আবদুস সালাম

  ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৮

মেঘে ঢাকা চাঁদ

দেখতে দেখতে নাদিরার চাকরি প্রায় দুই বছর হয়ে গেল। শহরতলিতে একটা ভাড়া বাসাতে একাকী বাস করে। সে একটা এনজিও প্রতিষ্ঠানের উপজেলা কো-অর্ডিনেটর। একজন দক্ষ অফিসার হিসেবে নাদিরা বেশ পরিচিত। দাফতরিক বা পারিবারিক বিষয়ে কারোর কোনো সমস্যা হলে অধীনস্থ কর্মকর্তা/কর্মচারীর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তাদের নিয়মিত খোঁজখবর রাখে। অধীনস্থ কর্মকর্তা/কর্মচারী তার প্রতি যেমন খুশি তেমনি তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বও তারা আন্তরিকতা ও যতেœর সঙ্গে পালন করে।

দাফতরিক প্রয়োজনে নাদিরাকে প্রায়ই জেলা কো-অর্ডিনেটর আলভি হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হয়। মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম পরিদর্শনের জন্য মাঝে মাঝে বসের সঙ্গেও যেতে হয়। আলভি সাহেবের অধীনে কাজ করতে পেরে নাদিরা অনেক কিছু শিখেছে। সে আলভিকে একজন দক্ষ, সৎ, সাহসী এবং বন্ধুসুলভ অফিসার হিসেবেই জানে। এভাবে কাজ করতে গিয়ে তাদের মধ্যে বেশ সখ্য গড়ে ওঠে। অবশ্য এ সম্পর্কটা তারা অফিস পর্যায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে।

আলভি সাহেবের চাকরির বয়স প্রায় আট বছর। বাড়ির বড় ছেলে হলেও তিনি বিয়ে করেননি। যদিও তার ছোট ভাই-বোনের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। মা-বাবা আলভির জন্য পাত্রী দেখতে দেখতে রীতিমতো ক্লান্ত। কাউকেই তার পছন্দ হয় না। এতে তারা মনে করেন, ‘ছোট ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে বলেই অভিমান করে আলভি বিয়ে করতে চায় না।’ এই ধারণা যে সত্য নয় তা মা-বাবাকে বোঝাতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।

নাদিরার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আলভি নতুন করে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। তাকে নিয়ে কল্পনার জগত দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। নাদিরার প্রতি ভালোলাগার যে কলি হৃদয়কাননে উঁকি দিয়েছিল তা এখন ফুটন্ত পুষ্প। সেই পুষ্পের সুরভিতে আলভি মুগ্ধ। তার হৃদয়ের সবটুকু জায়গা দখল করে আছে নাদিরার মুখশ্রী।

ফরহাদ নামে আলভির এক বন্ধু নাদিরাকে চেনে। দুজনের বাড়ি একই গ্রামে। একদিন আলভি ফরহাদকে জানান, ‘তিনি নাদিরাকে পছন্দ করেন।’ ফরহাদ মঙ্গলের কথা ভেবে নাদিরা এবং তার পরিবার সম্পর্কে আলভিকে অনেক কিছু অবহিত করে। সব কিছু জানার পরও আলভি প্রেমাসক্ত মনকে আটকে রাখতে পারেন না। নাদিরার মাঝেই কাক্সিক্ষত সুখ খুঁজে নেন। আলভির মনের গহিনে যে ভালোবাসার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে তা নাদিরার কাছে প্রকাশ করার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছেন কিন্তু প্রকাশ করতে পারেননি। ওদিকে নাদিরাও দিনে দিনে বুঝতে পারে-তার বস আলভি সাহেব তাকে শুধু একজন সহকর্মী হিসেবে নয়, ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেন। স্যার কল্পনায় যে সুখরাজ্য গড়েছেন সেখানে নাদিরাকে রানি হিসেবে অধিষ্ঠিত করেছেন। এর ফলে নাদিরার মনে ভীতির সঞ্চার হয়। সে ভয় তাকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। নাদিরা এর থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য পথ খুঁজতে থাকে। সে বস যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে থাকে।

ওদিকে নাদিরার দূরে দূরে থাকাটা আলভি সাহেব আর সহ্য করতে পারেন না। তিনি যেমন তার স্পর্শে সিক্ত হতে চান, তেমনি হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় মুগ্ধ করতে চান। তাই সিদ্ধান্ত নেন মনের ইচ্ছার কথাটা নাদিরাকে জানাবেন। সুযোগমতো একদিন নাদিরার সঙ্গে দেখাও করেন। আলভি বললেন, ‘তোমাকে অনেকদিন ধরে একটা কথা বলব বলে ভাবছি। কিন্তু বলতে পারিনি। যদি অভয় দাও তাহলে বলতে পারি।’ নাদিরা অভয় দিলে বলেন, ‘ভেবেছিলাম সংসার করব না। সংসার নামক প্রতিষ্ঠানটি আমাকে কখনো আকর্ষণ করেনি। কিন্তু তোমাকে দেখার পর থেকে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছি। নতুন করে স্বপ্ন দেখছি। ঘর যদি বাঁধতেই হয় তোমাকে নিয়েই বাঁধব। এতে তোমার মতামত জানা আমার খুব প্রয়োজন।’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নাদিরা উত্তর দেয়, ‘আমার অতীত জানলে আপনি আমাকে নিয়ে এমনটি ভাবতেন না।’ ‘আমি সব জানি। ওসব আমার কাছে তুচ্ছ। তোমার মতামত পেলে...।’

‘দয়া করে আমাকে দু-এক দিন সময়

দিন। তারপর না হয়...।’

স্যারের কথাগুলো শুনে নাদিরা সেই রাতে আর দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। হাজারো কথা ভেবে সে সিদ্ধান্ত নেয়Ñ তার অভিশপ্ত জীবনের সঙ্গে আর কোনো পুরুষকে জড়াবে না। স্যারের সুন্দর ভবিষ্যৎকে নষ্ট করা কোনোভাবেই উচিত হবে না। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় চাকরিটা ছেড়ে দেবে। স্যারের থেকে অনেক দূরে থাকবে।

ঠিক দুদিন পর সে চাকরিতে রিজাইন দিয়ে গ্রামে চলে যায়। আলভি সাহেবের হাতে যখন রিজাইন লেটারটা পৌঁছায় তখন তিনি আসমান থেকে আছড়ে পড়েন। বুকের মধ্যে যত্নে আঁকা স্বপ্ন কাচের টুকরার মতো খান খান হয়ে যায়। তিনি বুঝতে পারেন- নাদিরার দ্বিমত আছে বলেই সে এমনটি করেছে। তিনি চান না নাদিরার কোনো ক্ষতি হোক। তার মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করে। যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নেন নাদিরার সঙ্গে দেখা করবেন।

সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আলভি নাদিরার সঙ্গে দেখা করার জন্য তার গ্রামে ছুটে যান। নাদিরাদের বাড়িতে পৌঁছে দরজায় নক করেন। নাদিরা নিজেই দরজা খুলে দেয়। এভাবে দেখা হওয়াতে তারা কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। রাতের জার্নিতে আলভি সাহেবের ঘুম হয়নি তা এক নজরেই নাদিরা বুঝতে পারে। নাদিরার সামান্য সেবা-শুশ্রূষাতেই আলভির প্রতিটি রক্তকণায় শক্তি সঞ্চার হয়। ক্লান্ত শরীর জেগে ওঠে। আলভি নাদিরাকে বলেন, ‘বুঝতে পেরেছি তোমার যোগ্য আমি নই। তাই তোমাকে বিরক্ত করব না। এক্ষুনি চলে যাব। তোমার রিজাইন লেটার ফেরত দিতে এসেছি। আর...।’ আলভির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নাদিরা বলতে শুরু করেÑ ‘আমার জীবনে একটা ভয়ংকর সত্য লুকিয়ে আছে। যা জানলে আপনি আমাকে ঘৃণা করবেন! ধিক্কার দেবেন!’

‘চরিত্রহীন, নষ্টা? অসংখ্য পুরুষের সঙ্গে তোমার অবৈধ সম্পর্ক ছিল? আপত্তিকর অবস্থায় দেখে স্বামী ডিভোর্স দিয়েছে, তাই?

না এর চেয়েও ভয়ংকর সত্য লুকিয়ে আছে?’ ‘আপনি সব জানেন না?’

‘আমি সব জানি। আর এও জানি, ওগুলো তোমাকে আর কোনো দিনই স্পর্শ করবে না। তাই জেনেশুনেই আমার জীবনে তোমাকে জড়াতে চেয়েছি। আমাকে ভুল বুঝবে না। তোমার কোনো ক্ষতি হোক আমি চাই না। আশা করি আবার নিয়মিত অফিস করবে। কথা দিলাম আর কক্ষনো বিরক্ত করব না। এই নাও তোমার রিজাইন লেটার।’

কথাগুলো বলে আলভি ঘর থেকে বের হবেন ঠিক তখনই নাদিরা পেছন থেকে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে চলার পথ রুদ্ধ করে। নাদিরার চাঁদমুখটি যে ধূসর মেঘে ঢেকে ছিল তা এতক্ষণে কেটে যায়। সেই চাঁদমুখের আলোয় আলোকিত হয় আলভির হৃদয় আঙিনা। আলভি পরম যত্নে নাদিরাকে বুকের মাঝে চেপে ধরেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close