সোহেল নওরোজ

  ০৯ নভেম্বর, ২০১৮

হৈমন্তী আসবে বলে

নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের মতো হৈমন্তীকে আমাদের সামনে প্রথম হাজির করেছিলেন হেমন্ত স্যার। তিনি বাংলা পড়াতেন। শুধু পড়াতেন বললে পুরোটা বোঝানো হবে না; বাংলা সাহিত্যে তার দখল ছিল ঈর্ষণীয়। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও কেবল স্যারের কারণে আমরা বাংলায় মজেছিলাম। হৈমন্তীর কথা শুনে শুরুতে কেউ কেউ ভেবেছিল, স্যারের নামের সঙ্গে চরিত্রের নামের মিল থাকায় বোধহয় এত দরদ দিয়ে তিনি হৈমন্তীর গল্প বলছেন! আসলে ভেতরে তেমন কিছু নেই! ভুল ভাঙতে সময় লাগে না। অল্প সময়েই হৈমন্তীকে কেন্দ্র করে আমরা মৌমাছির চাকের মতো জমে যাই।

হৈমন্তী নামটা শুনে সবচেয়ে বেশি আহ্লাদিত হয় দেবু। পরিচয়ের আগেই হৈমন্তীকে নিজের সম্পত্তি বানিয়ে ছাড়ে। আমাদের কাছে এমনভাবে কথা পাড়ে, যেন হৈমন্তীর সঙ্গে তার জন্ম-জন্মান্তরের পরিচয়!

নামটা দেখেছিসÑ ‘হৈমন্তী’! নিশ্চিত ব্রাহ্মণ হবে। শুনলেই প্রেমে পড়ে যেতে ইচ্ছে করে। রুনু-ঝুনু টাইপের নামও তো হতে পারত! তা না হৈমন্তী! যার নাম এত মধুর, না জানি সে দেখতে কত সুন্দর!’

স্যার ক্লাসে রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ পড়ছেন, আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি। ক্ষণে ক্ষণে বুকের ভেতরে কেঁপে কেঁপে উঠছে। পাঠ্যবইয়ের আর কোনো গল্প শুনে কখনো এমনটি হয়নি। গল্পের শেষে রোকেয়া আর শারমীনের চোখ বেয়ে শ্রাবণধারা নামল। সমস্যায় পড়লাম আমি আর তানিম। দেবুকে হটিয়ে আমরা দুজন হৈমন্তীর প্রেমে পড়ে গেলাম। ছাড়া ছাড়া প্রেম নয়, আঠালো প্রেম। প্রেমে পড়ার স্বপক্ষে প্রমাণস্বরূপ কোনো না কোনো নিদর্শন রাখতে হয়। আমি হৈমন্তীকে একপ্রস্থ পত্র লিখে ফেললাম।

হৈমন্তী,

পত্রের শুরুতে ভালোবাসা নিও। কখনো কাউকে এভাবে প্রেমপত্র লিখব তা ভাবনাতেও ছিল না। তোমাকে কখনো দেখিনি, দেখব সে সম্ভাবনাও নেই। তারপরও কেন তোমার প্রেমে পড়লাম জানি না। স্যার যখন পড়ছিলেন ‘ভারী একখানি সাদাসিধা মুখ, সাদাসিধা দুটি চোখ এবং সাদাসিধা একটি শাড়ি। কিন্তু সমস্তটি লইয়া কী যে মহিমা সে আমি বলিতে পারি না।’ আমি যেন চোখের সামনে তোমাকে স্পষ্ট দেখছিলাম! এমন অনুভূতি আগে কখনো

হয়নি। একে কি প্রেম বলে? যদি প্রেম হয়, তবে আমি প্রেমিক হতে চাই। তোমার প্রেমিক। সাচ্চা প্রেমিক।

আমি যখন গল্পের অপুর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে তোমাতে বুঁদ হয়ে ছিলাম, তখন খুব সাধ হচ্ছিল ওই কথাগুলো যদি সত্যিই তোমাকে বলতে পারতাম! ‘আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম। কাহাকে পাইলাম! এ যে দুর্লভ, এ যে মানবী, ইহার রহস্যের কি অন্ত আছে?’ যদি এ কথাগুলো বলার মতো কাউকে পাই, দেখে নিও অপুর মতো নির্লিপ্ত থেকে তাকে অকারণ কষ্ট পেতে দেব না। আদর্শ প্রেমিক হয়ে আগলে রাখব আজীবন। হৈমন্তীদের ভুলেও কখনো কষ্ট দিতে নেই। কষ্ট দিলে সে কষ্ট কয়েকগুণ তীব্র হয়ে ফিরে আসে। ভালো থেকো। পুনরায় ভালোবাসা জেনো।

-ইতি তোমার একজন পাগল প্রেমিক (আশিক)

প্রেমে পড়লে মানুষ কী না করে! তা-ও উঠতি বয়সের প্রেম! আমি যখন হৈমন্তীকে প্রেমপত্র লিখে সেটি বুকপটেকে নিয়ে গর্বের সঙ্গে ঘুরছি, তানিম তখন আপাত চোখে প্রায় অসাধ্য সাধন করে ফেলেছে! যেনতেন ব্যাপার নয়, রীতিমতো হইচই ফেলে দেওয়ার মতো ব্যাপার। রাত জেগে রবীন্দ্রনাথের পুরো ‘হৈমন্তী’ গল্পটাই মুখস্ত করে ফেলেছে! আমি বলা মাত্রই গড়গড় করে বলতে শুরু করে দিলোÑ কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন, কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না...

দুই

একপক্ষীয় প্রেম নিয়ে ভালোই ছিলাম। প্রেমিক মন আনচান করে উঠলে হৈমন্তীকে চিঠি লিখতাম। একবার অসাবধানতাবশত বাবাকে লেখা চিঠির বদলে হৈমন্তীকে লেখা একটা চিঠি বাড়িতে চলে গিয়েছিল। মা কৌশলে সামলেছিলেন। তবে বাবার মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ ঢুকে গিয়েছিলÑআমি বোধহয় জাত-পাত ভুলে ভিন্ন ধর্মের কোনো মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি!

আমার হৈমন্তী-মগ্নতায় বাদ সাধল হুমায়রা হিম। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একই অনুষদে পড়ি। ও আমার এক বর্ষের ছোট। আমি ঝিম ধরে হিমের ক্লাসে যাওয়া-আসা দেখি। ওর সবকিছুই আমার ভালো লাগে। একবার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে পা মচকে গেল। যেন আমার হৃৎপি-টাই কেউ মচকে দিল! আমি ছুটে যাওয়ার আগেই সহপাঠীরা তটস্থ হয়ে পড়ল। ‘তেমন কিছু না’ বলে হৃদয় হৃদয় কাঁপানো হাসি দিয়ে চলে গেল হিম। মনকে প্রবোধ দিলাম, আগামীতে নিশ্চয় আবার সিঁড়িতে হোঁচট খাবে, তখন আরো বড় ধরনের ব্যথা পাবে এবং ওকে সাহায্য করার মতো আমি ছাড়া আশেপাশে আর কেউ থাকবে না!

হুমায়রাকে কখনো চিঠি লেখা হয়নি। কারণ, তার আগেই মোবাইল ফোন নামক যন্ত্র হাতে এসে গেছে। কাগজ-কলমের ঝামেলা খতম। বাটন টিপে মনের কথা লেখা যায়। কেন জানি এ যন্ত্রটা আমার মনে ধরল না। হৈমন্তীকে লেখা চিঠি আবেগের যে পাহাড় ধারণ করত, মুঠোফোনের ক্ষুদেবার্তায় বেঁধে দেওয়া শব্দ সংখ্যায় তার কিয়দাংশও ধরতে পারে না। আমার হাতে কম দামের ফোন। টিউশনির টাকা বাঁচিয়ে কেনা। হিমের হাতে বিদেশ থেকে পাঠানো দামি ফোন। তা দিয়ে দেদারসে ছবি তোলে, কানের হেডফোন ঢুকিয়ে গান শোনে। ইচ্ছে হয়, হেডফোনের একটা প্রান্ত আমার কানে ঢুকিয়ে দুজন একসঙ্গে গান শুনি। তা আর হয়ে ওঠে না। কারণ, তত দিনেও আমার মনের কথাটা ওকে বলা হয়ে ওঠেনি। তবে ওর কাছে আমার আরেকটা পরিচয় পৌঁছে গেছেÑআমি অদৃশ্য হৈমন্তীর দৃশ্যমান প্রেমিক!

হৈমন্তীই আমাদের দুজনকে খানিকটা কাছে এনে দিল। ক্লাসের বিরতিতে একদিন হুমায়রা আমাকে ডাকল। আমি চমকে চাওয়া মন নিয়ে হাজির হয়ে হিমের সামনে গিয়ে থমকে গেলাম। কল্পনার হৈমন্তীর সঙ্গে কী অদ্ভুত সাযুজ্য! হুমায়রা সামনের অগোছালো চুল আলগোছে সরিয়ে হৈমন্তীর প্রসঙ্গ তুলল।

‘হৈমন্তীকে আপনি কতটা ভালোবাসেন?’

আমি এ কথার যুতসই কোনো জবাব খুঁজে পেলাম না। মুখ দিয়ে অপুর কথাটাই বেরিয়ে গেল-

‘হৈমন্তী আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ।’

‘এ তো বললেন অপুর কথা। আপনার ভালোবাসার কথা বলুন।’

‘আমার ভালোবাসার কথা মুখে বলতে পারি না। কাগজে লিখি। পড়বেন সেসব কথা?’

‘আপনার আপত্তি না থাকলে পড়তে চাই।’

যেদিন আমি হৈমন্তীকে লেখা চিঠিগুলো হুমায়রাকে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাই, সেদিন সে-ও আমার জন্য একটা রঙিন খাম নিয়ে আসে। মুখ খোলা খাম। ভেতরে শক্ত কাগজ। আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘এটা আমার বিয়ের কার্ড। আগে থেকেই পাত্র ঠিক করা ছিল। বিদেশে থাকে। এই যে মুঠোফোনটা দেখছেন, এটা ওরই পাঠানো। ও ভীষণ আধুনিক। কী চমৎকার এসএমএস পাঠায়! আমি এত তাড়াতাড়ি চাচ্ছিলাম না, কিন্তু বাবা-মা আর দেরি করতে চাইলেন না। আপনি কিন্তু অবশ্যই আমার বিয়েতে আসবেন। না এলে খুব রাগ করব।’

পরিণয়ের প্রান্তে দাঁড়িয়ে তুচ্ছ কিছুর প্রতি আগ্রহ থাকার কথা নয়। হাতের চিঠিগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার অন্তত তাই মনে হয়েছিল। মনের কথা বলার জন্য হুমায়রা নয়, হৈমন্তীই উপযুক্ত। চিঠিগুলো তাই যতেœ রেখে দিলাম। সেদিনই বুঝে গেলাম, এখানেই শেষ নয়, আরো অনেক কথা হৈমন্তীকে বলতে হবে, অগণিত মুহূর্ত পার করতে হবে হৈমন্তীকে ভেবে।

তিন

এবার হেমন্ত ঋতু আসার পর থেকে পুরনো সমস্যা নতুন দিকে বাঁক নিয়েছে। প্রায়ই প্রত্যুষে হৈমন্তী আসে। লোকে যেটাকে স্বপ্ন বলে, আমার কাছে তা বাস্তবের চেয়েও নিখুঁত ও দামি মনে হয়। সাদামাঠা একটা শাড়ি পরে আসে হৈমন্তী। সন্তর্পণে চৌকিতে বসে। যেন আমার এ চৌকিটা তরতাজা ফুলের বাগান, ভুল করেও ফুলকে আঘাত দেওয়া যাবে না! আমি কিছু জিজ্ঞেস করলেই ও হাসে। নিঃশব্দ হাসিতে আশ্চর্য হই। আমি তাতে বিস্তর অর্থ খুঁজে পাই। আমার কেবলই বলতে ইচ্ছে হয়Ñ ‘এ হাসি বিধাতা যাহাকে দিয়াছেন, তাহার কোনো কথা বলিবার দরকার নাই।’

কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছি। কার্ণিশের ফাঁক গলে হালকা শীতল বাতাস এসে চোখে-মুখে আরামদায়ক পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। মৃদু কুয়াশার পাতলা চাদর সরিয়ে নতুন সূর্যের মতো আভা ছড়িয়ে এ সময়টাতেই হৈমন্তী আসে। আজও আসবে কি? আমি দরজা খোলার শব্দ পাই। ঘরটা মায়াবী আলোয় আলোকিত হয়। পা টিপে টিপে ও হেঁটে এদিকেই আসছে। আমি চোখ না খুলেই অনুচ্চ স্বরে ডাকিÑহৈমন্তী, আমার হৈম!

হৈমন্তীর জন্য আমার অপেক্ষা ফুরোয় কাঁথার এক প্রান্তের হ্যাঁচকা টানে। হৈমন্তী তো কখনো এমন করেনি, তাহলে! চিরায়িত নৈঃশব্দের বদলে কলিজা কাঁপানো হাসিতে ঘরটা দুলে ওঠে, সঙ্গে আমিও। তটস্থ হয়ে চোখ খুলে দেখি হাতখানেক দূরে অবন্তী দাঁড়িয়ে। ওকে দেখার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে তড়িঘড়ি উঠে বসি।

‘তুমি এ সময়?’

‘কেন এখানে আসার ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি?’

‘না না, তা হবে কেন?’

‘অনেকক্ষণ বসে ছিলাম, তুমি উঠছ না দেখে...।’

‘খুব ভালো করেছ। এক্ষুণি উঠছি।’

‘জানি আমাকে দেখে খুশি হওনি। অবন্তী কখনো হৈমন্তী হতে পারে না। তবু কী আর করার! বাকি জীবন এই অবন্তীর সঙ্গে কাটানোর প্রস্তুতি নাও।’

ভুলেই গিয়েছিলাম আজ ছুটির দিন। অবন্তীর সঙ্গে শপিংয়ে যেতে হবে। এই হেমন্তেই আমাদের বিয়ে। আমি চাই বিয়ের পরেও যেন হৈমন্তী হারিয়ে না যায়! তার জন্য অবন্তীকে রাজি করাতে হবে। মুখটা ওর কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলি, ‘বলছি কী, হৈমন্তী আর অবন্তী নামের মধ্যে খুব বেশি ফারাক তো নেই। বিয়ের পর আমি যদি তোমাকে হৈমন্তী নামে ডাকি খুব কি অসুবিধা হবে?’ অবন্তী যেন জবার দেওয়ার জন্য প্রস্তুতই ছিল, ‘তাহলে চিঠি লেখার অভ্যাসটাও ছাড়তে পারবে না। হৈমন্তী সম্বোধনেই আমাকে লিখবে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ব।’

আমার বুকে অবন্তীর মাথা। ওর চোখে মুক্তোদানার মতো অশ্রু। তা আড়াল করার চেষ্টা করে না। অশ্রু এমন মোহনীয় এবং অন্তর্ভেদী হতে পারে, কখনো বুঝতে পারিনি। হয়তো এভাবে খেয়াল করার সুযোগ হয়নি। ঠিক যেন ওর চোখের কোণে থাকতে পেরে খুশিতে টলমল করছে! হঠাৎ খুব জানতে ইচ্ছে করে, হৈমন্তী কাঁদলেও কি অশ্রুরা আনন্দে এভাবেই হেসে উঠত?

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close