শা হ মু ব জু য়ে ল

  ৩০ নভেম্বর, ২০১৮

বুদ্ধদেব বসু

সৃষ্টি ও দায়বোধের কবি

রোমান্টিক কবি বুদ্ধদেব বসুর আদি নিবাস ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে। গ্রামের নাম মালানগর ও বহর। জন্মের পরই মা ধনুষ্টংকার রোগে মারা গেলে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বাবার সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর সম্পর্ক ভালো ছিল না। পিতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন তার প্রিয়মানুষ। কিন্তু বাল্যজীবনে দাদামশায় ও দিদিমার আদর মমতায় বড় হয়েছেন। চিন্তাহরণ সিংহের মার্জিত স্বভাব। দিদিমার ব্যক্তিত্ব তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। চিন্তাহরণের কাছে ইংরেজি বাংলা শিখেছেন। যোগীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং রবীন্দ্রনাথের রচনা পড়েছেন শৈশবেই। এ সময়ে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল প্রবল।

‘আমি তখন আরো একটু বড় হয়ে উঠেছি। শীতের সন্ধ্যায় দাদামশাই আমাকে পড়ে শোনাতেন শার্লক হোমসের কাহিনি-পর্যায়, শেক্সপিয়র থেকে কোনো কোনো দৃশ্য পোর্শিয়া ও শাইলকের সঙ্গে, রজালিন্ড আর মিরান্ডার সঙ্গে, ব্রুটাস কেশিয়াস মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে তাঁরই মধ্যস্থতায় আমার প্রথম পরিচয় হয়। আর এমনি করেই ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যকে তিনি আমার অন্তরঙ্গ করে তুলেছিলেন। আমার প্রায় মনেই পড়ে না আমি কীভাবে ইংরেজি পড়তে ও লিখতে শিখেছিলাম; সেজন্যে আমার স্বাভাবিক উন্মুখতা যতটা দায়ী দাদামশায়ের প্রাণবন্ত শিক্ষকতাও ততটাই।’

তীব্র অনুভবময়তা ও আবেগপ্রবণতা প্রতিটি লেখক শিল্পীর প্রথম জীবন থেকে ডানা মেলে উঁকি মারে দিগন্তে। বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রেও শিল্পবোধের কারণে পারিপার্শি¦ক সমাজ, কাল, দৈশিক ও বৈশ্বিক বিষয়আশয়, দর্শন, মনস্বত্ত্ব, সবকিছুকে মাড়িয়ে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছেন। তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ এবং অনুবাদশিল্পে তা লক্ষ্য করা যায়। তার মাধ্যমে সাহিত্যশিল্পে সংযুক্ত হয়েছে কাব্যগ্রন্থ মর্মবাণী (১৯২৫), বন্দির বন্দনা (১৯৩০), কঙ্কাবর্তী (১৯৩৭) এবং উপন্যাস সাড়া (১৯৩০), সানন্দা (১৯৩৩), লালমেঘ (১৯৩৪) বাসরঘর (১৯৩৫), তিথিডোর ও রাতভরে বৃষ্টি, দুঃসাহসী শিল্পশৈলীতে, প্রতিভা ও মানসের বৈশিষ্ট্যে আলো দিয়েছে দারুণভাবে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাব্যপ্রেম বর্ণনা দিয়েছেন এভাবেÑ ‘আজ রাত্রে বালিশ ফেলে দাও, মাথা রাখো পরস্পরের বাহুতে/শোন দূরে সমুদ্রের স্বর, আর ঝাউবনের স্বপ্নের মতো নিস্বন/ঘুমিয়ে পোড়ো না, কথা বলে সময় নষ্ট করো না/এই রাত্রি শুধু অনুভব করো অস্তিত্ব।’ প্রকৃতি প্রেম ভাবনা ছিল এ রকমÑ ‘কী ভালো আমার লাগলো আজি সকাল বেলায়/কেমন করি বলি/কী নির্মল নীল এ আকাশ/কী অসহ্য স্ন্দুর/যেন গুণীর কণ্ঠে অবাধ উন্মুক্তদান।’ (সিল্কায় সকাল)

সৃষ্টি দায়বোধের কবি বুদ্ধদেব বসু। নবীন কবি বলে বিদ্রোহ করলেও তার দুঃসাহসী মনোভাব রুচিবাগীশ জগতকে তরল করে দেয়। এটি তার কল্পনারই প্রয়োগ অনুক্রম। সময় রূপান্তে অল্পবয়সে কল্পনার দুয়ার এত প্রশস্ত করেছেন ‘বন্দির বন্দনা’ পাঠে তা সহজেই অনুমেয় হয়। তাঁর অনুভূতির আকাশ বিস্তৃত এবং সুমহান জোতিষ্কের মতো সমুজ্জ্বল। কবি মানসের দীপ্ত আলো থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয় তাতে ছবি সুর ভাবচিন্তায় ভিন্ন আঙ্গিক উপস্থাপিত হয়ে পাঠককে টেনে নেয় অন্তরচেতনায়। মনে হয়, কল্পনার এই প্রবাহ তার কাব্যের মৌলিক উপাদান। কল্পনার জগৎ সবারই ভিন্ন থাকে এক্ষেত্রে তারও ভিন্নতা রয়েছে। কবির সৃষ্টিকর্ম ও প্রতিভা হলো নানান জিনিস থেকে যথাযথ উপাদান বের করে নিয়ে আসা। প্রত্যেক কবিকেই এই কৌশলকে আয়ত্ব করতে হয় তিনিও তা করতে ভুলেননি। ‘বন্দির বন্দনা’ থেকে আলাদা হয়ে ধরা দেয় ‘কঙ্কাবতী’। প্রথম দিকে কবির মুড যেখানে ঘুরছিল তা থেকে তিনি উঠে এলেন সহজসাধ্যভাবে। প্রথমদিকের ভাবগুলো স্পষ্ট বাঁকহীন। সেখানে তাঁর দক্ষতা সম্পূর্ণ ক্ষীণ। হঠাৎ করে জোরেসোরেই আধুনিক মোহনিয়তায় নিয়ে যায়। এই জোরটা অতিরিক্ত। এক্ষেত্রে মনে করা যেতে পারে কবি ওমর খৈয়ামের কথা। তাঁর কাব্যশক্তি স্বধর্মলালিত। কাব্যের বিষয় মনে গেঁথে যায় এভাবে- ‘তাই আজ মুক্তকণ্ঠে আমন্ত্রণ করি তোমা, হে সুন্দরী নারী/সকল বিক্ষোভ আজ অতিরিক্ত সুরা সম ফেলেছি উদগারি/নাহিকো সংশয় আর এতদিনে বুঝিলাম।’

আমোদ প্রমোদের ভাঁজে লেখা ‘কঙ্কাবতী’ কাব্য। তার কবিতা রাজ্যে তিনিই মহান। জীবনকে বহন করে সম্মুখে পথ চলেছেন। কবিতার ব্যাপকতা শুন্যতা ও অন্ধকারকে নিয়ে কবিতার ভেতরে প্রবেশ করলে মনে হয়, তিনি জীবন ঘনিষ্ট প্রকৃতির রস সৌন্দর্যের পথে চলেছেন। কোনো কোনো কবিতা লঘু আমোদ তথা জীবনের নানান ভাঁজের সম্মিলন। কবিতায় প্রেমের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এক্ষেত্রে জীবননান্দের ভাষায় তিনি ঢ়ৎড়ঢ়ধমধহফরংঃ. এছাড়াও, যাঁরা সময় ও সৃষ্টিকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে তবুও আরো ভগ্নাংশে পরিণত করতে চান সময় ও সৃজনের মুখের রূপ, তা না হলে দেখতে পারবেন না বলে তাঁদের প্রীতির জন্য সৃষ্টি ও সময় নিজেদের ব্যবহার ভুলে যায় না। অণুর ভেতরে সমস্ত পৃথিবী খোঁজার মতো সময় ও মৃত্তিকার ভেতরের কাব্য ‘কঙ্কাবতী’। সময়ের ব্যবধানে বোধগম্য হয় যত স্বাদ নিতে ইচ্ছে করে আরও আস্বাদ পেয়ে বসে। এ যেন তার প্রতি পাঠকের কাব্যপ্রীতি।

বাংলা কবিতার দুটি ভাবাবেগ বিদ্যমান একটি রুদ্ধশ্বাস ও শব্দস্রাব অন্যটি ধীর ও দ্বিধাময়। একটি শ্রুতি অন্যটি ভাবাবেগ অনুভূতি। বুদ্ধদেব কিশোর বয়স থেকেই শব্দের স্রোত প্রবাহিত করেছেন স্বতন্ত্র ধারায়, তিনি গড়ে উঠলেন নিজস্ব স্টাইলে যা সমসাময়িক লেখকদের কাছে ঈর্ষণীয়। যদিও বোলদিয়ার ও সুইনবার্নের ভাবানুবাদ তাকে প্ররিশ্রুত করে।

ইংরেজি ক্লাসিক ও রোমান্টিক কবিতার সমসাময়িক গ্রন্থ তাকে মায়াবী জালে আচ্ছন্ন করে। তিনি সব উপাদানকে বুঝে শুনে স্বতন্ত্র জগৎ সৃজন করেন। জীবনযুদ্ধ ও সমকালীন সংকট তুলে আনেন। তিনি সাহিত্য দিয়েই জীবনজীবিকা নির্বাহ করতেন। এক্ষেত্রে বলা বাহুল্য, তিনিই বাংলা কবিতার প্রধান কবি যার জীবিকার ক্ষেত্র ছিল সাহিত্য। তাঁর কথা এ রকমÑ ‘চালচুলোহীন আমার পক্ষে সংসারযাত্রা যে সহজ হয়নি তা হয়তো না বললেও চলে। আশ্চর্য এই যে, আমি চালাতে পেরেছিলাম শুধুমাত্র লেখনী থেকে অক্ষররাশি নিঃসৃত করে। সে সবের মধ্যে অনেক ছিল যা আমি তখনই জেনেছি মূল্যহীন; অনেক ছিল যা আমি লিখতাম না, বা লিখলেও প্রকাশ করতাম না, যদি আমার বিকল্প উপায় কোনো থাকতো। কিন্তু স্থুল প্রয়োজন আমাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটা লেখা শেষ হওয়ামাত্র অন্য একটা।’

‘কবিতা’ (১৯৩৫) আধুনিক কবিদের মুখপত্র ও কবিতাবিষয়ক সাহিত্য পত্রিকা। পত্রিকাটি বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র মিলে প্রথম সম্পাদনা করেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র সরে গেলে সমর সেন দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনিও বেশিদিন স্থায়ী হননি। দায়িত্বভার ন্যাস্ত হয় বুদ্ধদেব বসুর হাতে। নতুন সাহিত্যিকের লেখা কবিতায় প্রকাশ পায়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও তরুণদের সাহিত্যচিন্তাকে স্বাগত জানান। ধীরে ধীরে পত্রিকাটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।

প্রবল আবেগ ও রোমান্টিকতার কবি বুদ্ধদেব বসু। প্রেম বিষয়ে তার এত ব্যাকুলতা যা সাধারণ নয়। অনির্দিষ্ট প্রেমে তার মগ্নতা ছিল। কাব্য ফসলে প্রেমের চাষে তার বিচরণ দক্ষ শব্দচাষীর মতো। এত কাছাকাছি ভেবে খুব কম কবিই তা তুলে ধরতে পারেন। তাঁর ‘বন্দির বন্দনা’ ও ‘কঙ্কাবতী’র কবিতায়। প্রেমের মোহ থাকলেও মেলেনি মেয়েদের সঙ্গ। জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন ঢাকার খ্যাতিমান শিল্পী প্রতিভা সোমকে। তাঁর সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করা এবং অন্যকেও জালবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি, একবারই প্রেম পরিশেষে বিয়ে। তাঁর প্রেমখাতা কবিতার একটু ছুঁতো পেলেই তাপ প্রবল হয়ে উঠে। তাঁর ভাবনা এরকমÑ ‘প্রেমে পড়ে আছি যেকোনো মেয়ের, বছরের মধ্যে যেকোনো তারিখে যাকে চিনি অথবা চিনি না, যাকে দেখেছি অথবা দেখিনি, অথবা নাম শুনেছি হয়তো : যেকোনো একটি ছুতো পেলেই আমার নাড়ি চঞ্চল হয়ে ওঠে, মনের তাপমাত্রা বেড়ে যায়।’

নতুন কাব্য জগৎ বিনির্মাণের কবি বুদ্ধদেব বসু। ত্রিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার সৃষ্টি ও বিকাশের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনেক বেশি। রবীন্দ্র কাব্যধারাকে পাশ কাটিয়ে সাহিত্যে নতুন পথের খোঁজে বেরিয়ে সন্ধান করেন নতুন পথ। সমকালীন চিন্তায় প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যবোধকে ভেতরে নিয়ে রোমান্টিকতার পথে পা বাড়ান। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে স্বতন্ত্রভাবে দেখে নিজে আলাদা পথ তৈরি করেন। বিচিত্র অভিজ্ঞতা দেশকাল, সমকালীন জীবন প্রেম সমাজ, শারীরিক ও মানসিক দেহচেতনা, পরিবেশ ও প্রকৃতি, প্রতীক ও পুরাণ, সময় ও ধারণা এবং সমসাময়িক বস্তুবাদী বিশ্বের সঙ্গে মিলিত হয়ে নতুনত্বের যোগান দিয়েছেন। শৈল্পিক বিবেচনায় তিনি আলাদা প্রাণ। পাঠক যখন যা কামনা করেন তাই রয়েছে তার রচনায়। শুধু অনুভূতিকে কাজে লাগাতে হয়।

কোনো জিনিসের প্রতি আসক্তি মায়া মমতা বেড়ে যাওয়ার নামই প্রেম। উত্তেজনাপূর্ণ রহস্যানুভূতিও প্রেম। দেহ এবং মনের মিলনে ভাবরতির স্পর্শ সঞ্চার করে ইন্দ্রিয়ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয়। প্রেম ও রোমান্টিকতা দুটোকে কবি ভিন্নভাবে নিয়েছেন। তাই তার কবিতায় দেখা যায় নায়িকা অপর্ণা, অমিতা, রমা, মৈত্রেয়ী, কঙ্কাবতীকে নিরুপণ করে। নায়িকাদের চুল, ঠোঁট, দাঁত, স্তন, জিভ, কালো তিল ইত্যাদি অঙ্গপ্রতঙ্গকে রোমান্টিকতার চাদরে এনে সোজাসুজি উপস্থাপন করেছেন। যখন বর্ণনা এরকমÑ ‘তোমার গলার স্বর ছেঁড়া ছাড়া কথার টুকরো/তোমার চোখের আলো, গোল করে তোলা ঠোঁট দুটি/একটু জিভের আভা লাল আভা! ছোট সাদা দাঁত/ চকিতের বিদ্যুৎ ঝলক!/মনের অলিতে গলিতে এরা সবে ঘোরাফেরা করে।’ প্রেম খোঁজেন যেভাবেÑ ‘এসো, কাছে এসো/তোমার চুল দিয়ে আমাকে ঢেকে দাও/তোমার রাত্রি দিয়ে মুছে নাও/আমার সমস্ত জানা, সমস্ত বোঝা/তোমার উত্তাপ সঞ্চারিত হোক আমার রক্তে।’

বুদ্ধদেব বসুর কথাসাহিত্যে প্রধান বিষয়বস্তু প্রেম। প্রেমের নানাবিধ বিষয়গুলো ‘সাড়া’ থেকে ‘যমুনাবতী’ রচনা পাঠককে আকৃষ্ট করেছে। প্রেমের বিবরণে আছে স্মৃতি, বিষণœতা, প্রেম পরীক্ষায় অসমর্থ। নারী পুরুষ শ্রেণিভেদে কাহিনিজুড়ে প্রকাশ পেয়েছে। আদি মধ্য অন্ত সমন্বিতরূপে ও স্বাদে প্রেম অন্বেষণই তার স্বকীয়তা। ‘সাড়া’ উপন্যাসটি নির্মল সত্যের বয়ান। যেখানে বুদ্ধদেব মিলে যান শরৎচন্দ্রের আদর্শে। রূপালি পাখি, যেদিন ফুটলো কমল, বাড়ি বদল, আমার বন্ধুÑ উপন্যাসে সেরূপ প্রেমচিত্র এসেছে বহুগামিতায়। ‘লালমেঘ’ উপন্যাসে কোনো ভ-ামি চাটুকারিতা নেই, অবিনাশ, সন্ধ্যামণি, শোভনা জানে মায়ের জাত আর প্রিয়ার জাতে কোনো ভেদাভেদ নেই। দুজনেই রক্ত মাংসে গড়া স্ত্রীলোক। অবিনাশ শিক্ষিত তার রুচিবোধ বিদ্যমান সে শশাঙ্কের মতো নয়। লেখক এভাবে বর্ণনা করেনÑ ‘অবশেষে একদিন শশাঙ্ক বাগানে সূর্যমুখী কি রকম ফুটেছে দেখতে দেখতে হঠাৎ উর্মির হাত চেপে ধরে বলে, তুমি নিশ্চয়ই জানো, তোমাকে আমি ভালোবাসি। আর তোমার দিদি তিনি তো দেবী। তাঁকে যত ভক্তি করি জীবনে আর কাউকে তেমন করিনে। তিনি পৃথিবীর মানুষ নন, তিনি আমাদের অনেক উপরে।’

বুদ্ধদেব বসুর ওপর প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব লক্ষীয়। তাঁর কাছে সাধু ও চলিত ভাষাপ্রীতি বিতর্ক ছিল রীতিসিদ্ধ। গদ্যে পদ্য ঢং ব্যবহারে তার আপত্তি রয়েছে। তাঁর ঢঙটা বৈঠকি ধরনের। তাঁর লক্ষ্য ছিল শিক্ষিত লোকের সঙ্গে লেখার ভাষাগত বৈষম্য কমিয়ে আনা। তাই চলিত ভাষায় পাঠকের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। এ সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী বলেছেনÑ ‘পদ্য লেখক হিসেবে আমি স্বরস্বতীর মাথায় বুনেট পরিয়েছি, আর গদ্য লেখক হিসাবে আমার লেখায় হ্যাট পরিয়েছি’। যাতে সমকালীন পাঠক প্রেমের বার্তা সহজেই বুঝে যায়। হ্যাট পরা গদ্যে বুদ্ধদেব বসুর আগ্রহ ছিল। বাক্যে ইংরেজি শব্দের পাশাপাশি চলিত ক্রিয়াপদ বিষয়েও অস্থিরতা লক্ষণীয়। যেমনÑ ‘ঘোলা জল চিরে স্টিমার সামনের দিকে চলছে। তার দু’পাশের জল উঠছে পড়ছে, দুলছে তারপর ফেনা হয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে, জলকন্যার নগ্ন দেহের মতো শুভ্র, দ্রাক্ষারসের মতো স্বচ্ছ।’

বাংলাভাষার ঐতিহ্যগত কবি, কথাকার, সম্পাদক ও অনুবাদক হিসেবে প্রতিভার শীর্ষে ছিলেন তিনি। তাঁর লেখনীশক্তির প্রখরতা অনভূতির আকাশের মতো সুবিশাল। বিধ্বস্ত মানুষ থেকে সর্বশ্রান্ত প্রেমিক হিসেবে তার অবস্থান অন্যরকম। বিশ্বসাহিত্যের পল্লবিত এ বিদগ্ধজন ব্যাসকে ডিঙিয়ে সমকালীন চূড়ায় উঠেছেন। কখনো মাড়িয়েছেন সমাজ কখনো ক্ষরিত হৃদয়। বিশ্বসাহিত্যের কবিদের মতো তিনি প্রকৃতির বিপরীতায়নেও হাত বাড়িয়েছেন। সেখান থেকে তুলে আনেন অন্ত্যজ, নিচু দুঃখী মানুষের জীবনকিস্তি। এসবকে নানাভাবে রচনাশৈলীতে আঁটিবদ্ধ করেছেন। তাঁর একটা যুদ্ধ ছিল সেখানে, বীরের মতো কলম অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। সে যুদ্ধটা আধুনিকতার শত্রুপক্ষের সঙ্গে। তিনি যেভাবে স্থিতিস্থাপক হয়ে উঠেছেন তা আধুনিক বাংলা রচনারীতির ফসল। আধুনিকতাকে চিন্তায় ও মননে ধারণ করে সাহিত্যচর্চায় ব্রত হওয়ার কারণেই হয়ে উঠেন সর্বদেশীয় সাহিত্যিক।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close