আহমদ রফিক

  ০২ নভেম্বর, ২০১৮

সালাম সালেহ উদদীনের গল্প

নাগরিক সমাজের আধুনিকতা ও বিচ্ছিন্নতার টানাপড়েন

আমাদের সাহিত্যে ছোটগল্পের যাত্রা পঞ্চাশের দশক থেকে তার নিজস্ব রূপ ও চরিত্র নিয়ে দেখা দিতে থাকে। সেখানে তখন কাঁচা মাটি বা কাঁচা ধানের গন্ধ প্রধান হয়ে থাকতে দেখা গেছে। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ যেমন ধীরগতিতে, তেমনি নাগরিক আধুনিকতার প্রকাশ সমাজ মানসে প্রতিফলিত হওয়ার প্রক্রিয়াও বেশ ধীরেসুস্থেই এগিয়ে চলেছে। পশ্চিমা সভ্যতার জৌলুসও তার প্রভাব রেখেছে অমনি শ¬থগতিতে। সত্যি বলতে, এ দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক আলোড়ন ভাষা আন্দোলনের ঢেউ গণতান্ত্রিক চেতনার যে প্রকাশ ঘটায় এবং সেই সঙ্গে অস্ফুট জাতীয়তাবোধের প্রতিফলনও ঘটায় সেসব কেন্দ্র করেই সাহিত্যের যাত্রাপথে নতুন সাংস্কৃতিক বোধের সঞ্চার; ছোটগল্প এর বাইরে নয়।

সূচনা পর্ব থেকে দীর্ঘদিন ছোটগল্পে গ্রাম ও গ্রামীণ জীবন প্রাধান্য পেয়েছে, সে জীবনের সমস্যা নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। সেখানে সামন্তবাদী চিন্তাভাবনা, আচার-আচরণের প্রকাশ প্রমাণ করেছে ‘লাল সালু’র বাংলা তখনো ভিন্ন পথ ধরতে শেখেনি, বরং অন্যরূপে ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে বেঁচে আছে। অবশ্য এর মধ্যে মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত শ্রেণির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নগরচেতনার বিকাশ ঘটতে শুরু করেছে, কিন্তু সেখানে গাছগাছালি, মাটি, আকাশ ও মাঠ-ময়দানের চেতনা তখনো প্রধান হয়েছিল। তবে পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকে পৌঁছে এ পটভূমিতে জীবনযাত্রার রক্তাক্ত-স্বেদাক্ত দিকও প্রতিফলিত হতে থাকে, যা একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরিণামে ভিন্ন চরিত্রের জন্ম দিয়েছিল। এ প্রভাব বেশ কিছুকাল গল্প-উপন্যাসকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে মধ্যবিত্তের চেয়ে প্রতিগতিতে বিকশিত বিত্তবান শ্রেণির নাগরিক প্রকাশ এ দেশের সমাজে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। পাশ্চাত্য প্রযুক্তি প্রভাবে ভোগের উপকরণের প্রাচুর্য, ভোগবাদিতা যেমন ক্রমশ প্রকট হতে থাকে এবং সমাজে এর প্রভাব ব্যাপক হতে থাকে, তেমনি অবক্ষয়ী সংস্কৃতির প্রভাবও সমাজজীবনে, ব্যক্তিজীবনে ভিন্নমাত্রিক চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে। তা সত্ত্বেও সত্যিকার অর্থে গ্রামীণ চেতনা তার বহুকালধৃত রক্ষণশীলতা এবং অনুরূপ প্রভাব থেকে মুক্ত নাগরিক আধুনিকতায় সমৃদ্ধ সমাজ যে এখনো পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি, মননশীল আধুনিক চেতনার প্রকাশ প্রয়োজনীয় বিস্তার অর্জন করেনি, এ কথা অস্বীকার করা কঠিন। তবু ওই ছোট হয়ে আসা পৃথিবী সম্পর্কে সচেতনতা এবং বিত্ত ও ভিন্ন ভূগোলের পারস্পরিকতা নাগরিক সমাজে যে প্রভাব ফেলে চলেছে, সে কথা অস্বীকার করা কঠিন। এই নিরিখেই সাহিত্যে ব্যক্তিচেতনার প্রভাব, ব্যক্তিমনের আত্মঅন্বেষার টানও ক্রমশ পরিস্ফুট হতে শুরু করেছে। তাই দেখা যায় জীবনের বৈচিত্র্য রূপায়ণে এবং তার গভীরতা সন্ধানের চেষ্টা, সেখানকার অন্তর্নিহিত স্রোতের দ্বন্দ্ব ও বৈপরিত্য শনাক্ত করার চেষ্টাও গল্পকারদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। নাগরিক সমাজে বহির্মুখী পরিবর্তনের যে ঢেউ জাগছে, তার সঙ্গে পুরনো স্রোতের অন্তর্মুখী টানের উপস্থিতি অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও ভিন্নগতির চরিত্র পরিস্ফুট করে তুলছে। এ টানাপড়েন বর্তমান সমাজ ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। এর মধ্য দিয়ে আধুনিকতা ও

মননশীলতার প্রকাশ কতটা ঘটছে এবং কতখানি উৎকর্ষ নিয়ে ঘটছে, তা নিশ্চয়ই বিচার্য বিষয়।

সাহিত্যে জীবনচিত্র রূপায়ণের ক্ষেত্রে এই টানাপড়েন ও দ্বৈতটানের উলি¬খিত পটভূমিতে সালাম সালেহ উদদীনের গল্পগ্রন্থ ‘অদূরবর্তী কেউ’ বিবেচনার যোগ্য। শুধু নাম গল্পই নয়, এ সংকলনের বেশ কিছু গল্পের এবং বলা যায়, এ বইয়ের প্রধান গল্পগুলোতে ওই দ্বৈতচেতনার প্রকাশ পরিস্ফুট। তবে এই সঙ্গে ভিন্ন চরিত্রের গল্পও রয়েছে। রয়েছে পাড়ভাঙা পদ্মার টানে দুস্থ মানুষ, পদ্মাচরের নানামুখী রূপ নিয়ে লেখা চিত্র, কিন্তু এগুলো প্রমাণ স্রোত নয়, প্রমাণ চরিত্রও নয়।

‘অদূরবর্তী কেউ’ বর্তমান সমাজে নিহিত গ্রাম-নগরের আত্যন্তিক জীবনসূত্রটাকেই তুলে ধরে, মানসগত ও চরিত্রগত ব্যবধানের মধ্যে সংলগ্নতার টান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দ্রুত বিকশিত শিক্ষিত ও বিত্তবান শ্রেণি-সমন্বিত নাগরিক সমাজ যে তার শিকড়-বাকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নাগরিক চৈতন্যের বিকাশ ঘটাতে পারেনি, তা এখানে পরিস্ফুট। দূর-অদূরের সম্পর্কটা এখনো তাই জটিল ও অবিচ্ছিন। কিন্তু অবিচ্ছিনতা এখানে সত্য নয়, বিচ্ছিনতার টানই বরং সত্য হয়ে উঠতে চেষ্টা করেছে। নাগরিক-চেতনা সত্যই বিচ্ছিনতার ওপরই বেড়ে উঠতে চাইছে যেমন অর্থনৈতিক-সামাজিক দিক থেকে, তেমনি মন ও মননের দিক থেকে।

‘অদূরবর্র্তী কেউ’ এবং অনুরূপ কোনো কোনো গল্প আমাদের এই বোধে নিয়ে যায়। পেছনে ফেলে আসা গ্রাম-জননীভূমির দিকে এগিয়ে চলা আধুনিক মানুষটিকে নিয়ে উপস্থাপিত ঘটনা এবং তার প্রতিক্রিয়া থেকে সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিচ্ছিন্ন জীবনের টান ও অনুষঙ্গ নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে এ গল্পে কখনো ঘটনাবিন্যাসে, কিন্তু প্রধানত নায়ক চরিত্রের প্রতিক্রিয়ার প্রতীকী রূপায়ণে। সবুজ মাঠ, উঠতি ফসলের রূপ, আকর্ষণীয় নিসর্গ কিছুই তাকে পুরনো অবস্থানে নিয়ে যেতে পারছে না। মাঝখানে এক বিশাল ব্যবধান চোরাবালির মতো লুকিয়ে আছে।

আর সে কারণে তার মনে হয়েছেÑ ‘এই বিশাল প্রান্তর, সবুজে আবৃত চারপাশের সে কেউ না। সে হঠাৎই ছিটকে পড়েছে এ বালুময় পথে। বলতে গেলে সে এখানে পুরোপুরি বেমানান।’ ছোট বোন রুমার হাত ছেড়ে দিয়ে একাকী দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যেই বিচ্ছিন্নতাবোধের প্রতীকী আচরণ প্রকাশ পেয়েছে। এতে শ্রেণিগত ও সামাজিক অসঙ্গতির দিকটিও যথার্থ তাৎপর্য নিয়ে পরিস্ফুট। মাথার ওপরে উদার বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়েও তার অনিশ্চয়তাবোধ কাটে না। এই চেতনা বাংলাদেশের উঠতি বিত্তবান সমাজের নাগরিক জীবনের নিহিত সত্যকে তুলে ধরে, যে বাস্তবতা বর্তমানের সত্য, এর ভালোমন্দ বিচার সিদ্ধান্তকে যেকোনো দিকে টেনে নিয়ে যাক না কেন। এর অনিশ্চয়তা, এর ভিত্তিহীন ফাঁপা চরিত্র সমাজতাত্ত্বিকের আলোচনার বিষয়। এখানে গল্পে এর প্রতিফলনটাই বড় কথা এবং সেটাই বাস্তব সত্য। বিচ্ছিন্নতার এই দ্বান্দ্বিক জটিলতাই এই গ্রন্থের ধান গল্পগুলোর মূল সুর।

এ সংকলনের আরো কয়েকটি গল্পে ওই নাম গল্পের চেতনা প্রকাশ পেয়েছে। ‘অসময়ে এক দিন’ এদিক থেকে সামান্যই ভিন্ন। শুধু বিত্তবান বা উচ্চশিক্ষিত শ্রেণির উচ্চমার্গের প্রতিনিধিই নয়, রাজধানীর সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের তরুণও প্রকারান্তরে একই মানসিকতা বহন করছে, যদিও ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। আবার ভিন্ন পটভূমিতে মধ্যবিত্তের নাগরিক জীবনের অসঙ্গতি গ্রাম-নগর টানাপড়েনের ভিন্ন এক মাত্রা তুলে ধরে যদিও তার রূপ মোটেই আকাক্সিক্ষত নয়। কিন্তু সেখানে সামাজিক সত্য ও শ্রেণি সত্যের অবাঞ্ছিত বাস্তবতাকে স্বীকার না করে উপায় থাকে না। ‘অভিন্ন বৃত্ত’ বা ‘জেগে থাকবে স্বপ্ন’Ñ সেই সত্যকেই পরিস্ফুট করে তোলে।

অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের ভিন্ন প্রেক্ষাপটের গল্পও সংকলনে রয়েছে, কিন্তু সেগুলো গল্পের মূল চরিত্রকে প্রতিফলিত করে না। ‘অদূরবর্তী কেউ’-এর ভাষা স্বচ্ছন্দ, সাবলীল, গতিময়। গল্পগ্রন্থটি বর্তমান সমাজ ও সময়ের অন্তর্নিহিত কিছু চরিত্র তুলে ধরেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close