ইভান অনিরুদ্ধ
পেনশনের চেক ও ঘুষের গল্প
মা যতটা কড়া মেজাজের বাবা ততটাই নরম-কোমল স্বভাবের। সারাজীবন তিনি মাস্টারি করেছেন। তার মতো সরল আর ভালো মানুষ আমি দ্বিতীয় কাউকে দেখিনি। অবশ্য সন্তানের চোখে সয বাবাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ, ভালো মানুষ! বাবার মতো এ রকম সরল মানুষ একালে একদম অচল। কোনোদিন তিনি পা বাড়াননি কবিতার কঠিন প্রান্তরে। হেঁটেছেন গদ্যের সহজ-সরল আল ধরে। কিন্তু বাবা তবু অচল মুদ্রার মতো টিকে আছেন এই সমাজের দাহকালে। চার বছর ধরে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। তার পেনশনের ফাইলটা আটকে আছে সাড়ে তিন বছর হলো। কবে সারাজীবনের কষ্টের টাকার চেক হাতে আসবে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন।
সাতসকালেই মা রান্না ঘরটা গ্যাসের চুলার আগুনের চেয়েও গরম করে ফেলেছেন। কারণ আর কিছুই না, সংসারের অভাব-অনটনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে তিনি এখন পরাজিত একজন মানুষ। পেনশনের টাকাটা না পেলে আর একটা দিনও ভালো থাকার উপায় নেই। দুদিন আগে পাশের বাসার প্রতিবেশী এক খালা বলে গেছেন মাকে, ‘আপা, ঘুষ দিলেই যখন তখন চেক পাওয়া যায়। ঘুষ এতদিন দেন নাই, তাই আপনাদের ফাইল মর্গে বেওয়ারিশ লাশের মতো পড়ে আছে।’ আর এই নিয়ে সকালেই বাবার সঙ্গে মায়ের খুব লেগে গেছে।
‘তুমি পনেরো দিনের ভেতর ঘুষ দিয়ে পেনশনের টাকা তুলে আমার হাতে দেবে।’
‘তুমি কি পাগল হয়েছ হাসানের মা! আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। সারা জীবন ন্যায়ের পক্ষে থেকেছি। এখন শেষ জীবনে ঘুষ দিয়ে আমার ন্যায্য পাওনা টাকা তুলব?’
‘তুমি যে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা তার প্রমাণ কী? কোনো সার্টিফিকেট আছে?’
‘কী যা তা বলছো। সার্টিফিকেট গলায় ঝুলিয়ে প্রমাণ করতে হবে আমি একজন ফ্রিডম ফাইটার? আমি কি সার্টিফিকেটের আশায় যুদ্ধে গিয়েছিলাম?’
‘হ্যাঁ তাই করতে হবে। আজকাল এই ঘোড়ার ডিম না থাকলে যতই চেঁচাও তুমি মুক্তিযোদ্ধা, তোমার কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না।’
‘হাসানের মা, আমি তোমার কষ্টটা বুঝি। আসলে আমার ভাগ্যটাই খারাপ। পেনশনের সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য এভাবে ফকিরের মতো অপেক্ষা করতে হবে, তা আমি আগে বুঝিনি।’
‘আর তোমার বুঝতে হবে না। হাসান সব বুঝে এসেছে। এখন যা করার সে-ই করবে। আগামী এক মাসের ভেতর তুমি পেনশনের টাকার চেক হাতে পাবে।’
-‘কী বলছ তুমি! আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। আমি ঘুষ দিয়ে পেনশনের টাকা তুলব না। যেদিন হবে সেদিন হবে, এটাই আমার ফাইনাল কথা।’
আমি বিছানা ছেড়ে উঠে ড্রয়িং রুমে সোফার ওপর হেলান দিয়ে বসলাম। আমাকে দেখেই দুজনের উত্তপ্ত সংলাপ বিনিময় হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। মনে হলো যেন টিভি নাটকের মাঝখানে বিজ্ঞাপন বিরতি! আসলে মায়ের কথাই ঠিক। গত সপ্তাহে আমি নীলক্ষেতের বেনবেইজ অফিসে, যেখানে বেসরকারি শিক্ষকদের পেনশনের ফাইল জমা থাকে, সেখানে গিয়েছিলাম। সেই অফিসের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার সঙ্গে আমার বন্ধু মানিকের পরিচয়ের সূত্র ধরে দেখা করে বিস্তারিত কথা বলেছি। আড়াই মাস আগে আমি বিদেশ থেকে ফিরে এসেছি ছয় বছরের প্রবাস জীবন শেষ করে। বিদেশে বসে থেকেও মায়ের আহাজারি শুনতাম টেলিফোনে এই পেনশনের টাকার জন্য। বাবা মাসে দুইবার ঢাকায় আসতেন চেকের খবর নিতে। কিন্তু অফিস থেকে বলা হতো, ‘সিরিয়াল অনুসারেই আপনার ডাক আসবে। আমরা প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকদের চেক দেব। তারপর যারা হজে যাবে তাদেরগুলো দেব। সবশেষে আসবে সাধারণ শিক্ষকদের পালা।’ প্রতিবার বাবা এক বুক হতাশা নিয়ে, অসুস্থ শরীর নিয়ে বিধ্বস্ত হয়ে ঘরে ফেরেন। আহা, কী অভিশপ্ত এই দেশের বেসরকারি শিক্ষকদের জীবন। বিদেশে কত সম্মানজনক আর প্রাচুর্যময় জীবন একজন শিক্ষকের। তা সে যে লেভেলের শিক্ষকই হন না কেন।
কয়েক দিন পর হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে আবার দেখা করি। তিনি প্রথমে আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর হাতের ইশারায় চেয়ারে বসতে বললেন। মাঝবয়সী, তৈলাক্ত টাকের একজন বিকৃত চেহারার পান খাওয়া মানুষ। আমার কাছে মনে হলো, হারাম উপার্জন বা ঘুষ খেয়ে খেয়ে তার চেহারায় ছাপ পড়ে গেছে। অথচ, তার রুমের বাইরে দেয়ালে বড় করে লেখা আছে, ‘পেনশনের টাকার জন্য কারো সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করিবেন না।’ আরেক জায়গায় লেখা, ‘ইহা সব প্রকার দুর্নীতিমুক্ত ভবন।’ আমার লেখাগুলো দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল এই কারণে, এই দেশের জন্য একদিন বাবা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। রাজ্জাক সাহেব লেখা থামিয়ে চেয়ার থেকে উঠে নিজ হাতে ভেতর থেকে দরোজা লাগিয়ে দিলেন। তারপর আমার দিকে শয়তানের মতো একটা দাঁতাল হাসি দিয়ে কথা শুরু করলেন।
‘কী নাম আপনার বাবার? কতদিন হলো ফাইল জমা দিয়েছে?’
আবুল কালাম। প্রায় চার বছর হয়ে যাচ্ছে।
‘ফাইল জমা দেওয়ার সিরিয়াল নম্বরটা এনেছেন?’
জ্বি, এনেছি।
‘আচ্ছা, দিন সেটা আমার কাছে। সরাসরিই বলি, যদি বৈধ পথে সিরিয়াল অনুসারে টাকা পেতে চান, তাহলে আরো বছরখানেক লাগবে। পাল্টা কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না। আর যদি কিছু টাকা পয়সা খরচ করেন, তাহলে আমি ২০ দিনের ভেতর চেক রেডি করে দিয়ে দেব। আপনার বাবা নিজে এসে চেক আগে বুঝে নেবে তারপর আমার পাওনাটা দেবে। এখন কোনো অগ্রিম টাকা দিতে হবে না। কাজের পরে আমি টাকা নিই। রাজি আছেন?’
আমি রাজি। কত টাকা দিতে হবে, এই বারো লাখ টাকার চেকের জন্য?
‘বেশি না, চল্লিশ হাজার টাকা।’
অন্য কোনো ঝামেলা হবে না তো? মানে, ডুপ্লিকেট চেক ইস্যু হবে না তো?
‘হাহাহা, তাইলে কি মিয়া চাকরি থাকব? আমি কোনো নয়-ছয়ের ভেতর নাই। সলিড কাজ করি।’
শুরুতে এই রাজ্জাক সাহেবের প্রতি যে নেগেটিভ ধারণাটা ছিল, তা ধীরে ধীরে ইউটার্ন নিয়ে পজিটিভ হতে লাগল। মনে মনে বললাম, যে কাজ চার বছরে করতে পারল না সনদবিহীন আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবা, সেই কাজ আমি আধঘণ্টায় মাত্র চল্লিশ হাজার টাকার এক অন্যায় শর্তের কাছে আটকা পড়ে করে ফেললাম। আমার তখন মায়ের হেরে যাওয়া মুখটা ভেসে উঠছিল। আর ভেতরে একটা অক্ষম বাসনার জ্বালা আমার গলা চেপে ধরছিল। চলে আসার সময় রাজ্জাক সাহেব তার মোবাইল নম্বর দিয়ে দিলেন।
‘এটা আমার পারসোনাল নম্বর। রাতে কল দেবেন যদি কোনো দরকার মনে করেন। আর কাজ হয়ে গেলে আমিই আপনার নম্বরে কল দিয়ে জানাব। চিন্তা কইরেন না। আল্লাহ ভরসা। যে কাজের যে বাউ।’ এই বলে হাসতে লাগলেন আমার দিকে তাকিয়ে।
উনিশ দিনের মাথায় দুপুর বেলা রাজ্জাক সাহেব আমাকে কল করলেন ।
‘হ্যালো, হাসান ভাই?’
‘জ্বী ভাই, কেমন আছেন?’
‘আছি ভাই, আপনার কাজ হয়ে গেছে। ইচ্ছে করলে আপনার বাবাসহ আজকেও আসতে পারেন কিংবা দুদিন পরও আসতে পারেন।’
বলেন কী ভাই! এত তাড়াতাড়ি কাজ হয়ে গেল! আপনি তো ম্যাজিকম্যান!
‘আরে ভাই, টাকায় কাজ করছে। আমি করি নাই। আমি হইলাম উছিলা মাত্র। আচ্ছা, আপনার বাড়ি জানি কোথায়?’
নেত্রকোনা।
‘শহরে নাকি গ্রামে?’
শহরেই ভাই ।
‘তাইলে আপনি আমার জন্য তিন-চার কেজি বড় সাইজের বালিশ মিষ্টি নিয়ে দুদিন পরেই আসেন। চেক আমার পকেটেই আছে। টেনশনের কোনো কারণ নেই। অনেক দিন নেত্রকোনার বিখ্যাত বালিশ মিষ্টি খাই না।’
রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে কথা শেষ করে আমি বাবার ঘরে গেলাম। তিনি বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে তসবি জপছেন। মা-ও আমার সঙ্গে সঙ্গে এলেন। পুরো ঘটনা আমি বাবাকে খুলে বললাম। সব শুনে তিনি চোখ বন্ধ করেই নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলেন, ‘ঠিক আছে, কবে যেতে হবে আমাকে বলিস। আমি যাব।’
বাবার এরকম নীরব প্রতিক্রিয়ায় আমার ভেতর কেমন জানি একটা অপরাধবোধ কাজ করতে লাগল। মনে হলো, যে মানুষটা বুক চিতিয়ে একাত্তরে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, পাকিস্তানিদের হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন, সেই মানুষটা স্বাধীন দেশে নিজের ন্যায্য পাওনা পেতে মাত্র চল্লিশ হাজার টাকা ঘুষের কাছে কত নির্মমভাবে পরাজিত হয়ে গেলেন, খুন হয়ে গেলেন!
আর আমি তার সন্তান হয়ে স্বার্থপরের মতো
নীরবে, বিনা প্রতিবাদে চল্লিশ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে পেনশনের চেকটা পাওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করলাম!
"