অলোক আচার্য

  ০৫ অক্টোবর, ২০১৮

লেখক

‘ভাই ভালো আছেন? আমাকে চিনতেন পারছেন তো?’

আমি পেছন ঘুরে তাকালাম। মাঝারি গড়নের একটা মানুষ। গায়ের রং এক সময় ফর্সা ছিল। রোদে দীর্ঘদিন দৌড়াদৌড়ি করে সেটা তামাটে হয়ে গেছে। চোখ দুটো উজ্জ্বল। লোকটার বক্তব্য অনুযায়ী তাকে চেনার কথা। কিন্তু চিনতে পারছি না। চেনার চেষ্টা করলাম। আমার মানুষকে মনে রাখার ক্ষমতা যথেষ্ট কম। কয়েক দিন পর দেখলেই তাকে আর মনে করতে পারি না। এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই বিড়ম্বনার শিকার হই। অবাক হয়ে বলে, ‘এই তো সেদিন আপনার সঙ্গে কথা হলো। আমি অমুকের দুলাভাই। এরই মধ্যে ভুলে গেলেন!’ আমি তখনো মাঝেমধ্যে স্মৃতি হাতড়িয়ে বেড়াই। মানসম্মানের ভয়ে বলি, ‘জ্বি, এবার চিনতে পেরেছি। আসলে একটা টেনশনে ছিলাম তাই চিনতে

পারিনি’। এই তো সেদিন আমার স্ত্রী বাইরে থেকে এসে লঙ্কা কা- বাধিয়ে দিল। তার মাসতুতো বোন আর তার বরকে নাকি দেখেও কথা বলিনি। এতে নাকি তারা বিরাট অপমানিত বোধ করেছে। আমি যতই বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, আমি তাদের চিনতে পারিনি, আমার স্ত্রী বিষয়টাকে মানতেই পারল না। ঘটনা হলো দিন পনেরো আগে একটা বিয়ের দাওয়াতে গিয়ে তাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। অল্প সময়ের আলাপ, তাই হয়তো চিনতে পারিনি। আমার না হয় ভুল হয়েছে, তাই বলে ওরাও তো এগিয়ে কথা বলতে পারত। তবে সে কথা আর মুখে বললাম না। আজ আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে স্যান্ডেল সারাচ্ছিলাম। অনেক পুরনো একখানা চটি জুতো। দীর্ঘ ব্যবহারের প্রায় অনুপোযোগী। সাধারণত এসব কেউ ঠিক করতে আসে না। লোকটি স্যান্ডেল হাতে মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। একবার বিড়বিড় করে বলল, ‘এইটা সারাবেন?’ আমি বললাম, হু। ঠিক এই সময় আপাত অচেনা লোকটি পেছন থেকে ডাক দিল। তবে আমাকে কিছু বলতে হলো না। মনে হয় সে বুঝতে পেরেছে- আমি তাকে চিনতে পারিনি। আমার সাড়া না পেয়ে লোকটাই বলতে থাকল, ‘আপনারা ব্যস্ত মানুষ। সবাইকে মনে রাখা সম্ভব না, স্যার এটা জানি। আমি ফরিদ।’

আমি তা-ও চিনতে পারলাম না। অবশ্য সে চেষ্টা করার আগেই ফরিদ বলে উঠল, ‘গত ঈদে স্যার আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আপনার বন্ধুর আড্ডায়। আমি আপনার লেখা পড়ি। খুব ভালো লাগে।’ এবার আমার সবকিছু স্পষ্ট মনে পড়ল। ফরিদ নামের লোকটাকে আমার স্মৃতি হাতড়িয়ে ঠিকই মনে করতে সক্ষম হলাম। তবে আরো আগেই হওয়া উচিত ছিল। এই ফরিদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল আজ থেকে মাস ছয়েক আগে। রোজার ঈদে। আমার বন্ধু আতিকের বাড়িতে। ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছুটি পেলে একসঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠি। আমার টুকটাক লেখালেখির বাতিক আছে। তবে সে রকম কিছু না। স্কুলে শিক্ষকতা করে লেখালেখি করার তেমন সময় পাওয়া যায় না। এর ভেতরেও কিছুটা লেখালেখি করি। তবে তা নিতান্ত শখের বশে। এসব লেখা যে কেউ পড়ে লেখককে মনে রাখে, তাই বিশ^াস হয় না। ফরিদকে প্রথম দেখি আতিকের বাড়িতেই। আমি আড্ডার জন্য চানাচুর আর মুড়ি মাখাচ্ছিলাম। ফরিদ মরিচ কেটে নিয়ে এলো। সালাম দিয়ে মরিচের প্লেট সামনে রাখল।

শিক্ষকতা করায় অনেকেই সালাম দেয়। কিন্তু ফরিদ সালাম দিয়েই থামল না, একটা খাতা এগিয়ে দিল। আমি হতভম্ব হয়ে ফরিদের দিকে তাকিয়ে আছি। তা দেখে আতিক বলল, ‘ওকে একটা অটোগ্রাফ দে’। ও তোর সব লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়ে। আমার খুব পরিচিত। ফরিদও পাশ থেকে বলল, ‘জ্বি স্যার, ঠিক কথা’। আমি সামান্য লিখি বটে তবে অটোগ্রাফ দেওয়ার মতো যে না, তা ভালো করেই জানি। তা-ও ফরিদের আগ্রহ দেখে খাতাটা হাতে নিলাম। প্রথমবারের মতো নিজের অটোগ্রাফ দিলাম। আতিক বলল, ফরিদের পেশা ব্যবসা হলেও নিজেও লেখালেখি করে। আর ওর গল্প জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিতও হয়। এই কথায় দেখলাম ফরিদ খানিকটা লজ্জা পেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোনো কোনো পত্রিকায় আপনার লেখা ছাপা হয়? ফরিদ একদমে কয়েকটির নাম বলে গেল। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে কয়েকটি খবরের কাগজের ভাঁজ করা পৃষ্ঠা আমার দিকে এগিয়ে দিল। বুঝতে পারলাম তার লেখা। মনে হয় আমাকে দেওয়ার জন্যই এনেছিল। আমি হাতে নিয়ে সেগুলো পকেটে ভরে রাখলাম। ফরিদ বললো, ‘স্যার একটু কষ্ট করে গল্পগুলো পড়বেন।’

সেদিন আড্ডা থেকে ফেরার পর ফরিদের লেখাগুলো আর পড়া হয়নি। আসলে বাড়িতে এসে একবার চোখ বুলিয়ে কেবল গল্পের নামগুলো দেখে ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম। তার সপ্তাহখানেক পর ফরিদের সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়েছিল। লেখাগুলো কেমন লেগেছে জানতে চাইলে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হলো। চাইছিলাম না ফরিদ কষ্ট পাক। একজন লেখকের কাছে তার লেখা নিজের সন্তানের মতো। সেই সন্তানের অবহেলা কোনো লেখকই সহ্য করতে পারে না। তাই মিথ্যেটুকু বলা। ফরিদ সেদিনও পকেট থেকে নিজের লেখা বের করে আমার হাতে দিয়েছিল। তবে সেদিন তার লেখাটা পড়েছি। আসলে নিজের কাছে নিজেকে অনেক ছোট লাগছিল। সেই গল্পটা ছিল সাপ নিয়ে। বেশ ভালো গল্প। তারপর অনেক দিন পর হঠাৎ সেদিন রাস্তায় দেখা। আমার মতো স্মৃতিভোলা মানুষের পক্ষে চেনাটা তাই একটু কঠিন কাজ। ফরিদ সেদিনও তার লেখা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। আমার মনে হলো, ফরিদ তার লেখার কপি তার সঙ্গেই রাখে। তারপর অনেক দিন ফরিদের সঙ্গে দেখা নেই। তা-ও প্রায় বছর তিনেক। এর মধ্যে আমি চাকরি-সংসার নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। লেখালেখিটা কোনোমতে ধরে রেখেছি। এটাকে অবশ্য ছাড়াও বলে না আবার ধরাও বলে না। আর ফরিদের কথাও পুরোপুরি ভুলে গেছি। একদিন ছুটির দিনে সকালে বসে পত্রিকা দেখছি। এমন সময় দরজায় কলিং বেলের আওয়াজে উঠতে হলো। দরজা খুলতেই দেখি, একজন অপরিচিত ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে।

‘স্যার, ভালো আছেন?’ আমি আবারও ফেল করলাম। না, লোকটাকে একেবারেই চিনতে পারিনি। এমনকি কোনোদিন দেখেছি বলেও মনে করতে পারছি না। তারপর হঠাৎ কোনো কিছু না বলেই পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। আমি পুরোপুরি হকচকিয়ে গেলাম। আমার অবস্থা দেখে সে নিজেই বলল, ‘স্যার, আমি ফরিদ। ওই যে কয়েকবার দেখা হয়েছিল।’ আমি ফরিদকে চিনতে পারলাম। কিন্তু এই ফরিদের চেহারায় অনেক পার্থক্য। কেমন একটা গম্ভীর ভাব এসেছে। মনে হয়, অনেক দিন না দেখার ফলে এমনটা মনে হচ্ছে। স্যার, আমার পুরস্কার পাওয়ার খবরটা দিতে এলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোন পুরস্কার? ফরিদ কিছু না বলে একটা পত্রিকার পৃষ্ঠা আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি হাতে নিয়ে দেখলাম, একটা সাহিত্য পুরস্কারের খবর। তার মাঝে ফরিদ দাঁড়িয়ে আছে। আমি এ পুরস্কারের খবর আগেও দেখেছি। কিন্তু এটা যে ফরিদ তা চিনতে পারিনি। কারণ, পত্রিকায় তার নামের জায়গায় লেখা ছিল ফরিদুজ্জামান। অবশ্য ভুলটা আমারই। ফরিদের সব গল্পেই নাম থাকে ফরিদুজ্জামান। তার ডাক নাম ফরিদ। খুব ইচ্ছে হলো ফরিদের মানে ফরিদুজ্জামানের একটা অটোগ্রাফ নেই। তবে শেষ পর্যন্ত তা আর নেওয়া হলো না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close