মুসাফির নজরুল

  ১৬ নভেম্বর, ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধের বই ইতিহাসেরও

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিঃসন্দেহে বাঙালি জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ও প্রভাব বিস্তারকারী ঘটনা। ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বাঙালির অমলিন এক ইতিহাসেরও নাম। মুক্তিযুদ্ধ একদিকে যেমন কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু, অন্যদিকে দিয়েছে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার গৌরব। বহুজাতিক শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি বরাবরই সোচ্চার। তবে একাত্তরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জুলুমের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি যে সংগ্রাম গড়ে তোলে, তা ইতিহাসের বিরল একটি দৃষ্টান্ত। দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলার অকুতোভয় সন্তানরা স্বাধীন বাংলার লাল সবুজের পতাকা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতা লাভের পাঁচ বছরের মধ্যেই একাত্তরের পরাজিত শক্তির নীলনকশায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস নানাভাবে বিকৃত করার অপচেষ্টা করা হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতালোভীদের সঙ্গে একাত্তরের পরাজিত সেই অপশক্তি, পাকবাহিনীর এ দেশীয় চিহ্নিত দোসররা মিলে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে এই কাজটি করে। কিন্তু প্রকৃত সত্যকে যে কখনো চাপা দিয়ে দিয়ে রাখা যায় না, তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রণয়ন। কিন্তু কাজটি মোটেও সহজসাধ্য নয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম হিসেবে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এ কে এম তারিকুল ইসলাম রনি তার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘তাম্রলিপি’র মাধ্যমে ৬৪ জেলার মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস প্রণয়ন করেছেন। বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলার নিজস্ব ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসের সঙ্গে মাঠপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করে ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস মাগুরা জেলা’ গ্রন্থটি রচনা করেছেন কবি-গবেষক বীরেন মুখার্জী।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ৮ নম্বর সেক্টরের অধীন ছিল তৎকালীন মাগুরা মহকুমা। একাত্তরের এপ্রিল মাসে এই সেক্টরের অপারেশনাল এলাকা ছিল কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর ও পটুয়াখালী জেলা। বৃহত্তর যশোর জেলারই একটি মহকুমা মাগুরা। মাগুরা সদর, শালিখা, শ্রীপুর ও মহম্মদপুরÑচারটি থানার সমন্বয়ে মাগুরা মহকুমা গঠিত। ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস মাগুরা জেলা’ গ্রন্থে মাগুরার ‘শ্রীপুর বাহিনী’ গঠন, এই বাহিনীর বিভিন্ন প্রতিরোধ যুদ্ধের কাহিনি সবিস্তারে তুলে ধরা হয়েছে। গুরুত্ব দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে, তৎকালীন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকার কথা। নেতারা কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছেন, কীভাবে উৎসাহিত করেছেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সাইক্লোস্টাইল কপি কীভাবে মাগুরার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিতরণ করা হয়েছে ইত্যাদিসহ বিস্তারিত তথ্য। সংযোজিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে মাগুরার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতের বিহারে ট্রেনিংয়ে যাওয়ার কথা এবং ফিরে এসে গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিস্তারিত তথ্য। পাক-হানাদার বাহিনী প্রতিরোধে মাগুরার মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যগাথা তুলে ধরার পাশাপাশি এ গ্রন্থে একাত্তরের দিনগুলোয় পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর নির্যাতনের লোমহর্ষক চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধের কথা। নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, মাগুরার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গণকবর ও বধ্যভূমির তথ্য ও ছবি এবং মাগুরার গেরিলা ও প্রতিরোধযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার বিভিন্ন স্থানের চিত্রও সংযোজিত হয়েছে এ গ্রন্থে। গ্রন্থটি কিশোরদের পাঠ উপযোগী প্রাঞ্জল ভাষায় লিখিত। তবে মুক্তিযুদ্ধসম্পর্কিত বহু তথ্য, পত্রপত্রিকা, মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় ইতিহাস এবং স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে যেসব তথ্য এ গ্রন্থে উপস্থাপন করেছেন গবেষক, তা মাগুরার মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে আগ্রহী ছোট-বড় সব শ্রেণির পাঠকের পাঠতৃষ্ণাকে সমৃদ্ধ করবেÑএ কথা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়।

মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও গ্রন্থটিতে মাগুরার ভৌগোলিক অবস্থান, নামকরণের ইতিহাস, জেলা গঠন থেকে শুরু করে মাগুরার খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী, জাতীয় পর্যায়ে খ্যাত রাজনৈতিক নেতা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখা ব্যক্তিবর্গ, জেলার প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন, নদ-নদী, কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়েও বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। ফলে ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস মাগুরা জেলা’ গ্রন্থটি শুধু মুক্তিযুদ্ধের আকর গ্রন্থ হিসেবেই নয়, এটি মাগুরার সার্বিক ইতিহাস গ্রন্থ হিসেবও সমাদৃত হওয়ার যোগ্যতা রাখে। ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস মাগুরা জেলা’ গ্রন্থটি চিরায়ত গ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত হবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ এ গবেষণাগ্রন্থের জন্য বীরেন মুখার্জীও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন এমনটি আশা করা দোষের নয়।

‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস মাগুরা জেলা’ গ্রন্থটি দেশের ৬৪ জেলার ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস’ প্রণয়ন প্রকল্পভুক্ত একটি গ্রন্থ। প্রকল্পের উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং গ্রন্থমালা সম্পাদনা করেছেন আমিনুর রহমান সুলতান। এ ছাড়া সম্পাদনা পরিষদে যুক্ত থেকে ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্রগবেষক ও কবি আহমদ রফিক, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সেলিম (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক), ড. মোহাম্মদ মাহবুবুল হক (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক), ড. খোদেজা খাতুন (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক), ড. এ কে এম জসীমউদ্দীন (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক) মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মহান দায়িত্ব পালন করেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে মাগুরার মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা দেশের গৌরবান্বিত স্বাধীনতা অর্জনেরই একটি অংশ। একাত্তরে পাক-হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা যেভাবে বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা, ধ্বংসলীলা এবং নারী ও শিশুদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, বেদনাবহ সেই দৃশ্য যেমন ভুলবার নয়, তেমনিভাবে প্রবল বিক্রমে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের প্রতিরোধে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানও বাঙালি জাতিকে যেকোনো সংকটে সব সময় অনুপ্রেরণা জোগাবে। বাঙালির পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস’ অনন্য ভূমিকা রাখবে এ কথাও নির্দ্বিধায় বলা যায়।

মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস মাগুরা জেলা

বীরেন মুখার্জী

গ্রন্থমালা সম্পাদক : আমিনুর রহমান সুলতান

প্রকাশক : তাম্রলিপি

প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মূল্য : ২২৫ টাকা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close