ওয়াহিদ জালাল
কবির কাছে প্রশ্ন রাখতে নেই
একজন কৃষকের কাছে যেমন জানতে নেই সে কখন কোন ফসল ফলাবে, তেমনি একজন কবির কাছেও প্রশ্ন রাখতে নেইÑসে কখন কী কবিতা লেখবে। জমিনকে ফলবতী করে তোলার জন্য কৃষকের মন যেমন পড়ে থাকে মাটির কাছে, তেমনি একজন কবির মনেও সারাক্ষণ শব্দের চাষাবাদ চলে ভাবনার রূপায়ণে।
আমি একজন কবি ও একজন কৃষককে আবিষ্কার করি একই আত্মার দুই স্বপ্নচারী রূপে। কবি হতে পেরেছি কি না জানি না, তবে নিজেকে দাবি করি একজন শব্দচাষি হিসেবে।
অথবা যদি বলি, শব্দ দিয়ে সেলাই করার চেষ্টা করি জীবনের সুখ, দুঃখ, প্রেম, বিরহের ছেঁড়া টুকরোগুলো; তাহলে আমাকে শব্দের দর্জি বলে ডাকলেও শুনতে চাইব পুনর্বার সেই সংবোধন।
প্রশংসার শারীরিক তাপ
ভেজা চোখ মেলে পৃথিবীকে দেখি,
মাংসের আবেগে চিরকাল হয়েছে মলিন
ঝরে পড়া কদম ফুলের মতো,
শূন্যের ওপর তাকিয়ে রয়েছি অন্ধের দৃষ্টিতে
আঙুলের খুব কাছে তার বুক নড়ে ওঠে
কারো নিঃশ্বাসের হেঁটে চলা।
নদীর বুকের মতোই পৃথিবীটা নিখুঁত,
তুমি মনেও করতে পারবে না গর্ভধারিণীকে
যে মধুদুগ্ধ পান করিয়েছে রক্তের বাটিতে,
তবু আজ মানুষ-মানুষে ঘ্রাণে খিদে পায়,
উত্তেজিত দেহ এগিয়ে দেয় নষ্ট বাতাসের স্পর্শে।
অজস্র সন্ধ্যায় নুনের স্বাদ হয়েছি জ্বলে-পুড়ে
শ্যামল শিখায় শ্মশানের ওপর রাখা চিতার আগুনে
শুধু একটি নিঃশ্বাসের কাছে।
যে ধমনীতে টের পাই আলিঙ্গনের প্রবাহ
আজও তার কাছে আমি অতৃপ্তির পরম এক কিনার
রক্তের উল্লাসে আপন সুরে।
বিদীর্ণ বুকে জগতের নিয়ম
সেলাইবিহীন কাফনের পাপড়ি
মাটির অন্তরালে মাটিকে ঢাকছে,
হায় আল্লাহ!
বিপুল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দাও।
অন্ধকারের আংটি পরেছে জীবনের ব্যাখ্যা,
আজ আর কোনো বিলুপ্তিকে মানি না।
কাঁচামাটির ওপর দাঁড়ানো সূর্য
পশ্চিমের উঠোনে ভাষা রূপ ও রীতি
অনুভূতির যে গভীর নির্যাস প্রকাশ করছে
যে সুচের ভেতর দিয়ে পাহাড়ের চলাচল
দেখো, প্রেমকাতর আকাশের কোনো ছায়া নেই
সোনার চরিত্র জিজ্ঞাসা সে নিজেই প্রাণের ভেতর।
মাতৃস্তন, শিলা-পাথরের বালিশ, দীর্ঘ আয়ুকাল
কল্পনার কামনার স্বর্গের অভিমুখী গভীরতা
শব্দের মাঝখানে জ্বলে ওঠা আত্মার চিৎকার
তাতে কিসের সন্দেহ এত তোমার
শোনো, বুকফাটা আর্তি, আবেগ তরঙ্গিত বর্ণনা
তুমি অসীমে অধীন মহা-উন্নত
আমিও আজ একা নিস্তব্ধতায় মগ্ন।
আত্মকাব্য
প্রতিটি নিঃশ্বাস কষ্ট নিরাময়ের জন্য ক্ষুদ্র ছিল না
এক বিপুল আয়ু পারাপারে,
আজ ভাবি, আমি যেন একটি জখম ছিলাম আর
আমারে ভরে গেল অন্তের আদরে!
আমার ঘরখানি দুয়ার খুলে দিলো নিজের হাতে
বাড়ি যেন ভুলে যাই তার আকুল প্রার্থনাতে,
আমি বলি, ঘর, একবার চেয়ে দেখো,
দয়ালের আড়ত ডুবাচ্ছে নির্ধারিত সুমহান পরাজয়ের ঢেউ
নিরুদ্দেশের টানে মানুষ ভবঘুরে হলে খুঁজে না তো কেউ।
তোমার জন্যে শব্দাবলি
দেখো, একদিন পরাজয়ে অবেলায়
কতো স্মৃতি দুটি চোখে ভেসে বেড়ায়।
দেখো, একদিন সন্ধ্যার আকাশে চেয়ে
একটি পাখি মানুষের মতো গান যায় গেয়ে।
দেখো, একদিন রাতের গভীর অন্ধকারে
শূন্য বালিশ কারো বিরহে একা কেঁদে মরে ।
দেখো, একদিন ঘরে খুব একা হলে
শূন্য হলে কেমন করে গোপনে বুক জ্বলে।
দেখো, একদিন নিজের মুখখানি আয়নায়
কতো ভালোবাসলে মানুষ নীরবে চলে যায়।
মনে ছিল না
বেলা তখন কোনদিকে বাতাসের মতো
ভেসে যাচ্ছিল, একটুও মনে ছিল না
মানুষটির কণ্ঠে ভেসে আসা শব্দের আর্দ্রতা
গ্লাসে ভেজানো চুম্বনের মতো ভেসে
মনের কোথায় যেন খুব সহজেই লেগেছিল।
আমি চকচকে বালির মতো তবু জলের প্রার্থনায়
মেঘে ঢাকা আকাশকে অপবাদ দিয়ে বলেছিলাম
একটু বৃষ্টি নামলে আমি ভিজে যাবো
পিপাসার অনুকূলে নিজেকে বাঁচাবো বলে
যখন চিৎকার করছি
কৃষ্ণকীর্তন সেবেলা নৈকট্য অষ্টাদশে ভ্রমে।
চাঁদ হলে চাঁদ, জল হলে জল, ছায়া হলে ছায়া,
মানুষ হলে মানুষ, প্রেম হলে প্রেম
অবিকল পাখির মতো হলে তুমি
দেহের ভাঁজে ভেসে বেড়ানো মনপাখির মতো
একাকী আজ বেড়ালে আমার মনের আকাশে
পায়রার মতো ডানা মেলে।
বিশ্বাস করো, আমার একটুও মনে ছিল না
তোমাকে বলে আসি-আজ আমিও।
"