reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৬ অক্টোবর, ২০১৮

সাহিত্য কি মৃত?

মূল : ডেভিড এল ইউলিন, রুপান্তর : মাহমুদুর রহমান খান

একদিন সন্ধ্যায় আমার পনেরো বছর বয়সী ছেলে নোয়া আমাকে বলছিল, সাহিত্য মারা গেছে। আমরা খাবার টেবিলে ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’ বইটি নিয়ে আলোচনা করছিলাম; যা সে নবম শ্রেণির মানবিক শাখার জন্য পড়ছিল। কিন্তু ক্লাসে পড়ানোর নিয়ম অনুযায়ী নোট করে পড়া বাধ্যতামূলক। এটা নোয়ার কাছে খুবই বিরক্তের কাজ। কেননা, এভাবে লাইন বাই লাইন নোট করে পড়তে গেলে মূল গল্প থেকে মনোযোগ সরে যায়। তার মতে, সাহিত্য পড়তে খুবই আনন্দ লাগে, যদি এটার উদ্দেশ্য হয় শুধুই পড়া। সে দুঃখ প্রকাশ করে। তার এই সমস্যার কথা শুনে আমি কিছুই করতে পারব না, তবে আমি শুধু আমার সময়ের শ্রেণিকক্ষের অভিজ্ঞতাগুলো স্মরণ করতে পারি। কত সুন্দরই না ছিল সে অভিজ্ঞতা। প্রতিটা লাইনের আক্ষরিক এবং রূপক অর্থসহ আমাদের শিক্ষকরা পড়াতেন। এভাবে পড়তে পড়তে একেবারে সাহিত্যের সাগরে যেন ডুবে যেতাম। জুনিয়র হাইস্কুলে থাকতে একবার গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পে যেয়ে নোয়া ‘লর্ড অব দ্য ফ্লাইজ’ বইটি পড়ে আমাকে ফেসবুক মেসেজে জানিয়েছে, তার কাছে নাকি একদমই ভালো লাগেনি বইটি। অথচ, আমার শিক্ষক আমাকে উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের লেখা এই বইটি কত সুন্দরভাবে এর আক্ষরিক ও রূপক অর্থসহ বুঝিয়ে পড়িয়েছিলেন। আমি বিস্মিত হই এবং চিন্তিত হই এই ভেবে, লেখককে কি তাহলে বইটি আবার নতুনভাবে লিখতে হবে? অথচ, এটি পড়ার পর আমি লেখক হতে চেয়েছিলাম এবং এমনভাবে বই পড়তাম, যেন সে বইয়ের প্রেক্ষাপট কিভাবে তৈরি করা হয়েছে, তা-ও বুঝার চেষ্টা করতাম।

এখন মনে হচ্ছে, শ্রেণিকক্ষে সাহিত্য পাঠ এক ধরনের হেত্বাভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কাঠামো এবং নিয়মের সমীকরণে পড়ার আনন্দটাই বাধা পড়েছে। কিন্তু সাহিত্যের উদ্দেশ্য তো এমন হওয়া উচিত নয়। শিল্প ও সাহিত্যের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য থাকা উচিত। মাঝে মাঝে লেখকদের লেখার ধরনের কারণেও সাহিত্য বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি কিছু কিছু লেখকদের গল্প বলার ধরন তাদের নিজেদের কাছেও রহস্যময় থেকে যায়। আমার ক্ষেত্রে বলব, আমি এটি সহজ ও সাবলীলভাবেই বর্ণনা করার চেষ্টা করি। ফিলিপ রথ তার উপন্যাস ‘এভরিম্যান’-এ বলেছিলেন, এ ধরনের প্রকাশভঙ্গি তাদের জন্য হতাশাজনক, যারা শুধুই কৌশলের পেছনের কৌশল জানতে চায়। এটা একজন লেখকের জন্য উত্তরস্বরূপ, যারা শুধু লেখার জন্যই লেখেন। এ ধরনের লেখার সারাংশ পরিকল্পনার বিপরীত। এমনকি লেখাটি ভালো হলেও তার মূলভাব অস্পষ্টই রয়ে যায়। এ ধরনের লেখার ছন্দরীতি, ভাষ্য, ক্লাইম্যাক্স ও ব্যাখ্যা ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়াও কঠিন। এ ধরনের লেখা একটি বইয়ের হৃদস্পন্দনকে বাধাগ্রস্ত করে।

কিন্তু আমি বলব, নোয়ার ক্ষেত্রে এমন কোনো সমস্যা ছিল না। সে নিছক অ্যাসাইনমেন্ট করার উদ্দেশেই সাহিত্য পাঠ করত এবং বাকি সময় নিজের পছন্দের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত। প্রথমত, বলতে হয় সে একজন ভালো পাঠক নয়। কারণ, সে বইয়ের সঙ্গে পৃথিবীর সমন্বয় ঘটাতে পারে না। সে তখনই পড়ে যখন তার পড়তে মন চায়। তার অন্যান্য বন্ধুদের মতো তার জীবনও জড়িয়ে আছে ল্যাপটপ আর বৈদ্যুতিক গতিময় ব্যস্ততায়। সে বিতর্কে ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’ অত্যন্ত ভয়ংকর একটি বই। তার চোখ আমাকে এই কথাই জানান দিচ্ছিল। ফিটজগেরাল্ড এবং আধুনিকতার সম্পর্কে আমার অস্পষ্ট ভাব প্রকাশের কারণে সে অনুভব করেছিলÑ উপন্যাস পড়ার অদ্ভুত অনুভূতি এখনকার সময়ে অপরিহার্যভাবে দ্বৈত দৃষ্টি সম্পর্কে ধারণা দেয় যে, কীভাবে এবং ঠিক কতটা সমাজ পরিবর্তিত হয়েছে। সে আমার পর্যবেক্ষণ সত্ত্বেও তার কথাতেই অবিচল থেকে বলেছিল, যাইহোক না কেন এটি হতে পারে ‘গ্রেট গ্যাটসবি’ একসময় খুবই জনপ্রিয় কথাসাহিত্য ছিল কিন্তু এটি উপভোগ করার উপায় যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে।

আমাদের মধ্যে শক্তিশালী বিতর্কের পর এটাই ধাঁধার মতো রয়ে গেল যে, সমসাময়িক সংষ্কৃতি ও সাহিত্যে এ ধরনের দুর্বলতা ও আপেক্ষিকতার প্রশ্নগুলো কী কী প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং তা কীভাবে হতে পারে। আমরা সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা এবং নোয়ার মতো প্রবীণ ও কিশোর বয়স্ক বেশির ভাগ অনিবার্য পাঠকের সাহিত্য পাঠের বিষয়ে কথা বলি। কিন্তু আমরা এই সাধারণ পর্যবেক্ষণের বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে অনিচ্ছুক বলে মনে করি। সাহিত্যে এর একটি প্রভাব রয়েছে, যা অস্বীকার করা যাবে না।

লেখক কার্ট ভনেগাট, যিনি আমাকে লেখক হতে উৎসাহিত করেছেন তার মতে অপরাধী হচ্ছে টেলিভিশন। তিনি আমাকে মনে করিয়ে দেন, ১৯৯৭ সালে আমি যখন ফ্রিল্যান্স লেখক হিসেবে জীবনযাপন শুরু করলাম তখন তা সম্ভব ছিল। কারণ, তখন ম্যাগাজিনের সোনালি যুগ ছিল এবং মনে হচ্ছিল এই পেশায় চিরদিন থাকা যেতে পারে। তারপর টেলিভিশন নিঃসন্দেহে বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্য একটি ভালো মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় এবং এটা ম্যাগাজিনকে ব্যবসায়ের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে। লি সিগেল এবং এন্ড্রু কিনের মতো মিডিয়া প্রতিক্রিয়াশীলদের জন্য সমস্যা হলো প্রযুক্তি, ইন্টারনেটের অবিরাম প্রভাব, ব্লগ ও টুইটারের যুগে কর্তৃপক্ষের ভাঙন এবং বহু নেটওয়ার্কের বিশ্ব। এই যুক্তিতর্কটি অবশ্যই প্রদর্শন করে, যা এখন সাহিত্য ও সংস্কৃতি হিসেবে আমরা জানি এটি জোহান্স গুটেনবার্গের আবিষ্কারের দ্বারা প্রযুক্তিগত বিপ্লবের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। ৪০০ বছরেরও কম সময়ের আগে গুটেনবার্গ ও জন মিল্টনের অর্ধেকেরও বেশি সময়ের পরে যেসব বই ছিল তা পড়ার মাধ্যমে পুরো লিখিত ইতিহাস সম্পর্কে সহজেই বোধগম্য হওয়া যেত।

মিল্টন প্রকৃতপক্ষে নিজের বই নিজেই মুদ্রণ করে ভিন্নতর দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছিলেন। একইভাবে টমাস পাইনের কথাও বলা যেতে পারে। ১৭৭৬ সালের জানুয়ারিতে ‘কমন সেন্স’ নামক একটি বামপন্থি পত্রিকা প্রকাশিত হয়, যেটি আমেরিকান বিপ্লবকে আলোর মুখ দেখিয়েছিল। ঔপনিবেশিক আমেরিকায় মুদ্রণ বিদ্রোহের যথার্থ পরিবেশ ছিল। তখনকার দিনে একটি সক্রিয় পত্রিকা সংস্কৃতি বলয় ছিল, যা আমি এখন মনে করতে পারি। প্রযুক্তিবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে আমাদের আরেকটি অপবাদ আছে। মুদ্রণের প্রধানতার কারণ হচ্ছে তা প্রযুক্তির যুগ ছিল। অনেক পত্রিকাই এসেছে এবং গেছে। অন্যদিকে ‘কমন সেন্স’ পত্রিকাটি ঔপনিবেশিক বেস্টসেলার হিসেবে লাখ লাখ কপি বিক্রয় করেছে। এটি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল, যা আরো হাজারে হাজারে এটির প্রকাশ বাড়িয়ে দিয়েছিল। কাজটি এতটাই প্রভাবশালী ছিল, টমাস জেফারসন এটিকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লেখার মানদ- হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি লেখার সময় পেইনের মানবতার স্বাভাবিক মর্যাদা ও আত্মনির্ধারণের অধিকারসম্পর্কিত বিভিন্ন ধারার বিষয়বস্তু ও ধরন ব্যবহার করেছিলেন।

আমেরিকায় প্রকাশিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা হিসেবে কমন সেন্সের জন্য এতটা উচ্চপর্যায়ে যাওয়া কঠিন কিছু নয়। বর্তমানে সুবিধাজনক দিক থেকে এটি এমন একটি প্রশ্ন উত্থাপন করে, যা খুব সহজেই সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু সমসাময়িক সমাজে কি এমন কোনো বই বা পত্রিকা আছে ,যার মধ্যে এই ধরনের প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা আছে? কোনো সিনেমা বা কোনো ওয়েবসাইট? হ্যাঁ। ডেইলি কস এবং ফাইভথার্টিএইট ডটকম ২০০৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় অনেক ট্র্যাফিক আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু কোথাও কোথাও এই অর্জন পেইনের অর্জনের শতকরা হারের ধারে কাছেও ছিল না। এমনকি মাইকেল মুরের চলচ্চিত্র ফারেনহাইট ৯/১১, ২০০৪ সালের নির্বাচনের আগে থিয়েটার এবং মানুষের জল্পনা-কল্পনার বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে ছয় মাস আগে মুক্তি পায়। এর কারণ হচ্ছে মুর ছিলেন প্রচারক এবং পেইন দার্শনিক। ‘কমন সেন্স’-এর মূল চাবিকাঠি হলো তার যুক্তির ঔজ্জ্বলতা। স্বাধীনতা ইস্যুতে উভয় পক্ষের কথাই বলে ও সব ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করে এটি বিতর্ক ও প্ররোচনার মধ্যে সামঞ্জস্যতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। জনগণের কথোপকথন ও তার গতি এবং বিভাজনও সমান গুরুত্বপূর্ণ, যা দ্রুত সুইফট বোটস এবং অন্যান্য বিষয়গুলোয় মুরকে পেছনে ফেলে দেয়। নভেম্বর পর্যন্ত ‘৯/১১ ফারেনহাইট’ ৯ বছর আগের চেয়ে একটু বেশি কিছু ছিল, কিন্তু ছয় বছর পরে যদি আমরা এটাকে মনে করি তাহলে দেখা যায়, এটি একটি নির্দিষ্ট তারিখে স্মরণ করা শিল্পের মতো একটি প্রকল্প, যার সময় যতদিন পর্যন্ত তা পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল ততদিন পর্যন্ত শেষ হয়নি।

নোয়া এখন এমন একটি অবস্থাতেই আছে। কীভাবে এই বিষয়গুলো সংস্কৃতিতে আমাদের সঙ্গে আটকে গেছে যেখানে তথ্য এবং ধারণা খুব দ্রুত উন্নত হয়, ফলে আমাদের পক্ষে একটি পরিমাপ করার আগেই আরেকটি এসে তার জায়গা দখল করে ফেলে? কীভাবে সাহিত্য পাঠ আমাদের কল্পনাশক্তিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে? অথবা এমন কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার আদৌ প্রয়োজনীয়তা আছে কি? নোয়া হয়তো ভালো পাঠক নয়, তবে সে খুব কমই সুন্দর সুন্দর বাক্য পড়ে অভিভূত হয়। আমাদের মধ্যে এ বিষয়ে কথা হওয়ার কিছু সপ্তাহ পরে সে আমাকে জানিয়েছে, ‘দ্য গ্রেট গেটসবি’ শেষ করেছে এবং শেষের কিছু পর্ব নাকি তার পড়া খুব সুন্দর লেখাগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমি তার কথায় সম্মতি জানিয়ে বলেছিলাম, আমি তোমার পর্যবেক্ষণে সন্তুষ্ট। তাই আমি উপন্যাস নিয়ে আমাদের মধ্যকার পূর্বের আলোচনা সম্পর্কে আর ভাবতে চাই না যার শেষ হয়েছিল নোয়ার খোঁচা মারার সুরে বলাÑ ‘এই কারণে কেউই সাহিত্য পড়ে না’ কথাটির মাধ্যমে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী বললে? সে টীকা সম্পর্কে কথা বলতে লাগলো এবং সেখানে বই পড়া সম্পর্কে আরো কিছু ছিল। সে বলছিল, এই কারণেই সাহিত্য পাঠের যুগ শেষ। আমার কোনো বন্ধুরাই সাহিত্য পড়তে পছন্দ করে না। কেউই আর সাহিত্য পড়তে চায় না।

আমি পাল্টা যুক্তি ছুঁঁড়ে দেব ভেবে সে স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে ছিল। আমি প্রতিক্রিয়া করব ভেবেছিলাম কিন্তু কিছুই বলার ছিল না এবং এখন আমি সাহিত্যের গতিশীলতার কথা বুঝতে পারলাম। আমি নিজের বিক্ষিপ্তচিত্ত অবস্থা দেখতে পেলাম। নোয়ার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, সে আমার মতামতকে আমার জায়গায় রেখেছে যদিও আমি আশা করিনি তা সত্ত্বেও সে ঘর ত্যাগ করে বের হয়ে যায়। এর শেষ অংশের মাধ্যমে আমি এক ধরনের বিরক্তিকর বাস্তবতা দ্বারা তাড়িত হয়েছিলাম। নোয়া বলেছিল, সাহিত্য মৃত এবং এই কারণেই সাহিত্য পাঠের দিন শেষ। এবং প্রকৃতপক্ষে আমি এর উদ্ঘাটন শক্তি দেখতে পেলাম। আমি জোর দিয়ে বলতে পারিনি সে ভুল ছিল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close