কাউসার মাহমুদ

  ০৫ অক্টোবর, ২০১৮

কবি ও প্রেমধর্ম

পৃথিবীতে কবিরা ভয়ংকরভাবে প্রেম প্রচার করেন। কবিরা তাদের প্রকাশের প্রায় সব ভঙ্গি দিয়েই প্রেমকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কবিতার ছন্দ, বোধ বা ভাব গভীরতার যেকোনো স্তরেই হোক- তারা প্রেমকে সেখানে পাঠিয়েছেন প্রত্যেকের নিজস্ব কুশলতায়। এক অতীন্দ্রিয় শিল্পকৌশলে তারা প্রেমকে বানিয়েছেন জগতের সমস্ত উৎকর্ষের মৌল বিষয়। কেউ কেউ তো শুধু প্রেমকে প্রেমিকার পূজ্যতেই আটকে রাখেননি। বরং সবকিছু ছাপিয়ে তারা প্রেমকে মিলিয়েছেন স্বয়ং ঈশ্বরের দেখানো লোভের সঙ্গে। ইরানের বিখ্যাত কবি হাফিজ এই কথাই বলেন। তিনি প্রেমধর্ম প্রচার করে গেছেন এই বিশ্বাসেই যে, ‘আল্লাহ ভয় দেখিয়ে কাউকে পথে আসতে বলতে পারেন না, আল্লাহ যদি কিছুর লোভ সত্যিই দেখিয়ে থাকেন, তবে সেটা প্রেমের আনন্দের।’ মূলত একজন কবি বোধহয় সম্পূর্ণ দ্বিধাহীনভাবেই প্রেমের এই কল্পলোকে নিজেকে সঁপে দেন। আর এ ডুবিয়ে দেওয়ার ভেতরই খুঁজে পান নিজেকে। নিজের সমস্তকে।

খুব কম নয় বরং পৃথিবীর প্রায় সব কবিরাই প্রেমগ্রস্ত ছিলেন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে। একটা বিশেষ সময় থেকে নিয়ে কেউ কেউ শেষ পর্যন্তও প্রেম উপজীব্য করেই কবিতা লিখে যান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবির কবিতায় পূর্ণতা আসে। ভার আসে, ভিন্নতা আসে। দ্যোতনা আর গভীরতা আসে। সবটাই প্রেম সর্বস্ব এলাহি কারবার। এই যে ভাব আর প্রেম পূজার নির্বিঘœ সময়যাপন। কবির এমন জীবনকে উপলব্ধি করতে আদপে প্রয়োজন মনশ্চক্ষের। স্বাভাবিকভাবে কখনো কবির নির্জীব নিশ্চুপ অঙ্গভঙ্গিতে বিরক্তি এসে যেতে পারে। অসহিষ্ণুতার প্রলেপ এসে যেতে পারে কোনো কবিতে। অথচ, কবির এই নিশীথ যাপনকাল, যূথচারী হয়ে শব্দে শব্দে প্রেম সঙ্গম একটি শ্যামশ্রী অন্তর্লীন কবিতার উপযুক্ত বৈঠক।

কখনো তাদের চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখলে মনে হয়, এমন প্রেমময় আনন্দঘন পরিবেশ পৃথিবীর শরীরটা গর্ভবতী করে দিয়েছেন। চুমুতে চুমুতে ভিজিয়ে দিয়েছেন পৃথিবীর সমস্ত অঙ্গ। তবে একজন কবি তিনি তার মহত্তর সৃষ্টির সঙ্গে এই কথাটাও প্রকাশ করতে চানÑ ‘আমিই পৃথিবীর একমাত্র উদার প্রেমিক কবি। আমার কাছে প্রেমিকারা সম্পূর্ণ স্বাধীন। আমার প্রেমের কোনো বাঁধন নেই। কোনো অর্গল রাখিনি আমার আকাশে। আমার আকাশের সীমানা নেই সামান্যও। দিগন্তপ্রসারী এই আকাশেই গুঞ্জন সুর তুলে বেহালা বাজায় আমার প্রেমিকারা।’

অথচ, এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। যে মিথ্যার অনেকটাই ভ্রম। আমি মনে করি, একজন কবি মানে চরম পর্যায়ের প্রেম অত্যাচারী মানুষ। কবির কাছে তার প্রেমিকা সম্পূর্ণ পরাধীন। আদপে একজন কবি প্রেম পূজারী হন। তিনি সুন্দর সুন্দর স্তবক সাজান প্রেমিকার একেকটা অঙ্গের। সুনিপুণ কৌশলে ছায়া আঁকেন তার হাঁটার। ঠোঁটের। তার কাছে মনে হয়, প্রেমিকার গোলাপি মুখ যেন ডাচ পনিরের হলদে আভা। সন্ধ্যায় নর্থ সি’র জল যেমন নীল হয়, কবির কাছে ঠিক তেমনই মনে হয় তার প্রেমিকার চোখ। চূর্ণ রোদে রুপোলি প্রজাপতির যে রাগিণী! তারই মতো প্রেমিকার ব্লন্ড চুল। আরো কত কী! কত অবয়ব! কবি ভাবতে থাকেন অনিন্দ্য এইসব। তিনি আরো ভাবেন, তার প্রেমিকা তাকে অনুভব করুক সমস্ত দিয়ে। এতেই কবির সুখ। গভীর ভাবনায় তার সত্তা আর প্রেমিকার সত্তা এক হয়ে যাক। অণুতে অণুতে ছড়িয়ে যাক আল্পনা আঁকা এ প্রেম। একজন কবি তার প্রেমিকার চোখের ওপর সমুদ্র লিখে দিতে পারেন কল্পনায়। কবিতার কথায়। আরো নানা পরাবাস্তব ভাবনার বিকাশ সাধন করে তার প্রেমিকাকে একান্তই তার ভেবে। তারপর কবি তার প্রেমিকার ওপর চাপিয়ে দেন প্রেমের অর্গল। সেই খিল কেউ ছুঁঁয়ে দিল যদি এমন সন্দেহ হয়। তখন তার নিজের ভালোবাসার ওপর অহম চলে আসে। ঘেন্নাও আসে বুঝি। চারপাশে বিতৃষ্ণা চলে আসে কবির। দুঃখ হয়, প্রবল মানসিক যন্ত্রণায় নেমে আসে নিগূঢ় অন্ধকার। তাই বুঝি রবীন্দ্রনাথ এমন লিখে গেছেন- ‘বুঝেছি গো বুঝেছি সজনি/কী ভাব তোমার মনে জাগে-/বুক ফাটা প্রাণ ফাটা মোর ভালোবাসা/এত বুঝি ভালো নাহি লাগে/এত ভালোবাসা বুঝি পার না সহিতে/এত বুঝি পার না বহিতে।’

কিন্তু এত কিছু। এত প্রেম উন্মাদনা। তারপরও প্রেমিক কবি এখানে আসামির কাঠগড়ায় সাধারণ দৃষ্টিতে। সমাজের বিচারে। আসলে, এমন পরাধীন করে প্রেম ভাবের বিনিময়! এটা তো একদম অনুচিত আপাত চক্ষে। সন্দিগ্ধ হয়ে কবির প্রেম ঠেকাও নামক নিরোধ আন্দোলনও অমূলক কিছু নয়।

তবে এই যুক্তির পিঠেও যুক্তি আছে। শিল্পের চূড়ান্ত সাধক একজন কবি। তার পক্ষে তার প্রেমই কথা বলবে। কারণ, একজন কবি সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিল্পস্রষ্টা। তিনি পৃথিবী ভরে উদার প্রেম বিলান ঠিক। কিন্তু ভাবাবেগের স্বীকার হওয়ায় তার প্রেমিকা তার কাছে মধুর পরাধীন হয়ে থাকে। এটা কবির দোষ বলব না আমি। তার ভাবনার, তার বোধের প্রায়োগিক একমাত্র ক্ষেত্র হয়ে ওঠে তার প্রেমিকা। এখন এইসব কঠোর সমীক্ষাগুলো প্রেমিকার মেইন্টেইন করা উচিত প্রেম দিয়েই। আর যদি তা নাইবা হয়, তাহলেও প্রেমিকার দোষ নেই। তার স্বাধীন হওয়ার পুরো অধিকার আছে। শুধু অধিকার নেই, একজন উন্নাসিক প্রেম পূজারী প্রেমিককে আগলে রাখার। এ কারণেই কবিরা চিরকালীন প্রেম বিচ্ছেদে ভোগেন বোধহয়। ইতিহাস ঘুরে আসা সময়ও এই কথাই বলে। পৃথিবীর আদিম থেকে আদিম এবং আধুনিক থেকে উত্তরাধুনিক যুগের প্রায় সব কবির জীবন আলেখ্যই এ চিত্রে। তারা প্রবল প্রেম প্রতীক্ষায় নিশ্চুপ বিধ্বস্ততা মেনে নিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কথা কেইবা না জানে। কবির জীবনে প্রথম প্রেম হয়ে এসেছিলেন ?‘আন্না তড়খড়’। আন্নার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ-সম্পর্ক মাত্র এক মাস বা তারচেয়ে সামান্য বেশি সময়ের। কিন্তু এই যে টান, এই যে অতলস্পর্শতা তা ছিল শেষ পর্যন্তই। কবির আরেক প্রেমিকা পরদেশি ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’। আর্জেন্টিনার প্লাতা নদীর তীরে ওকাম্পোকে আপন করে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জড়িয়েছিলন গভীর প্রেমে। কিন্তু তা আর শেষে গড়ায়নি। বিচ্ছেদই চলে আসে দুজনার মাঝে।

ওইদিকে বিচিত্র জীবনের নজরুল। প্রবল শক্তিধর এই মানুষটা জীবনের বড়ো একটা অংশে কোথাও স্থির হতে পারেননি। তবুও প্রেম ছিল তার সর্বাংশেই। প্রমিলা কিংবা নার্গিসকে নিয়ে তার যে আখ্যান। এ কী ভোলার! শেষতক কবি তার অদৃষ্টে প্রেমিকাদের বিচ্ছেদকেই যেন মেন নিলেন।

রুশ বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃত ‘মায়াকোভস্কি’কে বলা হয় রাশিয়ান কবিতার ‘রেগিং বুল’। প্রথম দেখাতেই কবি প্রেমে পড়েন ভেরোনিকা পোলানস্কায়ার। কিন্তু সম্পর্কের টানাপড়েন তাকে ভীষণরকম বিমর্ষ, অধৈর্য আর বিপর্যস্ত করে তোলে। পরবর্তীতে অন্য একজনকে বিয়ে। তারপর বিবাহবিচ্ছেদ এবং শেষপর্যন্ত প্রথম প্রেমিকা পোলানস্কায়ার কাছে ফিরে যাওয়ার অদম্য আগ্রহ থাকলেও তাদের দূরত্ব থেকেই যায়। এই ব্যথা কাটাতে পারেননি মায়াকোভস্কি। বরং রিভলবারের গুলিতে আত্মহত্যা করে মেনে নেন চিরকালীন বিচ্ছেদের।

উর্দু ও পাঞ্জাবি ভাষার কবি ‘সারওয়াত হুসেইন’ প্রেমে ব্যর্থ ও একাকীত্বের কাঠামোকে ভেদ করে ট্রেন লাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। প্রেমিকার বিচ্ছেদ তাকে মুমূর্ষু করে তুলেছিল। বিচ্ছেদের এই ক্লেশ তিনিও কাটাতে পারেননি, পরে আবার ট্রেনলাইনে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুই সুনিশ্চিত করেন এই কবি।

একুশ বছর বয়সে এক বাড়িতে রুটি দিতে গিয়ে প্রেমে পড়েন ইরানি কবি ‘হাফিজ’। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা পরমা সুন্দরীকে এক পলক দেখেই প্রেমে পড়ে যান। সেই এক নিমিখ তার হৃদয় কেড়ে নিয়েছিল, পাগলের মতো মেয়েটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন কবি। অথচ, মেয়েটি তাকে লক্ষ্যই করেনি। এরপর তো কত গল্প! প্রেমে বিভোর হয়ে হাফিজ কবিতার পর কবিতা লিখে যান। এইসব কবিতায় হাফিজ বিখ্যাত হয়ে ওঠেন সিরাজে। অথচ, হাফিজের এদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। সে তার অধরা প্রেমিকাকে পাওয়ার জন্য আধ্যাত্মিক কসরত করে টানা চল্লিশ রজনী বিনিদ্র কাটিয়ে দেন। কিন্তু সেই এক লহমায় হাফিজের সব কেড়ে নেওয়া প্রেমিকাকে হাফিজ পাননি। তিনি বরং বিচ্ছেদই মেনে নিয়েছিল গভীর হৃদপীড়া নিয়ে।

এ ছাড়াও টি এস এলিয়েট, শেলি, সাহির লুথিআনভি, অমৃতা প্রিতম, উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, জীবনানন্দ দাশ কিংবা এই সময়ের বিখ্যাত হেলাল হাফিজসহ পৃথিবী বিখ্যাত প্রায় সব কবির জীবনেই প্রেমিকার বিচ্ছেদ বেদনা এসেছিল। তবে কবিদের জীবনেই যে প্রেম বিচ্ছেদ অলঙ্ঘ ছিল, তা কিন্তু নয়। কেউ কেউ সুন্দর আনন্দঘন জীবন অতিবাহিত করেছেন। তবে প্রেম অনুভূতির এই অভূতপূর্ব সম্মোহন সব কবিকেই বেঁধে রাখে একরকম। আদতে গভীর বিচ্ছেদ অনুযোগ থেকে খুব সামান্য প্রকৃত প্রেমিক কবিরাই বের হতে পেরেছিলেন।

সুতরাং, সর্বোতভাবেই একজন কবির তার প্রেমিকার প্রতি এ প্রেম অত্যাচার। শিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে একরকম কবির পক্ষেই যায় বলব। কারণ, তার এ ভাব। তার এ প্রেমের আবেদন। এর সমস্তই পবিত্র এবং শুদ্ধ। তাছাড়া আরেকটি কথা, কবিতার যে ‘রথ’ আছে এটা কবির নিয়ন্ত্রণেই থাকে না সর্বসময়ে। বলা হয়, কবিতা গড গিফটেড। একজন কবি ঈশ্বরের পক্ষ থেকে কবিতার শক্তি নিয়ে জন্মান। সুতরাং, একজন মানুষমাত্র কবি। স্বাভাবিকভাবে কী করে তিনি কবিতার মতো এমন উন্মাতাল শক্তিকে নিজের আয়ত্তে রাখবেন! তার প্রেম-বোধের কিছু ক্রিয়া যদি তার প্রেমিকার ওপরে পড়ে যায়। এতে কবির কী দোষ থাকতে পারে! কবির প্রেম ধর্মই হলো তার প্রেমিকা একান্তই বেঁচে থাকুক নিঃশ্বাসের শব্দে শব্দে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close