সোলায়মান সাদী

  ১১ জানুয়ারি, ২০১৯

তৈল ও পরনিন্দানির্ভর সাহিত্য সমালোচনা

স্বভাবকবি আর সভাকবি। দুজন দুরাজ্যের বাসিন্দা। একজন থাকেন নিজের ভেতরে, আরেকজন পরের পেছনে। ইতিহাসের সত্যমিথ্যা ভেদ করে স্বভাবকবিরা প্রাগৈতিহাসিক হয়ে ওঠেন কখনও। বিজয়ীরা ইতিহাসের সত্য ছিনিয়ে নিলেও মিথ্যার অভ্যন্তরে আরেক সত্য জাগতে থাকে প্রতিটি সমকালের তাগিদ বুঝে। কবি তখন সব সত্যমিথ্যার ঊর্ধেŸ গিয়ে কায়েম করেন আরেক রাজ্যÑ যেখানে কবিরাই সেরা; অকবিরা মৃতের কাফন হয়ে শুধু শুভ্রতা ওড়ায়। স্বভাবকবি সভাকবি, কবি অকবি তর্কের বাইরেও যে পরম সত্য লুকিয়ে থাকে তার দিকে আমাদের ভবিষ্যতের যাত্রা। আমরা একটা সত্যকে মাড়িয়ে দ্বিতীয় তৃতীয় ও শেষ সত্যের কাছে আশ্রয় কামনা করি।

কবিদেরই খুঁজে নিতে হয় সে পথ। কবিতার কালমহাকালের মানদ-ে দাঁড়িয়ে যে চেতনা ঘূর্ণির মতো ছেয়ে যায় সবখানে, তারও কোনো অতিমাত্রিক চরিত্র নেই। যা আছে এই আমাদের চোখের সামনে। চোখ খুললেই দেখতে পাই, সব কেমন সাদাকালো পবিত্র সত্য সুন্দর। শিল্পের সবরঙই শিল্পসম্মত হওয়া চাই। কুৎসিত কালো অন্ধকারও শিল্পের দুয়ারে এলে ভোরের দেখা পায়। আজগুবি সময় কাবু হয়ে আসে মানুষ প্রকৃতি সমাজ ও পৃথিবীর হৃদয়জুড়ে।

অনেকদিন ধরে কবিতার সঙ্গে, নিজের সঙ্গে একটা বহুমাত্রিক দ্বন্দ্ব অনুভব করছিলাম। কবিতা কোনো মহান বা বড় ঘটনার জন্য অপেক্ষা করে না। নীরব শব্দমালাও কবিতাকে উপযুক্ত শরীর দিতে পারে, দেহ দিতে পারে। কোনও মহানুভবতাও হতে পারে কবিতার অন্তরের ধ্বনি। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র, বিরাট পাহাড় সমুদ্র আকাশ সবই কবিতার বিষয়বস্তু। যে কথাগুলো বলতে কবিতাই একমাত্র ভাষা, ভিন্ন পথে কেন যাবেন কবি? তবু বলতে হয়Ñ কবিতার কথা।

তিরিশের কবি ও কবিতার শাসকেরা কেমন ছিলেন? কেমন ছিল তাদের চরিত্র মন ও অনুভব, খুব কঠিন না ধরা। মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের পথ ধরে যখন তারা বিশ^কবিতার সমকাল হাতের মুঠোয় পেলেন, একটা বিপ্লবের সময় নিশ্চয় ছিল সেটা। দুই অগ্রজের পথে হেঁটে তারা তাদের কাঁচা মনের সৌন্দর্য খুঁজে পেলেন। আধুনিক সময়ে জন্ম নিয়েও মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ বিশ^কবিতা থেকে শুধু তার ক্লাসিক বিষয়গুলো নিতে পেরেছিলেন এবং এটাই ছিল তাদের প্রধান দায়িত্ব। আমি বলব, তারা পথ খুলে গেছেন। পরবর্তীরা সে পথ বেয়ে আরো অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। খুঁজে পেয়েছেন সমকালের স্পর্শ ও কাতরতা। আধুনিক কবিতার গলিঘুপচি ঘুরে মিশে গেছেন বিরাট সেই ঢেউয়ে।

বাংলাসাহিত্যের আধুনিক যুগ শুরু হওয়া ছিল বড় একটি ঘটনা। কবি ও সমালোচকরা হুড়মুড় করে বিশ^কবিতার সবগুলো তত্ত্ব নামিয়ে এনেছেন বাংলাভাষায়। বাংলা কবিতাকে দিয়েছেন নতুন বাঁক। বিশ^কবিতার তানাবানায় বুনলেন ‘রূপসী বাংলা’। সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে, অমিয়, জীবনানন্দ ও বুদ্ধদেব ছাড়াও অন্য কবিরা যে শুধুই বাংলা কবিতার ওপর বিদেশি কবিতার ভারি চাদর চাপিয়ে দিয়েছেন, তাই নয়Ñ বাংলা কবিতার চিন্তা ও দর্শনটাকে শুধু নাড়াতে চেয়েছেন তারা। নড়েছেও। কিন্তু তারপর? বাংলাদেশে বাহান্ন ও মুক্তিযুদ্ধের ভিন্নমাত্রিক উচ্চারণ ছাড়া ভিন্ন কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েনি।

বাংলা সাহিত্যে পাঁচজন, সংখ্যাটাকে গৌণভাবে বিবেচনায় নিলেও আধুনিক কবি আছেন, সে অর্থে পাঁচজন উত্তরাধুনিক কবি কি আছেন? কেন নেই? ওর পরে আমাদের সমালোচনা সাহিত্য সেভাবে আগায়নি; বলতে জ্ঞানতাত্ত্বিক সমালোচনা আমরা ততদিনে ভুলে বসেছিলামÑ এপারে বিদ্ধ হয়ে, ওপারে স্তব্ধ হয়ে।

বিশেষভাবে বাংলাদেশের কথা যদি বলি, মুক্তিযুদ্ধের পর পুনর্নির্মিত হয়েও আমরা আমাদের চেতনা বিক্রি করে দিয়েছিলাম। জ্ঞান ও চিন্তার আবহ নষ্ট করে একটি অজানা মোহের পেছনে পড়ে গিয়েছিলাম। আমরা এখন স্বাধীন জাতি। আমাদের একটি সব পেয়েছির দেশ আছে। এ ফূর্তির স্রোতে আমাদের স্বভাব থেকে কবিতা ভেসে গেছে এবং ইতিহাস এখানে আবার সভাকবিদের আসন বাড়িয়ে দেয়। সভাপতিত্ব ছাড়া আর কিছু ভাবার ফুরসত হয়ে ওঠে না কবিদের। চেতনায় তৈল জমে ওঠে। কবিতার গাগতরে শুধু তৈল আর তৈল। তৈলাক্ত হাতের স্পর্শে কবিতা

তখন জড়োসড়ো।

এখনও পর্যন্ত আমরা সমালোচনা বলতে তৈলমর্দন বুঝি, নয়ত পাড়ার পরনিন্দা। তৈলমর্দন করে অকবিদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে কবিতার ঝা-া অথবা পরনিন্দায় কাতর বানিয়ে কবিদের করছি রাজ্যছাড়া। এটা এখন বাংলাকবিতার সবচে বড় সংকট বলেই আমার মনে হয়।

পারস্যের কবি শেখ সাদী বলেছিলেন, ক্ষুধায় প্রেম হয় নাÑ প্রেম করতে দেহ লাগে, দৈহিক শক্তি লাগে, মানসিক স্থিতি লাগে। তিনি এতো বড় একজন কবি হয়ে প্রেমই এলো কেন, কবিতা এলো না কেন? ভাবতে অবাক লাগছে! বেশ কয়েকশ বছর পরে এসে সুকান্ত কিন্তু ঠিকই ধরেছেন। তিনি ক্ষুধার রাজ্য থেকে কবিতাকে ছুটি জানিয়ে পৃথিবীকে গদ্যময় করে তুলেছিলেন। সে অর্থে আজ এতো এতো ধনদৌলতের ভেতরে কবিতা কোথায়? কবিরা কোথায়? চারদিকে সভাকবিদের ভীড়!

ভাষা ও বানানের নৈরাজ্য, চিন্তার অস্থিরতা ও চেতনার দাসত্বে বাংলাকবিতার চেহারা যেভাবে দিনের পর দিন শীতের ত্বকের মতো শুকিয়ে ফেলা হচ্ছে, কিছুতেই কি এর কোনো সীমানা টানা সম্ভব হবে? মাটির গায়ে এতো এতো সীমানার তাঁরকাটা, কবিতার গায়ে কেন নয়? এবার একটা সীমানা টেনে ফেলা চাই। ওই ইতিহাসের মিথ্যার ভেতর জেগে ওঠা কবিজন কোথায়? নিরেট সত্যের খাতিরে না হোক, শুভ্রতা ও সুন্দরের জন্য না হোক, কেবল কবিতার খাতিরে কি আরেকবার বসা যায় না? বস্তুনিষ্ট মনে আঁকা যায় না কবিতার ভবিষ্যৎ?

না খেয়ে কবিতা লিখবে, না পরে একজন কবির কবিতা ছাপবেÑ এমন স্পর্ধা আশা করি না। উন্নতির জোয়ারে কবি ও কবিতার সিংহাসন যেন ভেসে না যায়। সভাপতির গলার জোরে যেন কবির কণ্ঠরোধ না হয়। এইটুকু তো কামনা

করাই যায়?

ভাষা ছন্দ অলঙ্কার দর্শন ও বিভিন্ন মতবাদকে কেন্দ্র করে বাংলাকবিতার যে বিশাল সমভূমি সেখানে গার্মেন্টকর্মী এবং অফিসের কেরানিরা ঢুকতে যাবে কেন? যদি মেনেও নিই, কবিতার কোনো সীমানা নেই, সূত্র নেই; স্বাধীনতাও কিন্তু কবিতার জন্য খুব স্বাস্থ্যসম্মত নয়? তিরিশ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছে, দেশ কি স্বাধীন করতে পেরেছি আমরা?

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close