এম আর খান

  ২৬ অক্টোবর, ২০১৮

সুকুমার রায়

মন ভালো করার আর রাখার কবি

বাংলা সাহিত্যে সুকুমার রায়ের অবদান অতুলনীয়। তার মাধ্যমে শিশুসাহিত্য যেন পূর্ণতা লাভ করেছে। তিনি একাধারে ছিলেন লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও সম্পাদক। প্রতিটি বিভাগেই নিজস্ব দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের ‘ননসেন্স রাইম’-এর প্রবর্তক। ননসেন্স রাইম বা উদ্ভট হাস্যরস সৃষ্টিকারী রচনায় তার অবদান অসামান্য। এ জন্য সুকুমারকে বিখ্যাত বই ‘এলাইস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’-এর লেখক লুইস ক্যারলের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কারো কারো মতে তিনি এডওয়ার্ড লিয়র এবং চ্যাপলিন দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন।

সুকুমার রায় ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যনুরাগী পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। তার বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী বিখ্যাত বাঙালি শিশুসাহিত্যিক। তিনি একাধারে লেখক চিত্রকর, প্রকাশক, শখের জ্যোতির্বিদ, বেহালাবাদক ও সুরকার ছিলেন। গুপি-গাইন-বাঘা-বাইন এবং টুনটুনির বই ইত্যাদি তার অমর সৃষ্টি। উপমহাদেশের বিখ্যাত শিশুতোষ পত্রিকা ‘সন্দেশ’-এর যাত্রা তিনিই প্রথম শুরু করেন। এ ছাড়াও তিনি ছিলেন বাংলার ছাপাখানা জগতের অগ্রপথিক। বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় বাল্যকাল থেকেই সুকুমার রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য লাভ করেন। এ ছাড়াও রায় পরিবারের সঙ্গে জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখ ব্যক্তিদের সম্পর্ক ছিল।

সুকুমারের পরিবারের অনেকেই পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। তার কাকা কুলদারঞ্জন ছোটদের প্রিয় ‘রবিনহুড’ লিখে জনপ্রিয় হোন। ছোটকাকা প্রমদারঞ্জন কর্মজীবনে সার্ভে অব ইন্ডিয়ার কাজে গিয়ে ব্রহ্মদেশ সীমান্তের দুর্গম অঞ্চলে ভ্রমণের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ধারাবাহিকভাবে লিখে ছোটদের জন্য পরিবেশন করেন ‘বনের খবর’ নামক ঘটনায়। বড়দিদি সুখলতা, মেজদিদি পুণ্যলতা গল্প ও কবিতা লিখতেন। মেজভাই সুবিনয় ছিলেন হেঁয়ালি ও ধাঁধা রচনায় পটু। ছোটভাই সুবিমল ও ছোটবোন শান্তিলতাও কলম ধরেছেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকার জন্য। প্রমদারঞ্জনের মেয়ে লীলা মজুমদারও সন্দেশ পত্রিকায় লিখেই হাত পাকিয়েছেন। সুকুমার রায়ের ছেলে সত্যজিৎ রায় বিখ্যাত লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেন। সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায়ও বর্তমানে একজন সফল চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন।

সুকুমার রায় ছোটবেলা থেকে খুবই বুদ্ধিমান ও প্রতিভাধর ছিলেন। এর ছাপ তার পড়াশোনার ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়। কলকাতার সিটি স্কুল থেকে তিনি এনট্রাস পাস করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় ডবল অনার্স সম্পন্ন করেন। তারপর বাবার ইচ্ছায় মুদ্রণবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯১১ সালের অক্টোবর মাসে মাত্র ২৩ বছর বয়সে গুরুপ্রসন্ন ঘোষ বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে যান। সেখানে তিনি আলোকচিত্র ও মুদ্রণ প্রযুক্তি নিয়ে পড়ালেখা করেন। শেষ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। পরবর্তীতে ভারতের অন্যতম আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসেবে অবদান রাখেন।

ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি রবীন্দ্রনাথের গানের বিষয়ে বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তখনো নোবেল পুরষ্কার পাননি। ধারণা করা হয়, ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে এটিই প্রথম রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দেওয়া বক্তৃতা। তাছাড়াও নিজ উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলির কিছু গান অনুবাদ করেছেন। সেখানে থাকাকালীন উপমহাদেশের দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে ১৯১২ সালে তিনি ইংল্যান্ডের ‘রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটি’র সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯১৩ সালে দেশে ফিরে এসে তার বাবার প্রতিষ্ঠান ‘ইউ রয় অ্যান্ড সন্স’-এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেশে ফিরে আসার পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন জগৎচন্দ্র দাশের মেজো মেয়ে সুগায়িকা সুপ্রভার সঙ্গে। এ বিয়েতে রবীন্দ্রনাথ নিজে উপস্থিত ছিলেন। সুপ্রভা কবিগুরুর কাছে গান শিখতে যেতেন এবং তিনি সুপ্রভাকে অতীব স্নেহ করতেন।

প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন সুকুমার রায়ের ‘ননসেন্স ক্লাব’ নামে একটি সংঘ ছিল। যার মুখপাত্র ছিল ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ নামের একটি পত্রিকা। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর মন্ডা ক্লাব (ইংরেজিতে গড়হফধু ঈষঁন) নামে এ ধরনের আরেকটি সংঘ গড়ে তুলেন। এই ক্লাবের সাপ্তাহিক সমাবেশে এর সদস্যরা ‘জুতো সেলাই থেকে চ-ীপাঠ’ পর্যন্ত সব মজার মজার বিষয়েই আলোচনা করতেন। সুকুমার রায় রম্য ছড়ার আকারে এই সাপ্তাহিক সভায় উপস্থিতির অনুরোধ করে এবং বিভিন্ন ঘোষণা দিয়ে সদস্যদের জন্য আমন্ত্রণপত্র লিখতেন।

১৮৯৫ সালে মাত্র আট বছর বয়সে প্রথমবারের মতো সুকুমারের ‘নদী’ কবিতাটি তৎকালীন ‘মুকুল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এরপর ৯ বছর বয়সে ইংরেজি শিশুপাঠ ‘ঐরপশড়ৎু, উরপশড়ৎু, উড়পশ’-এর অনুবাদ হিসেবে ‘টিক্ টিক্ টং’ লেখেন। পরবর্তীতে ১৯১৫ সালে তার বাবার মৃত্যুর পর তিনি সন্দেশ পত্রিকাটি সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। তারপর থেকে বাংলা শিশুসাহিত্যে তার এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। লেখা ও আঁকার অসামান্য দক্ষতা দিয়ে তিনি পত্রিকাটিকে উপমহাদেশের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ পত্রিকায় পরিণত করেন। তার উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে আবোল তাবোল, পাগলা দাশু, হেসোরাম হুশিয়ারের ডায়েরি, খাই খাই, অবাক জলপান, হ য ব র ল, বহুরূপী, চলচ্চিত্র চঞ্চরী ও ভাষার অত্যাচার ইত্যাদি অন্যতম।

তার লেখায় প্রচুর হাস্যরস বিদ্যমান। রবীন্দ্রনাথকেও তিনি হাস্যরসের দ্বারা বিদ্ধ করেছেন। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সব প্রকার হাসির সংজ্ঞাই যেন তার লেখায় দেখতে পাওয়া যায়। তার সুনিপুণ ছন্দবিচিত্র ও সচল গতির দ্বারা পাঠকের মন জয় করেছেন খুব সহজেই। তার গল্পগুলোর অধিকাংশই খুব মনোমুগ্ধকর। বেশির ভাগ গল্প ও প্রবন্ধে রয়েছে বিজ্ঞানের ছোঁয়া। তার অধিকাংশ ছড়া, কবিতা, গল্প এবং নাটকে আমরা বিদ্যালয়, ছাত্র ও শিক্ষক চরিত্র দেখতে পাই। এসবের মাধ্যমে তখনকার সমাজের শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি ফুটিয়ে তুলেছেন।

তার সৃষ্ট পাগলা দাশু, ভবদুলাল এবং অন্যান্য চরিত্রগুলোও সমাজের বাস্তবতাকেই ফুটিয়ে তোলে। প্রফেসর হেসোরাম চরিত্রের মাধ্যমে তিনি বাঙালির বিজ্ঞানচর্চার সমকালীন অবস্থা ফুটিয়ে তুলেছেন এবং ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ নাটকের মাধ্যমে ব্যঙ্গ করেছেন সমকালীন রাজনৈতিক দলগুলোকে। ছোট, বড় এবং বুড়ো সব বয়সী পাঠকরাই তার লেখা পড়তে পছন্দ করেন। তাই বুদ্ধদেব বসু সুকুমার রায়ের লেখা সম্পর্কে বলেন, ‘সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বড়দের জন্য লিখলেও পড়ে আনন্দ পায় ছোটরা। তেমনি সুকুমার ছোটদের জন্য লিখলেও তার লেখা পড়ে আনন্দ পায় বড়রা।’

জীবনের শেষ ভাগে সুকুমার রায় ভাইরাসজনিত জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তখনকার সময়ে এ রোগের চিকিৎসা ছিল না। এমন একসময়ে তার পুত্র সত্যজিৎ রায়ের জন্ম হয়। ক্রমেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। তবুও মানসিকভাবে ছিলেন অটল ধৈর্যের অধিকারী। শয্যাশায়ী অবস্থাতেই অবিচলভাবে সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদনা এবং সাহিত্য রচনা করে গেছেন। আজও তিনি প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে চির অমর হয়ে বেঁচে আছেন এবং চিরকাল থাকবেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close