অলোক আচার্য

  ১৯ অক্টোবর, ২০১৮

জীবনানন্দ কি আত্মহত্যা করেছিলেন?

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতাকে বলেছিলেন চিত্ররূপময়। বুদ্ধদেব বসু তাকে বলেছেন নির্জনতম কবি। এ ছাড়াও রূপসী বাংলার কবি, তিমির হননের কবি উপনামগুলো তার নামের সঙ্গে যোগ হয়ে গেছে। বেশ কয়েকটি উপাধিতে তাকে ডাকা হতো। এতসব উপাধি ও ছদ্মনাম যার, তিনি রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে সবচেয়ে আধুনিক কবিতায় অন্যতম। যার কবিতায় শুধুই মুগ্ধতা। নামের সঙ্গে আনন্দ শব্দটি জড়িত থাকলেও বাস্তবিক জীবনে তার জীবন ছিল নিরাশাপূর্ণ। তার কবিতা বর্তমান কবিদের প্রভাবিত করলেও তার জীবদ্দশায় তিনি তা দেখে যেতে পারেননি। বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন মৃত্যুর পর। তার কর্মের সমাদর হয়েছে মৃত্যুর পর। সত্যি বলতে, সময় যত যাচ্ছে তার কবিতার প্রতি এবং কবির প্রতি আধুনিককালের কবিদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা অন্য কোনো কবির ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়নি।

কবির মৃত্যু নিয়ে রয়েছে রহস্য। কবির দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা তা নিয়ে জোর বিতর্ক রয়েছে। পৃথিবীতে যেসব কবি-সাহিত্যিকের মৃত্যু নিয়ে রহস্য রয়েছে তার মধ্যে জীবনানন্দ দাশ অন্যতম। এদিক থেকেও জীবনানন্দের জনপ্রিয়তা ধারণা করা যায়। মৃত্যুর এত বছর পরেও তার মৃত্যু নিয়ে তর্ক হওয়া অর্থ কবির তুমুল জনপ্রিয়তা। হয়তো প্রিয় এ কবির মৃত্যুকে আজও কেউ মেনে নিতে পারেনি। তাই বারবার উঠে এসেছে বিতর্ক। অনেকেই কবির মৃত্যুকে কেবল আত্মহত্যা মানতে রাজি নন। এর পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। কবির রচনা, জীবনাচরণ, ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং পারিপাশির্^ক ঘটনা বিশ্লেষণ করলে কবির মৃত্যু ঘটনাকে নিছক আত্মহত্যা বলতে দ্বিধা হয়।

২২ অক্টোবর শম্ভুনাথ প-িত হাসপাতালে মারা যাওয়ার পর থেকেই মৃত্যু রহস্য তৈরি হয়। বিংশ শতাব্দির শেষভাগে এসে সেই জনপ্রিয়তা আকাশ স্পর্শ করে। তার ট্রাম দুর্ঘটনার মৃত্যু সাধারণ কোনো দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা তা নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আলোচনা হতে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যে জানা যায়, জীবনানন্দ দাশ যখন ট্রাম লাইন পার হচ্ছিলেন, তখন তার হাতে ডাব ধরা ছিল। একজন মানুষ হাতে ডাব নিয়ে ট্রামে আত্মহত্যা করতে পারেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। কিন্তু এরপরের প্রশ্নটা হলো, সেই ট্রাম দুর্ঘটনা যদি হয় ১০০ বছরে একটি দুর্ঘটনা এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি জীবনানন্দ দাশের, তাহলে আবারও মনে সেই প্রশ্নের উদয় হয়Ñএটি দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা? প্রশ্ন ছিল এবং থাকবে। কারণ, বিষয়টি মানা না মানার ব্যাপার পাঠকের ব্যক্তিগত।

রহস্যময় মৃত্যুর তালিকায় দুজন কবির নাম উল্লেখযোগ্য। দুজনই তুমুল জনপ্রিয় এবং দুজনের মৃত্যুই প্রশ্নের। একজন হলেন বিশে^র অন্যতম সেরা রোমান্টিক কবি পার্সি বিশি শেলি এবং অন্যজন কীটস। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে পানিতে ডুকে শেলির মৃত্যু হয়। তার মৃত্যু নিয়ে আলোচনা চলেছে। তার পানিতে ডোবা কোনো ভুল না স্বেচ্ছাকৃত তা নিয়ে রহস্য ছিল। অন্যদিকে কীটসের জীবদ্দশায় তার কবিতাও সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি।

আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত জীবনানন্দের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ‘আমার মনে হয় জীবনানন্দ ঠিক ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যাননি। যদিও এই কথাটাই সর্বত্র বলা হয়ে থাকে এবং আমরা দেখেছি। তথাপি আমার ধারণা, তিনি আত্মহত্যা করেছেন’। প্রায় একই রকম মন্তব্য করেছেন কবি ও জীবনানন্দ গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ। তিনি বলেছেন, ‘কলকাতার ইতিহাসে জীবনানন্দই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তার লেখাগুলো পড়লেই বোঝা যায়, তিনি মৃত্যুচিন্তায় চিন্তিত ছিলেন। এ ক্ষেত্রে এটা আত্মহত্যা হলেও হতে পারে।’ আসলে মৃত্যু এমন একটি বিষয় যা কারো আওতাধীন নয়। তাই জীবনানন্দের মৃত্যু বহুকাল ধরে কেবল রহস্যাবৃতই থেকে গেল। বিষয়টি নিয়ে আরো আলোচনা হবে। কবির সহধর্মিণী লাবণ্য দাশের কথায় আত্মহত্যার বিষয়টি সামনে চলে আসে। তার উক্তি ছিল, ‘মৃত্যুর পরপার সম্পর্কে ওর একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। মাঝে মাঝেই ওই কথা বলতেন। বলতেন, মৃত্যুর পরে অনেক প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা হয়। আর খালি বলতেন, আচ্ছা বল তো আমি মারা গেলে তুমি কী করবে?’ (আমার স্বামী জীবনানন্দ দাশ, লাবণ্য দাশ)

কবির জীবনযাপন এবং কবিতা তার জাগতিক জীবনে হতাশার সাক্ষ্য বহন করে। রবীন্দ্র, নজরুলের পর জীবনানন্দই আধুনিক কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম এ কথা আজ স্বীকৃত। সেই কবিতায় বিপ্লব আনা একজন কবির কবিতা তার জীবিত থাকা অবস্থায় পাঠককুলে তেমন সাড়া পাননি এটাও কবির চরমতম হতাশা। সে সময় তার কবিতা যথার্থ মূল্যায়িত হয়নি। লেখকের মূল সম্পদ তার সৃষ্টি। সব লেখকই চায় তার লেখার মূল্যায়ন হোক। কিন্তু তা যদি না হয় তবে মনে সঞ্চিত ক্ষোভ থাকে বৈ কি। এসব বিষয় কবির মনে গভীর দাগ কেটেছিল।

জীবনানন্দ দাশের কবিতার সমালোচকের অনেকেই তার কবিতার ধারা বিশ্লেষণ করে তার আত্মহত্যা করা বিষয়টি সামনে এনেছেন। কবির অনেক কবিতাই যে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যাওয়ার পর আবার মায়ায় ফিরে আসার। জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘পাই নাই কিছু, ঝরা ফসলের বিদায়ের গান তাই/গেয়ে যাই আমি, মরণেরে ঘিরে এ মোর সপ্তপদী।’ ‘যেই ঘুম ভাঙে নাকো কোনোদিন ঘুমাতে ঘুমাতে/সবচেয়ে সুখ আর সবচেয়ে শান্তি আছে তাতে।’ ‘কোথায় রয়েছে মৃত্যু? কোনদিকে? খুঁজি আমি তারে।’ কবির জীবনের প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণা এবং আত্মহত্যা স্পৃহা, উদাসী ও জাগতিক নিঃসহায়তাকে তার দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বলা যায়।

জীবনানন্দের কবিতায় রয়েছে প্রকৃতি ও প্রেম। এসবের সঙ্গে নিজের একাকিত্বকে মিশিয়ে পাঠকের আবেগকে দীর্ঘায়িত করেছেন। তাই তার কবিতার তৈরি হয়েছে বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা, স্বকীয়তা। সারাজীবন অসংখ্য মানুষের সাহচর্য পেলেও তিনি নিজেকে কিছুটা নিঃসঙ্গই মনে করতেন। জীবনানন্দ কবিতার ভেতর তার দেশপ্রেমের চিন্তা ব্যক্ত করেছেন বহুবার। তার কবিতার খাতা কখনো হয়েছে অভিযুক্ত, সমালোচিত এবং প্রশংসিত। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তার জনপ্রিয়তার পারদ উচ্চে উঠতে থাকে। তবে তার সৃষ্টিকর্মের অধিকাংশই মৃত্যুর পরে পাঠকের সামনে আসে।

রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে বাংলা সাহিত্যে যার কবিতা সবথেকে বেশি সমাদৃত ও অনুসৃতÑতিনি জীবনানন্দ দাশ। তার কবিতায় উঠে এসেছে প্রেম, নারী, রোমান্টিকতা, ভালোবাসা ও দেশাত্ববোধ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তার কবিতায় ঘুরে ফিরে বারবারই মৃত্যুর বিষয়টি উঠে এসেছে। উঠে এসেছে বারবার এই বাংলায় ফিরে আসার আকুতি। কবিতায় ভালবেসেছেন স্বদেশকে। প্রিয় জন্মভূমির টান ছিল তার কলমে। ফিরে আসতে চেয়েছেন তার প্রিয় ধানসিঁড়ি নদীর তীরে। এই বাংলার প্রকৃতিই ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। মায়ায় নিজে জড়িয়েছেন, সেইসঙ্গে তার পাঠককে টেনেছেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো। বলা হয় রবীন্দ্র প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত করেছে তার কবিতা। আধুনিক কবিতার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়েছেন। তার কবিতার ধারায় আজ আধুনিক কবিদের কবিতা রচিত হচ্ছে। কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন উপন্যাস, প্রবন্ধ ও গল্প। তবে ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সমসাময়িক আধুনিক কবিদের মধ্যে ব্যর্থ। তার সৃষ্টির সমাদর তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় দেখে যেতে পারেননি। বিষণ্ন, স্বপ্নময় ও আশ্চর্য শোভাময় কবিতার মধ্যে ক্লান্তি, হতাশা, বিষাদ সোনার টুকরোর মতোন কবিতায় ফুটে উঠেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close