জায়েদ ফরিদ

  ২৬ অক্টোবর, ২০১৮

ভাঁটফুল

ছোট এক জংলা পাহাড়। পাহাড়ের ঢালে সবুজ ঝোপ। ঝোপের মাথায় টুকরো টুকরো সাদা মেঘ। মেঘ নয়, থোকা থোকা ভাঁটফুল। মংলা বাউল বলেন ঘণ্টাকর্ণ। আজ মাসের প্রথম মঙ্গলবার। এই দিনে বাউল আসেন তার পাহাড়ি আখড়ায়। ক’দিন থাকেন আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যান। মঙ্গলবার আসেন বলে পাহাড় চাতালের বসবাসকারী লোকজন তাকে ডাকে মংলা বাউল, কেউ বলে মঙ্গল সন্ন্যাসী।

সন্ধ্যার আকাশে বাদামি মেঘ। মংলা বাউল তড়িঘড়ি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে থাকেন। বৃষ্টি হলে অন্ধকারে পাহাড় বেয়ে ওঠা দুষ্কর হবে। তার হাতে সাতবাঁকা এক লাঠি। আজ লাঠিটাকে বোঝা মনে হয়। ঝোড়ো বাতাস উঠে আসছে। তার গেরুয়া বসনে বাতাস আটকে গেলে বিব্রত বোধ করেন। লাঠি আর কাপড় দুটোকেই অতিরিক্ত মনে হয়। মংলা বাউল ভগবান বুদ্ধের কথা ভাবেন, তার সংঘের কথা।

একজন সংসার ত্যাগ করে সংঘে যোগ দিতে এসেছিলেন, সঙ্গে এনেছিলেন শুধু একটি ঘটি। তিনি বুদ্ধকে বললেন, ‘সর্বত্যাগী হয়ে এসেছি আমি, শুধু এই ঘটিটা এনেছি জলপানের নিমিত্তে।’ বুদ্ধ বললেন, ‘জলপানের জন্য তো অঞ্জলিই যথেষ্ট।’ মংলা বাউল মরণের কথা ভাবেন, ওখানে তার একতারা, লাঠি, গেরুয়া কিছুই যাবে না। কিন্তু যতদিন মৃত্যু হচ্ছে না, ততদিন তার এগুলো বয়ে বেড়াতে হবে, সঙ্গে বয়ে বেড়াতে হবে মানুষের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা।

২.

পাহাড়ের ঢালে সাফসুতরো লিচুর বাগান। বাগানের প্রান্তে চোখ পড়ে বাউলের। একটি লাল রঙের জামা বৃষ্টিধোয়া শেকড়ের সঙ্গে ঝুলে আছে। সেদিকেই পা বাড়ান মংলা বাউল। কাছে গিয়ে বিস্মিত হনÑ লাল ফ্রকের ভেতরে বেহুঁশ ঘুমিয়ে আছে একটি ফুটফুটে মেয়ে। নিশ্চয়ই পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়েছে, শেকড়ে না আটকালে নির্ঘাত খাদে পড়ে যেত। বাউল একতারা আর লাঠি ফেলে বৃক্ষের দিকে সম্ভ্রমে নত হয়ে বিড়বিড় করে মেয়েটাকে তুলে নেন দুহাতে। আর একটু এগোলেই তার আখড়া। মেয়েটার গা থেকে ভাঁটফুলের বুনো গন্ধ বেরুচ্ছে। বাউল ভাবেন, নিশ্চয়ই সে ফুল তুলতে গিয়েছিল।

আখড়ায় গিয়ে দরজায় টোকা দেওয়ার আগেই বেরিয়ে এলো অপেক্ষারত দুই সন্ন্যাসী। কুঁড়েঘরে বৃষ্টির ঝমঝম নেই, নিরিবিলি মিরমির শব্দ, বাউলগানে কোনো ব্যাঘাত নেই। সেবা যতœ শুরু হলো মেয়েটার, প্রায়ান্ধকার ঘরে। রাত হলো, তখনো টিপটিপ বৃষ্টি। মংলা বাউল বারান্দায় দাঁড়িয়ে চেয়ে আছেন বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়।

লিচু বাগানের তলা দিয়ে আখড়ার দিকে উঠে আসছে একটি লোক। ক্রাচে ভর দিয়ে, সঙ্গে মানকচুর ছাতা মাথায় একটি ছেলে, হাতে ধোঁয়ামলিন হারিকেন। বারান্দায় পৌঁছে কিছু জিজ্ঞেস না করেই ছেলেটি ঘরের ভেতর ঢুকে চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘এই যে বহ্নি এখানে!’

বহ্নি চোখ মেলে চাইল। এক হাত বাড়িয়ে দিল বাবার দিকে, আরেক হাত ছেলেটির দিকে। সে উঠতে চাইল, সবাই তাকে বারণ করল। সে তবু উঠে বসে বলল, ‘আমার কিছু হয়নি, শুধু ডান গালে একটু আঁচড় কেটেছে।’ প্রদীপের আলোয় অনেক কথা হলো। বহ্নি জিজ্ঞেস করল, ‘মঙ্গল কাকা, আপনার একতারা আর লাঠি কোথায়?’

বৃষ্টি কতটা কমেছে দেখার জন্য বারান্দায় গেলেন বাবা। ফিতাবাঁধা ফ্রকের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একমুঠো ভাঁটফুল বের করে আনল বহ্নি। হাত লম্বা করে ছেলেটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নাও তোমার ভাঁটফুল।’ মংলা বাউল মুচকি হেসে বললেন, ‘ও, ভাঁট তুলতে গিয়ে এই ঘটনা!’ বারান্দার ওপর দিয়ে নামছে সবাই, সঙ্গে মংলা বাউল। তার কোলে বহ্নি, তাকে কিছুতেই হাঁটতে দেবেন না। লিচু তলায় এসে বহ্নিকে কোল থেকে যতœ করে নামালেন। এরপর তুলে নিলেন ফেলে যাওয়া সাতবাঁকা লাঠি আর একতারা। ইতোমধ্যে একতারার লাউয়ের খোলে জমেছে অনেক জল। সেই জল একটু পানও করলেন মংলা বাউল আর বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমার বুক ভরা, প্রাণ ভরা খালি তিষ্টা। তিষ্টা মেটানোর জন্য সারা জীবন খালি গান করলাম আর আমার একতারা, আমার মনের বাহন একতারাডাও সারা জীবন তিষ্টায় মইরলো।’

‘কীসের তেষ্টা বাউল? আপনি কি জলের তেষ্টায় গান করেন?’ জিজ্ঞেস করেন বহ্নির বাবা।

‘ঠিক বলিছেন মহাজন, জলের তেষ্টায় যদি গান করি তাহলি জলটা হলো ঈশ্বর।’

‘আর আপনার একতারা, তার তেষ্টা কী?’

‘তার তিষ্টাও একই প্রকার, জড় জীব সব কিছুরই তিষ্টা একরকম। দেখেন না টোকা দিলিই দিবারাত্রি কেমুন বিলাপ করে, জল পাব কি, জল পাব না...’

বহ্নি আঙুল দিয়ে দেখাল, ‘এই আমার খেলাঘর কাকু, এই লিচু গাছেই আমি খেলি, তুমি তো এদিক দিয়েই যাও, কতদিন দেখি তোমাকে। এবার এসে খেয়ে যেও যেদিন আমি লিচুতলায় চড়–ইভাতি করি।’

‘তা আসব, না খালি বাঁচে নাকি কেউ? তুমি আমি লেচুগাছ লালভাট সাদাভাট, পাহাড়পর্বত, কেউ না, কেউ বাঁচে না...।’ বাউল খিলখিল হাসেন, আর সে মুহূর্তে লিচুতলা দিয়ে বয়ে যায় দমকা হাহুতাশ।

পাহাড় ঢালে গড়িয়ে পড়ার পর থেকে বহ্নির পাহাড়ে ওঠা নিষেধ হয়ে গেছে, তার খেলাঘরের সীমানা এখন লিচু বাগান পর্যন্ত। লিচু গাছের নিচু ডালে তার সংসার। দুপুর বেলা সে গাছের ডালে বিছানা পাতে। সেখানে পুতুলরা ঘুমায়, সেও ঘুমায় দোডালায়। তার ডালের পাশে আরেকটি ডালে শুয়ে থাকে প্রাণ। বহ্নিকে ছেড়ে কোথাও খেলতে যায় না সে। দুর্ঘটনার পর থেকে কোনোদিন ভুলেও বলে না ভাঁটফুল এনে দেওয়ার কথা। বহ্নিও তাকে যেতে দেয় না। লিচু গাছের সীমানার বাইরে সব কিছুই তার বৈরী মনে হয়।

মঙ্গলবার মংলা বাউল আসেন। সেদিন গাছের নিচে চড়–ইভাতি হয়। তিনজনে মিলে খিচুড়ি আর শাকপাতা ভর্তার আয়োজন করে। এই খিচুড়ি খেতে আসে এক বন-কর্মচারীর ছেলে। একরকম জোর করেই বসে পড়ে সে দলের সঙ্গে। বহ্নি তাকে ভিড়তে দিতে চায় না। ছেলেটা দম্ভ নিয়ে বলে, তার বাবা বলেছে, লিচুর বাগান কেটে পরিষ্কার করে এখানে আনারসের বাগান হবে।

মংলা বাউল পায়ে পায়ে বন বিভাগের অফিসে যন। এক কর্মচারীকে দেখে বলেন, ‘দয়াল, এই লিচু গাছগুলো কেটে আনারস লাগাবেন শুনিছি?’

‘হ্যাঁ, এখানে লিচুর ভালো ফলন হয় না, সরকারই বাগান করবে আনারসের, অনেক টাকা খরচা হবে। কিন্তু সরকার দেবে সেই পয়সা, তুমিও কাজ করলে পয়সা পাবে, ভিক্ষে করে আর কত পাও?’

‘লালন ভিক্ষে করেছে, ভগবান বুদ্ধ ভিক্ষে করেছে, আমি করলি আর দোষ কী! অন্যের অনুগ্রহে বাঁচার মধ্যি একরকম সুখও আছে, সেই সুখটা কম না কি! আপনি ভিক্ষে করেন দয়াল, দ্যাকপেন আপনার ভিতরেও সেই সুখ ঢুকে পড়িছে।’

বন কর্মচারী ক্ষেপে যান, ‘তুমি তোমার আখড়ায় গিয়ে মরোগে। এইখানে কেনো, ভিক্ষে করার পরামর্শ দিতে এসেছ আমারে?’

দারোয়ান এসে যোগ দেয় ঘটনায়, ক্রাচ বগলে বের হয়ে আসে পুরনো কর্মচারী বহ্নির বাবাও, ‘আমি যতদিন আছি ততদিন এই বাগান থাকবে, অফিসের কাজ করতে গিয়ে পঙ্গু হয়ে গেলাম, আমার একটা কথা কি রাখবে না বড় সাহেব!’

রাতের বেলা বাউলের আখড়ায় যান বহ্নির বাবা। বাউল নেই, ফিরে আসতে গিয়ে দেখেন অন্ধকারে লিচুতলায় বসে আছেন বাউল।

‘তুমি এইখানে? আমি তোমারে আখড়ায় খুঁঁজে এলাম। এই অন্ধকারের মধ্যে বসে আছ, রাতের বেলা কত রকম জন্তু-জানোয়ার বের হয়, বুনোশুয়োর তো আছেই।’

‘আপনের জীবনও নিরাপদ না মহাজন, যে অফিসে কাজ করেন সিখেনেও কিছু বুনো জন্তু আছে। কুন সময় কারে আক্রমণ করে, কিছু ঠিক নাই।’

এভাবে কেটে যায় কয়েক বছর। বহ্নিশিখা স্কুল থেকে ফিরে অভ্যাসবশত এখনো লিচু গাছের খেলাঘর নিয়ে থাকে। ইদানীং নিজেকে একটু ভারী মনে হয়। ভেতরে ভেতরে অকারণেই লজ্জা বেড়ে ওঠে তার। বন কর্মচারীর সেই ছেলেটা দোডালায় উঠে আসে, ‘এই ভুন্নি, লিচু দে আমারে।’ বহ্নি বিরক্ত হয়, ‘ভুন্নি বলবি না, লিচু নেই আমার কাছে। গাছ থেকে পেড়ে খাগে যা।’

ছেলেটা বলে, ‘আছে, মিথ্যে কথা বলিসনে ভুন্নি, তোর জামার নিচে দুটো লিচু লুকোনো আছে, সেই দুটো দে।’ বহ্নি তার মুখে লিচুর ডাল দিয়ে আঘাত করে।

পরদিন মংলা বাউল গল্পটা শোনেন, তারপর বলেন, ‘তুমি এখন লেচু গাছের খেলাঘর ছেড়ে সত্যিকারের খেলাঘরের জন্যি তৈরি হও মা।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close