সাইফুদ্দিন সাইফুল

  ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৮

লালন দর্শনে মানুষ ও মানবতাবাদ

‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি/মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই/মূল হারাবি...।’

মহাত্মা গুরুবাদী আধ্যাত্মিক সাধক ফকির লালন শাহের একান্তে চিন্তা-চেতনায় ভাবে-ভাবনায় ও বিশ্বাসে অর্থাৎ তার গুরুবাদী দর্শনে মূলত মানুষকেই অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। মানুষকেই তার গানে দ্বিধাহীনভাবে আনন্দচিত্তে চরম ভালোবাসা আর বিশ্বাসের জায়গা থেকে জয়গান গেয়েছেন; মানুষকেই তার পদে পরতে পরতে যারপরনাই পরমাত্মার অংশ হিসেবে মানবিক আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিকভাবে তুলে ধরেছেন। মানুষকে তিনি ভক্তি ও পরম গুরুজ্ঞান করেছেন। মানব জনমকে তিনি শ্রেষ্ঠ জনম শ্রেষ্ঠ উপহার বলেছেন। ফকির লালন মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অধরা সেই পরমাত্মা রূপে বিরাজমান মনের মানুষকেই সতত সন্ধান করেছেন এবং সাধন-ভজনের জন্য গুরুতত্ত্বে একমাত্র মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন। কেননা, ভবে মানুষ হয়ে মানুষের কাছেই প্রেম নিবেদন, ভালোবাসা চাওয়া ও মানুষকে ভজাটাই আসল সাধন-ভজন। আর এর মধ্য দিয়েই পরমাত্মা অর্থাৎ লালনের সেই মনের মানুষকে পাওয়া যাবে।

জগতে মানুষকে ভজলে মানুষকে নমস্য জানলে সোনার মানুষ হওয়া যায়। মানুষ ভজার মধ্য দিয়েই সিদ্ধি লাভ এবং পরমাত্মার সঙ্গে মিলন হয়। সুফিতত্ত্বে এই মাটির মানুষের হৃদয়েই মহান আল্লাহর বসবাস অর্থাৎ পরমাত্মার ঘর। মহাপুরুষ মহাত্মা ফকির লালন মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর মানব সন্তানের ভেতরে অধরা মনের মানুষ বাস করে। ফলে নিরিখ বেঁধে সত্যমনে সাধনে তাকে লাভ করতে হবে, নইলে মূল হারাতে হবে, অমূলে অন্ধকারে দিবানিশি হাবুডুবু খেতে হবে; আর সাধের এই মানব জনম একেবারে বৃথা যাবে এবং অকূলে পথ পাওয়া যাবে না। আর তাই মানুষ ভজার মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহকে, দয়াল রসুলকে সেই অধরা মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়, নৈকট্য হয়, রূপসাধনে দেখা মেলে এবং সোনার মানুষ

(গুরুসত্ত্বা) হওয়া যায়।

ফকির লালন আজীবন স্বপ্ন দেখতেন ধর্ম বর্ণ গোত্র জাতহীন এক মানবিক সমাজের, যে সমাজে মানুষই সব; মানুষের মানবিক মূল্যবোধই সমাজের সহায়ক। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ কিন্তু কীভাবে- তা অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার। এমনি এমনি শ্রেষ্ঠ হওয়া যায় না কখনো, শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে হলে তার জন্য মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের গুণের অধিকারী হতে হয়। এই পৃথিবীতে মানুষের পরিচয় কিসে? মানুষের পরিচয় তার মানবিকমূল্যবোধ অর্থাৎ মনুষ্যত্বে। আর এই মনুষ্যত্বের মধ্য থেকেই মানবতাবাদ সৃষ্টি হয়েছে। সত্যি যে, মানুষকে ঘিরেই মনুষ্যত্ব কিংবা মানবতাবাদ আলোকিত হয়। ফকির লালন গুরুবাদীধর্মে সাধন-ভজনে মানুষের সেই পরম মনুষ্যত্ববোধকেই জাগ্রত করতে চেয়েছেন। মানবতাকে সকল জ্ঞানের উপরে স্থান দিতে চেয়েছেন। মানবতাই মানুষের মুক্তি, মানুষের মানুষ হওয়ার সাধনার চাবিকাঠি। সমাজে বিদ্যমান প্রচলিত নানা ধর্ম-প্রথা নানা জাত-পাত গোত্র বর্ণ সম্প্রদায় ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ফকির লালন বিশ্বাসে ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন; সাহসী ও প্রতিবাদী মন নিয়ে সেসব কথা তার জ্ঞানমূলক মহতী গানের মাধ্যমে অকপটে তুলেও ধরেছেন। লালনের গানে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষ ও মানবতার জয়গান শুনতে পেয়েছিলেন এবং লালনের মানবতাবাদী উদারনৈতিক মানবহিতৈষী কল্যাণময় দিকটি রবীন্দ্রনাথকে যারপারনাই অনুপ্রেরণা ও ভাবিয়ে তুলেছিল। আর এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ নিজেও বলেছেন- ‘লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন, আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’ আসলে এ কথাটাই সত্য, লালন গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন তার সেই পরম মনের মানুষের কোনো জাত কোনো বর্ণ কোনো লিঙ্গ কোনো ধর্ম বলে কিছু নেই। আমরা বলে থাকি, বর্তমান যুগ আধুনিক বিজ্ঞানের যুগ, এখন মানুষ চিন্তা চেতনায় উন্নত শিখরে। কিন্তু এতকিছুর পরেও ধর্ম জাতপাত বর্ণ ছোট বড় উঁচু নিচু সম্প্রদায় বিষয় নিয়ে পরস্পর হানাহনি মারামারি সংঘাত হিংসা বিদ্বেষ ও ভয়ানক রক্তপাতের সংঘাত এখনো হচ্ছে। এইতো সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রতি কত নিষ্ঠুরভাবে জাতিগত নিধন চালানো হলো। আর ফিলিস্তিনে জাতিগত হত্যাকা- চলছেতো চলছেই। আসলে লালন তার চিন্তায় চেতনায় ভাবে ভাবনায় বোধে ও বিশ্বাসে মানবতাকে মানুষকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। আর তাই তিনি আজীবন সর্বদা ধর্ম জাত-পাত বর্ণহীন একটি সমাজের স্বপ্ন দেখতেন এবং তা তার গানে তুলেও ধরেছেন। লালন বলেছেন- ‘এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে,/যেদিন হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ

খ্রিস্টান/জাতিগোত্র নাহি রবে...।’

এখানে যদিও দেখা দৃষ্টিতে ধর্ম বর্ণ জাতহীন একটি মানব সমাজের কামনা করা হয়েছে। মূলত এমন মানব সমাজের গভীর প্রত্যাশার মাধ্যমে মানবতারই জয়গান গাওয়া হয়েছে। এই ধরাধামে যেদিন সত্যি সত্যি এমন একটি মানব সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে সেদিন ধর্ম নয় বর্ণ নয় গোত্র নয় নয় কোনো জাত-পাত শুধু মানুষের অর্থাৎ মানবতার জয় হবে এবং ধর্ম কিংবা জাত না মানবতা হবে মুখ্য। একটি ধর্ম জাত বর্ণহীন সমাজে মানবতা বিরাজ করে মানুষকে মানবতার রঙে রাঙিয়ে সতত মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ ও মানবতার তরে শান্তির সাম্যের ভালোবাসার অপার প্রেমময় ঢেউ বয়ে যাবে। লালন এই মানবিক স্বপ্নই দেখতেন। আমরা তাই দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি, লালনের ধর্ম মানবধর্ম। মানুষ জীবন সমাজ নিয়ে তার মাঙ্গলিকভাবনা এই মানবধর্মেরই জয়গান। লালনের মতো মহামানবের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শক্তিমান সাহিত্যিক লেখক পন্ডিত ও গবেষক আহমদ শরীফ বলেছেন- ‘ভেদবুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে সাম্য ও প্রেমের সুউচ্চ মিনারে বসেই লালন সাধনা করেছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধক ও দার্শনিকদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনি সাম্য ও প্রেমের বাণী শুনিয়েছেন।’

মহাসাধক ভাবুক নিষ্ঠা সত্যসন্ধানী পরম পুরুষ মানবতাবাদী মানুষ মরমি কবি ফকির লালন শাহ তার গানের ভেতরে একদিকে যেমন আল্লাহ-রসুল, গুরু-শিষ্য, সাধন-ভজন, দেহ-মন-আত্মা-পরমাত্মাকে নিয়ে এসেছেন তেমনি আবার প্রেম, সাম্য শান্তি ভালোবাসা ও মানবতাবাদের এক চিরন্তন অমৃত অমীয় সুধা বিলি করেছেন। এখানে নিজের দেহ-মনকে স্রষ্টাকে অধরাকে মনের মানুষকে সতত সন্ধানের যে প্রকাশ, সাধন-ভজন কামনা- তা সমাজের কোনো ধর্ম, গোত্র, জাতপাত, বর্ণ-বৈষম্যর দড়িতে হাজার চেষ্টা করেও বেঁধে রাখা যায় না। যেহেতু বাউল সাধনার মূল কেন্দ্রবিন্দু মানবদেহ অর্থাৎ মানুষ। এই দেহরাজাকে বশে আনতে পারলে, খন্ড থেকে অখন্ড হতে পারলে রূপসাধনে সাঁতার দিতে পারলে নিরিখ বেঁধে সাধন করতে পারলেই তবে এই আপনাকে একান্তে চেনা যাবে- কে আমি এবং অচেনা অজানা সেই দূর গন্তব্যের পথে একজন সাধকপথিক হয়ে সত্যসিদ্ধি লাভ হবে। সেই অনন্তরূপ ধরা দেবে দেহ-মন পবিত্র হবে। লালন তাই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, মানুষ ভজলে মানুষকে প্রেম করলে মানুষকে ভালোবাসলে একান্তে সিদ্ধিলাভ হয় অর্থাৎ অধরা সেই পরমাত্মাকে মনের মানুষকে পাওয়া যায়। তিনি সতত সহজ মানুষ ভজার কথাই বলেছেন। এই জগতে মানুষই সব, এই মানুষ স্রষ্টার কাছে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব এবং মর্তলোকে স্বর্গলোকে তারই আসন। সাধক লালন বলেছেন-‘সহজ মানুষ ভজে দেখ নারে মন দিব্যজ্ঞানে,/পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে।/ভজ মানুষের চরণ দুটি/নিত্য বস্তু পাবে খাঁটি/মরিলে সব হবে মাটি/ত্বরায়

এই ভেদ লও জেনে...।’

আবহমান বাংলার সাধু গুরু ফকির বাউলদের রচনা ও গানে মূলত মানুষেরই জয়গান গাওয়া হয়েছে। মানবতাকে ধর্ম বর্ণ জাতপাতের ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়েছে। এ সকল গানে এক ধরনের আধ্যাত্মিক গুরুবাদী তত্ত্বের আহ্বানের লক্ষ্য দেখা যায়। তারই ধারাবাহিকতায় ফকির লালনের গানের ভেতরে এমন এক ধরনের অমিয় জাদু ভাব রূপ রস ছন্দ আবেদন সরলতা মধুপ্রেম চেতনরস রয়ে গেছে, যা আমাদের এই কথিত মানবসমাজে শিক্ষিত অশিক্ষিত ভাবুক চিন্তাশীল এবং সাধারণ মানুষ থেকে আরম্ভ করে জাতি ধর্ম বর্ণ ছোট বড় নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষকে একটা আলাদা মানবিক চিন্তা-চেতনা আর মানুষ ভজার জগতে নিয়ে যায়। কেননা, লালনের গানের মধ্যে তত্ত্বকথা ভাবকথা চরমভাবে বিদিত ও প্রকাশিত। তার গানে সাম্য শান্তি ও মানবমুক্তির

সন্ধান মেলে।

মানুষ ভজনার মধ্যেই রয়েছে ফকির সাধনার মূলবস্তু। কেননা, মানুষ ভজলে মানুষকে প্রেম করলে ভালোবাসলে অধরাকে অর্থাৎ পরমাত্মাকে মনের মানুষকে পাওয়া যায়। এই মত এই পথ এই ভাব ও দর্শন আমাদের লোকায়ত সাধনা শিল্পে সাহিত্যে সংগীতে সংস্কৃতিতে অপরাপর মানবিক প্রেমের সাম্যের মানবতার অমৃতমাখা পথ রচনা করেছে। তাই সাধু ফকিররা এই ভারতবর্ষে, বাংলায় মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ না করে এক কাতারে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। মানুষকে ধর্ম বর্ণ গোত্র সম্প্রদায় বৈষম্য ভুলে প্রেমের ভালোবাসার সাম্যের এক আকাশের নিচে রাখতে চেয়েছে। মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের ‘হারামণি’র ১ম খন্ডে ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অতীব সঠিক কথাটাই বলেছেন- ‘এই ভারতের একজাতীয়তা রেখেছে শুধু ফকিররাই।’

আমাদের এই বিশাল উপমহাদেশ যখন স্বৈরশাসক ব্রিটিশ দ্বারা প্রতিনিয়ত রাজনৈতিকভাবে সামাজিকভাবে অর্থনৈতিকভাবে শাসন-শোষণ হচ্ছিল এবং হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা রক্তপাত জাতিগত বিভেদ-সংঘাত আর হিংসা-বিদ্বেষ ঘৃণা চরমভাবে গ্রাস করে ফেলেছিল; ঠিক সেসময়ে ফকির লালন শুধু আধ্যাত্মিক চিন্তা কিংবা পদ রচনাতে মশগুল ছিলেন না। তিনি তখন এসব বিদ্যমান সমস্যার সমাধানের পথও খুঁজে ফিরছিলেন এবং এই অন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মানবিকতার জয়গানে উদ্বুদ্ধ হয়ে চরম প্রতিবাদ করলেন। অসাধারণ গভীর জ্ঞানপূর্ণ ছন্দ পদ রচনা করলেন। এ কথা দিবালোকের মতো সত্য, ফকির লালন শাহ ব্যক্তিগত জীবনে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ জাতপাত বৈষম্য কিছুই মানতেন না এবং বিশ্বাসও করতেন না। মানুষের সৃষ্ট এ সকল বিষয়ের প্রতি লালনের সর্বদা অনীহা ও ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। মানুষ বড় মানুষ শ্রেষ্ঠ আর মানুষের মনুষ্যত্ববোধ সমাজ জাতপাত বর্ণের চাইতে অনেক অনেক ঊর্ধ্বে এবং সাম্য শান্তির চালিকাশক্তি হিসেবে এই মানুষকে সোনার মানুষে পরিণত করে। কাজেই জাতপাত নয়, সত্যকে ধারণ করা, সত্যকে মানা, সত্যের উপরে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করাই মানুষের মানবিক ধর্ম। লালন দর্শনে মূলত

মানুষ ও মানবতাবাদ মুখ্য হয়ে উঠেছে। আর তাই তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পেরেছেন- ‘জাত গেল জাত গেল বলে/একি আজব কারখানা,/সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/সবি দেখি

তা না-না-না...।’

মুক্তচিন্তার অধিকারী সাম্য ও শান্তিতে বিশ্বাসী অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি সকল প্রথা-কৃসংস্কারবিরোধী চরম মানবতাবাদী মহাত্মা ফকির লালন শাহের গুরুবাদী ধর্মের মূল দর্শনই হলো মানুষ। আর তাই ফকির লালনের অসাধারণ অনন্য বৈচিত্র্যময় গানের ভেতরে যে বিষয়টি মুখ্য হয়ে উঠেছে তাহলো মানুষ এবং এই সমাজ। এক্ষেত্রে লালনের গানে তার চিন্তা-চেতনায় ভাবনায় ও বিশ্বাসের সঙ্গে পারস্যের সুফিবাদীদের সুফিতত্ত্বের যেমন অনেক মিল আছে তেমনি আবার এই উপমহাদেশে গুরুবাদী ধর্মের বিষয়টিও প্রকাশ পেয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লালনের মানবিকতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেনÑ ‘লালন ধার্মিক ছিলেন কিন্তু কোনো বিশেষ ধর্মের রীতিনীতি পালনে আগ্রহী ছিলেন না। সব ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন জীবনে।’ লালন বিশ্বাস করতেন- এই সমাজে মানুষে মানুষে মিলনে সবচেয়ে বড় বাঁধা ধর্ম জাতপাত। এই জাতপাতের বিরুদ্ধে তার ছিল চরম প্রতিবাদ। লালন মানুষকে এক আকাশের নিচে জাতপাতহীন প্রেমময় এক দড়িতে বাঁধতে চেয়েছিলেন। লালন তাই ক্ষেপে গিয়ে বলেছেন- ‘জাত না গেলে পাইনে হরি/কী ছার জাতের গৌরব করি/ছুঁসনে বলিয়ে,/লালন কয় জাত হাতে পেলে/পুড়াতাম আগুন দিয়ে...।’

আসলে লালনের গুরুবাদী ধর্মে প্রকৃতার্থে মানুষ ও মানবতাবাদ প্রকাশ ঘটেছে। লালনের প্রতিটা গানে দার্শনিক দৃষ্টি নিয়ে দেখলে দেখা যাবে, মানুষকে গুরু করে মানুষের মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করে অধরা প্রাণের মানুষকে লাভ করা যায়; এটাই গুরুত্ব হয়ে উঠেছে। কেননা, লালন শাহ তিনি তার মহতী পদগুলো সাধন-ভজনের সঙ্গীত হিসেবে সহায়ক করে তুলেছেন। লালনের একনিষ্ঠ মন ঈশ্বর মানুষ সমাজ ধর্ম নিয়ে গভীর অনুশীলন উপলব্ধি পর্যালোচনা আর আধ্যাত্মিক গুরুবাদী সাধনার মধ্য দিয়ে মানুষ ও মানবতাবাদকে প্রচার করেছেন এবং আপনাকে একজন মানুষের বন্ধু মানবতাবাদের কণ্ঠস্বর হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। লালন দর্শনে মানুষকে গুরু মেনে গুরুর প্রতি ভক্তি নিষ্ঠা প্রদর্শন এবং নিজ অন্তরে মানবতাকে প্রতিষ্ঠিতর দ্বারা জীবনের সাধন-ভজন সিদ্ধি হয়। কেননা, গুরুর রূপের মাঝে সেই অধরা জ্যোতির্ময় পরম দয়াল গুরুর দিব্য প্রকাশ। আর এই গুরু অন্য কেহ নন, এই গুরু হলো মানবগুরু। সাধক লালন তাই বলেছেন- ‘ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার,/সর্ব সাধন সিদ্ধি হয় তার.../নিরাকারে জ্যোতির্ময় যে/আকার সাকার হইলো সে/যেজন দিব্যজ্ঞানী হয়, সে জানতে পায়/কলি যুগে হলো মানুষ অবতার...।’

আমরা জানি, মহাত্মা লালন মানবপ্রেম আর মানবধর্মের ছিলেন একেবারে কালের মূর্তপ্রতীক। লালনের কাছে মানবধর্ম এবং মানবপ্রেমই মূলত অধিক মুখ্য হয়ে উঠেছিল এবং তা তিনি গানে প্রকাশও করেছেন। এটা ঠিক, তিনি মানবতার মুক্তির কথা বলেছেন ও ভেবেছেন; তারপরেও তিনি শুধু মানবতার মুক্তির বিষয়ে সংগ্রাম করে থেমে থাকেননি। মানবতার মুক্তির পথ কি? কীভাবে মানুষ ও মানবতার মুক্তি হতে পারে তার পথও তিনি চিনেছেন ও জেনেছেন। মূলত লালনের সাধনার ভজনের আধ্যাত্মিকতার মূলমন্ত্রই ছিল নিজেকে চেনো বা জানো অর্থাৎ

‘আত্মং বিদ্ধিং।’

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন- ‘যে নিজেকে (আপনাকে) চিনেছে, সে তার রবকে (আল্লাহ, প্রভু) চিনেছে।’ মহাপ-িত সক্রেটিস বলেছেন- ‘নো দ্য সেলফ (নিজেকে চেনো)।’ ফকির লালন বলেছেন- ‘আপনারে চিনলে পরে যাবে অচেনারে চেনা।’ আসলে জগতে নিজেকে চেনা কিংবা জানার মধ্য দিয়েই লালনের ভাষায় মনের মানুষকে (পরমাত্মা) চেনা যায়, জানা যায়। অধরা দয়াল মনের মানুষের সনে নৈকট্য হয়। আর তখন প্রেম ভক্তি ভালোবাসা মানুষ ও মানবতা মিলে হয়ে যায় একাকার। লালন বলেছেন- ‘মিলন হবে কত দিনে/আমার মনের মানুষের সনে.../ওই রূপ যখন স্মরণ হয়/থাকে না লোজলজ্জার ভয়/লালন ফকির কেঁদে বলে সদাই/ও প্রেম যে করে সেই জানে।’ লালন আবার বলেছেন- ‘মনের মানুষ খেলছে দ্বিদলে/যেমন সৌদামিনী মেঘের কোলে.../সেই মানুষ চিনলো যারা/পরম মহাত্মা তারা/অধীন লালন বলে/দেখ নয়ন মেলে...।’

পরমাত্মা প্রাণের ঠাকুর মানুষের মধ্যে তিনি সাই রূপে বাস করে। তাই বিশ্বপ্রভুকে অচিন মানুষকে চিনে নিতে হয়। তবেই নিজেকে একজন সহজ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব, তা না হলে মানুষ জন্মের উদ্দেশ্য স্বার্থকতা ব্যর্থ হয়ে যাবে এবং এই জীবনের মূল হারিয়ে যাবে অতল গহিন অন্ধকারে। আর এ কথা অতীব চরম সত্য, বাউল সাধনা ফকির সাধনা ভাব ও আধ্যাত্মিক সাধনার মূলে মূলত মানুষ। লালন বলেছেন- ‘মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয় মনে/সে কি অন্যতত্ত্ব মানে.../জড়োসড়ো নুলাঝুলা/প্যাচোপ্যাচী আলাভোলা/তাতে নয় সে ভোলনেওয়ালা/যে মানুষ

রতন চেনে...।’

মানুষ ভজনার মধ্যেই রয়েছে ফকির সাধনার মূলবস্তু। কেননা, মানুষ ভজলে মানুষকে প্রেম করলে ভালোবাসলে অধরাকে অর্থাৎ পরমাত্মাকে মনের মানুষকে পাওয়া যায়। এই মত এই পথ এই ভাব ও দর্শন আমাদের লোকায়ত সাধনা শিল্পে সাহিত্যে সংগীতে সংস্কৃতিতে অপরাপর মানবিক প্রেমের সাম্যের মানবতার অমৃতমাখা পথ রচনা করেছে। তাই সাধু ফকিররা এই ভারতবর্ষে বাঙলায় মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ না করে এক কাতারে দাঁড় করাতে চেয়েছে। মানুষকে ধর্ম বর্ণ গোত্র সম্প্রদায় বৈষম্য ভুলে প্রেমের ভালোবাসার সাম্যের এক আকাশের নিচে রাখতে চেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ অতীব সঠিক কথাটাই বলেছেন- ‘এই ভারতের একজাতীয়তা রেখেছে শুধু ফকিররাই।’

মানুষ হয়ে জন্মালে মানুষ হওয়া যায় না, মানুষ হতে গেলে জীবনে অতি গুরুত্ব গুণাবলির অধিকারী হতে হয়। মনুষ্যত্ববোধ বা মানবিক গুণাবলি মানুষ হওয়ার পূর্বশর্ত। ফকির লালন শাহ ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে মানবতাবাদী হওয়া অধিক প্রয়োজনীয় বিষয়- এটি ভালো করেই জানতেন এবং মনে-প্রাণে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই তার গানে মানুষ ও মানবতাবাদ অনেক বেশি স্থান দখল করে আছে। ধর্ম বর্ণ জাতপাত গোত্রের অনেক উপরে মানুষ ও মনুষ্যত্বের অবস্থান। এখানে প্রেম ভালোবাসা সাম্য মানবিকতা চির শান্তি কল্যাণ ও মঙ্গলের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে। আর এই জন্যই মানুষ হওয়ার জন্য মানুষের সন্ধান পেতে গেলে মনুষ্যত্বের রূপ রস গন্ধ আস্বাদন করতে হলে এই ক্ষণ জীবনে সতত সত্য সুন্দর মানবিক পথে চলতে হয়। সাঁইজি বলেছেনÑ ‘সত্য বল সুপথে চল/ওরে আমার মন,/সত্য সুপথ না চিনিলে/পাবিনে মানুষের দর্শন...।’

মানুষ ও মানবতাকে নিয়ে ফকির লালনের যে চিন্তা-ভাবনা বিশ্বাস আর যেভাবে তিনি এই বিষয়কে আপন সত্ত্বায় চেতনায় বোধে ধারণ এবং তা গানে গানে উপস্থাপন করেছেন, এসব যুগে যুগে কালে কালে সাধারণ মানুষ ছাড়াও পৃথিবীর বড় বড় খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিক-বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী মানুষকে প্রভাবিত করেছে এবং এখনো পর্যন্ত সমানতালে করে চলেছে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম এবং আমেরিকার কবি ও চিন্তাবিদ অ্যালেন গিন্সবাগের মতো প-িতজনরা লালনের গান ও দর্শনে মানুষ ও মানবতার যে জয়জয়কার দেখতে পেয়েছেন তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। পাশাপাশি দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য কবি-সাহিত্যিক লেখক বুদ্ধিজীবী দার্শনিক ও জ্ঞানী-গুণী চিন্তাবিদরা ফকির লালনকে নিয়ে আজ অনেক বেশি চর্চা এবং গবেষণা করছে। বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে লালনের চিন্তা ও তার দর্শন নিয়ে আজ রীতিমতো গবেষণা হচ্ছে এবং তার রচিত গান বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদও হচ্ছে। লালন হয়ে উঠেছে পন্ডিত ও গবেষকদের কাছে জ্ঞানরাজ্যের এক মহাপুরুষ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close