প্রতীক ইজাজ

  ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

মৈনট ঘাটে পদ্মার নাচন!

আশুরার বন্ধ। আমি, বন্ধু সুইটি ও তার পরিবারÑ আমরা দলবেঁধে গিয়েছিলাম পদ্মা। এপাড়ে দোহার, ওপাড়ে ফরিদপুর। মৈনট ঘাট থেকে স্পিডবোটে বা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ফরিদপুরে যান মানুষ।

অনেকটাই কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের আদল। পূর্ব পাশে বিশাল চর। সামনে বিস্তীর্ণ পদ্মা। এখন অবশ্য নদীতে অথই পানি। চর নেই। চারপাশে শুধু জলরাশি। যতদূর চোখ যায়, শুধুই ঢেউ খেলা জল আর জল। সেই জলে ঢেউ ভেঙে ভাসছে পালতোলা নৌকা, স্পিডবোট। পেছনটা অন্যরকম। শুকনো ধানিজমিও এখন ভাসছে পদ্মার জলে। সেই জলরাশি ঘেষে সবুজ গ্রাম। ধনচে ক্ষেত। ভেসে বেড়ানো হাসের ঝাঁক।

ঘাটে ইলিশের গন্ধ। হোটেলের চুলোয় ভাজা হচ্ছে টাটকা ইলিশ। রাজ্যসমান ক্ষুধা নিয়ে হালুম-হুলুম মানুষ মুখে পুড়ছে ভাজা ইলিশ, ইলিশের ডিম। বাতাসে ভাসছে সেই ভাজা ইলিশের ম ম গন্ধ। গরম ভাত। পাতে ইলিশের টুকরো। পোড়া মরিচ। ভাজা ইলিশের তেল। শাক। আরো কতরকম ভর্তা। সঙ্গে পদ্মাপাড়ের মানুষগুলোর প্রাণ উজাড় করা হাসি, অকৃত্রিম ভালবাসা, বাঙালির হাজার বছরের সেই চিরচেনা আতিথেয়তা।

ঘাটের চারপাশে পানি। পদ্মার ঢেউ। পুব পাশটায় মাঝখানে চর। সেখানেই মানুষের ঢল। দলবেধে ছেলে-মেয়েরা এসেছে। উপরে জলধোয়া স্বচ্ছ আকাশ; নীলে ঢাকা। তার রং এসে পড়েছে জলে। আলো-আঁধারি জল। সাঁতার কাটছে মানুষ। লাফাচ্ছে। ফুটবল খেলছে। যেমন ইচ্ছে তেমন। কেউ ভেসে আছে। পাড়ে আসা জল ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কিছুদূর। ফিরতি স্রোতে আবার পাড়ে। আবার হাসি। ঢেউয়ে ঢেউয়ে সে হাসি ছড়িয়ে পড়ছে পদ্মার জলে।

চরে সারি সারি চা স্টল। ভাতের দোকান। নানা পদের ভর্তা। জল ঘেষেই সারি সারি বেঞ্চ। ঘণ্টায় ৩০ টাকা। অনেকক্ষণ ধরে জলে দাঁড়িয়ে যে দম্পতি, ওদের চোখেমুখে পদ্মার চিকচিক জলের হাসি। দূরে ভাসতে থাকা যন্ত্রচালিত বড় নৌকায় তখন একদল ছেলেপুলের হইহুল্লোড়, নাচ, গান। মাইকে বাজছে গান।

ওপাশটায় গ্রাম। মাঝখানে খাল। পদ্মার জলে জেগে ওঠা খাল। ধনচে ক্ষেত। হাসের ঝাঁক। উল্লাসমুখর মানুষ নিয়ে নৌকা ভাসছে জলে। মাঝি গান গাইছে। গ্রামগুলো থেকে উকি মারছে বৌ-ঝিদের চকিত চোখ। বৃক্ষের সবুজ আছড়ে পড়ছে জলে। জলের তোড়। সবুজে জলে এক মুগ্ধকর মায়াবী দৃশ্যপট। জলের তোড় কেটে নৌকা তখন এগিয়ে চলছে সামনে। জলের দেশে।

আমরা ভিজছি। হঠাৎ বৃষ্টিতে ভেজা। একরত্তি ছই। মানছে না বৃষ্টির বেগ। বৃষ্টির জলে তখন গা ছমছম হিমেল বাতাস। এরই মধ্যে সঙ্গে একজন গান ধরলোÑ ‘মাঝি তোর নাম জানি না, আমি ডাক দিমু কারে।’ মনমোহন দত্তের গান। জলে বৈঠা পড়ছে সপাং সপাং। মাঝি বাইছে। নৌকা চলছে। আমরা ভিজছি। কোথায় পাড়। কোথায় গাঁ। কোথায় থামবো আমরা। হঠাৎ মাঝির ডাকে সম্বিৎ ফেরে। বায়ে যাই?

অবশ্য পদ্মার মৈনট ঘাটে যাওয়ার আগে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান আছে। দেখতে হলে নামতে হবে মৈনটের আগেই, নবাবগঞ্জ উপজেলার কলাকোপা গ্রামে। নামলাম। এখানেই দেখা মিললো ঐতিহাসিক গান্ধী মাঠ, প্রাচীন প্রাসাদ, আরএন হাউজ, জগবন্ধু সাহা হাউজ ও খেলারাম দাতার বাড়ির। রয়েছে জজবাড়ি (জমিদার ব্রজেন সাহার ব্রজ নিকেতন) ও উকিলবাড়ি। কলাকোপা বৌদ্ধমন্দির, কোকিলপ্যারি দালান, আন্ধার কোঠা। ব্যবসায়ী রাধানাথ সাহার বাড়ি। শ্রীযুক্ত বাবু লোকনাথ সাহার পুরনো বাড়ি (মঠবাড়ি বা তেলিবাড়ি)। জীর্ণদশা। মধুবাবুর পাইন্না বাড়ি, পোদ্দার বাড়ি এবং কালি বাড়ি। আরো আছে খেলারাম দাতার বিগ্রহমন্দির, মহামায়া দেবীর মন্দির। আর একটু দূরেই হাসনাবাদ গ্রামে জপমালা রানীর গির্জা। তারপাশে লক্ষ্মীপ্রসাদ গ্রামে পোদ্দারবাড়ি।

সবগুলোই পুরনো ভবন। রঙবেরঙের মেঝে। বাহারি নকশা। প্রাচীন গাছপালা। সবুজ সমারহ। পাখির কিচিরমিচির। ইছামতী নদীর কোলঘেঁষা গ্রাম। আঁকাবাঁকা পথ।

দু’শ বছরেরও বেশি বয়স স্থাপনাগুলোর। উনিশ শতকেও এখানে জমিদারদের বসতি ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের তীর্থস্থান ছিল একসময়। নানা ইতিহাস। নিদর্শন। স্থাপত্যকর্ম। স্থাপনার গায়ে গায়ে নকশা। খসে পড়া পলেস্তারার পরতে পরতে, পোড়া ইটের ভাঁজে, অচেনা মানুষের চোখ হাসিমুখ। সংসার। রাজ্য। শাসন। কত গল্প। লোক পুরাণ। ইতিহাসের বুনন। কালের সাক্ষী। সময়ের ছবি। দুর্লভ প্রতœতত্ত্ব।

পাশেই কার্তিকপুর বাজার। সেখানেই দেড়শ দু’শ বছরের পুরনো ঐতিহ্য নিয়ে নিরঞ্জন মিষ্টান্নভা-ার। রণজিতের মিষ্টি। সাদা রসগোল্লা। মুখে পুড়লেই নিমিষেই উবে যায় ছেড়া কাপাস তুলোর মতো। রস স্বাদ লেগে থাকে জিহ্বায়।

তাড়া ছিল ফিরবার। শেষ ট্রিপ ছিল বাসের। অগত্য উঠতে হলো। তখন সন্ধ্যা। অস্ত যাচ্ছে সূর্য। তার আলো এসে পড়েছে পদ্মার জলে। চিকচিক করছে জল। সাদা-কালো। মাঝেমধ্যে রুপালি ইলিশের মতো ঝিলিক। দূরে ভাসতে থাকা নৌকাকে মনে হচ্ছেÑ জলরঙে আঁকা শিল্পীর ক্যানভাস।

বাস ছেড়ে দিলো। সরতে থাকলো পদ্মা, জমিদার বাড়ি, জপমালা গীর্জার ধ্বনি। অপসৃত হলো মানুষ। কেবল চোখে লেগে থাকল সেই মৈনট ঘাট, ফনির ভাতের হোটেল, আর পদ্মার চোখ ধাঁধানো রূপ। স্রোততাড়ানিয়া জল ঝাপটা দিলো চোখে। চোখ পড়ল সেই মৈনটেই। আহা! প্রমত্তা পদ্মার এত রূপ!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close