ে আছোÑ অকারণে
আমার কারণ ও তোমার অকারণ মিলেÑ
ব্যাকরণ।
সেই ব্যাকরণে একটি শব্দ সমুজ্জ্বল হয়ে আছেÑ
ভালোবাসা।
?
চৈত্র মাস
সহস্র ভায়েগ্রা খেয়ে সূর্য যৌবনে ঢুলুঢুলু।
মেঠোপথের চারিধারে ফসলের ঢেউ
ধানের গর্ভে দুধের সম্ভার
যেন আমরা শিশু হয়ে যাচ্ছি।
এভাবে হাঁটি হাঁটি একপা দুইপা করেÑ মেঠোপথে একাকী।
মেঠোপথের সীমান্তে বটবৃক্ষের আশ্রম
নিজের শরীরে ঘামের স্নানÑ ক্লান্তিময় মেঠোপথ।
অবশেষে বটবৃক্ষের সাক্ষাৎ যেন পৃথিবী আনন্দময়।
এখন পৃথিবী ছায়াময়। ঝিরিঝিরি দক্ষিণা বাতাসÑ
ধীরে ধীরে সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে দিচ্ছে।
ঠিক এমন সময় তুমি এলে একগ্লাস ঠা-া জল হাতে
তোমাকে দেখে মনে হয়Ñ তুমি আমার জননী
তোমাকে দেখে মনে হয়Ñ তুমি আমার প্রিয়তমা
তোমাকে দেখে মনে হয়Ñ তুমি আমার আত্মজা।
আসলে তুমি আমার কেউ না
এমনকি তুমি তোমারও কেউ না
তাহলে তুমি কে?
কে তুমি?
পরাধীনতা
আমি কিছু পোষাপাখি পৃথিবীর খাঁচায় পোষ মানিয়েছি
তারা চাইলেও পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও উড়ে যেতে পারে না।
ওই পাখিগুলোর মাঝে একটি পাখি কথা বলতে জানে
সেই কথা বলতে জানা পাখিটি আমায় একদিন বললো :
সে নাকি পৃথিবীর কারাগারে আমাকেসহ কিছু মানুষ পুষে রেখেছে
তারা চাইলেও পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারে না।
মাইলস্টোন
বকুল গাছে একগুচ্ছ তরবারি ফুটে আছে
প্রতিটি তরবারিলিপিতে আছেÑ
ঈশ্বর, আল্লাহ, যিশু ও বুদ্ধের নাম।
দিনের আলোয় তরবারি চিকচিক করে ঝলসায়
রাতের অন্ধকারে তরবারি আরো বেশি ঝলসায়Ñ
রক্তাক্ত হয়ে ওঠে।
বকুল তলায় একগুচ্ছ তরবারি শুয়ে আছে
তবুও কেউ কেউ তরবারির দিকে না তাকিয়ে-
ফুলের দিকে তাকায়।
ফুলের গন্ধ শুকে হাঁটতে থাকে সীমান্ত পেরিয়ে...
নিতম্ব
ইংরেজি ছয় ও নয়ের মতো তুমি
ঘুরে গেলেই নয়-ছয়!
নয় ও ছয় মিলে পনের, তিন কিংবা চুয়ান্ন
অথচ তোমার প্রেম যোগহীন গুণহীন বিয়োগহীন।
তুমি আমায় ভাগ করতে ভালোবাসো
তাই নয় ও ছয়ের ভাগশেষই আমাদের প্রেম।
তুমি কি জানোÑ আমি আর্যভট্ট
আমি শূন্য ও গুণে বিশ্বাসী
তাই আমার সাথে পৃথিবীর সমস্ত অঙ্ক গুণ করলেই শূন্য হয়ে যায়।
যে শূন্যে তুমি দাঁড়িয়ে ভাবোÑ
কীভাবে পৃথিবী গুণ গুণ ঘুরতে ঘুরতে শূন্য হয়ে যায়।
স্বপ্ন
ঈগলই একমাত্র পাখিÑ যে দূরের আকাশে উড়তে পারে
তিমিও একমাত্র মাছÑ যে সাগরের গভীরে ডুবাতে পারে।
আর কোনো পাখিÑ কেন জলের গভীরে ডুবাতে পারে না?
আর কোনো মাছÑ কেন দূর আকাশে উড়তে পারে না?
একদিন তোমার কবিতা আকাশ হলো
সেই আকাশে আমিÑ তিমি হয়ে উড়লাম।
একদিন আমার দুঃখ সাগর হলো
সেই সাগরে তুমিÑ ঈগল হয়ে ডুবালে।
এভাবে তোমার আকাশ আমার সাগর
তোমার সাগর আমার আকাশ
ক্রমশ লীন হতে হতে বিলীন হয়ে গেলÑ
সন্তানের স্বপ্নের ভেতর।
"