মোস্তফা কামাল গাজী

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

সৌন্দর্যের অপার বিস্ময়

ফাতেহপুর সিকরি

আগ্রার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে মোঘল সম্রাটদের অনন্য আর চোখ ধাঁধানো নিদর্শন। পড়ালেখার ফাঁকে একটু ফুরসত মিললেই বেরিয়ে পড়ি তাদের হাতে নির্মিত স্থাপত্য দেখতে। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। ক্লাস শেষে বন্ধুরা ছুটে চললাম মোঘল সম্রাট আকবরের প্রথম রাজধানী ফাতেহপুর সিকরির উদ্দেশে। মাদ্রাসা হোস্টেল থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। একটা মাইক্রো ভাড়া করলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল যমুনার পাড় ঘেঁষে। বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাস গাড়ির জানালা গলে কোমল পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার দুই পাশের সুন্দর দৃশ্য দেখে দেখে চলছিলাম আমরা।

হাসি-ঠাট্টা আর গল্পগুজবে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল দুপুরের অলস সময়। ঘণ্টা দুয়েক পর পৌঁছলাম ফাতেহপুর। ড্রাইভার বাবু আমাদের নামিয়ে দিলেন গেট থেকে একটু দূরে। গাড়ি নিয়ে আর যাওয়া যায় না।

সিকরির রাজমহল নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল এক টিলার ওপর। চড়তে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠলাম। টিলার ওপর থেকে দূরের গ্রামগুলো অপরূপ হয়ে দেখা দিলো। অপূর্ব দৃশ্য মন ভরে দেখলাম। সামনে এগোতেই নজরে পড়ল হজরত শাহ সালিম চিশতির মাজারের সুবিশাল ‘বুলন্দ দরওয়াজা’র ওপর। গেট পেরোতে আরো কয়েকটি খাড়া সিঁড়ির আশ্রয় নিতে হয়।

দেশ-বিদেশের পর্যটক ভিড় করেছেন এখানে। ২০০ রুপির বিনিময়ে একজন গাইড সঙ্গে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলাম। গাইড জানালেন, লাল বেলে পাথরে নির্মিত সুবিশাল গেটটি সম্রাট আকবর ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেন। এর দৈর্ঘ ৪৩ ও প্রস্থ ৩৫ মিটার। গেটের ওপরে রয়েছে ছোট ছোট প্রায় ১৩টি গম্বুজ। দেয়ালে খোদাই করে লেখা হয়েছে কোরআনের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আয়াত। বাইরে জুতা রেখে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা মিলল শুভ্রতায় মোড়ানো সালিম চিশতির মাজার। এর বামপাশে রয়েছে সুবিশাল মসজিদ আর ডানপাশে লম্বাটে রাজমহল। মাঝখানের বিস্তৃত মেঝে নির্মিত হয়েছে সাদা মর্মর পাথর দ্বারা। মেঝেতে সূর্যের আলো পড়ে চোখে ধাঁধার সৃষ্টি করছিল বারবার। অপূর্ব স্থাপত্যগুলো পেছনে রেখে ফটো তুলে নিলাম। জোহরের নামাজ পড়া হয়নি তখনো। চত্বরের মাঝখান বরাবর ছোট্ট পানির হাউস। সেখানে ওজু করে প্রবেশ করলাম মসজিদে। নামাজ শেষে ঘুরে দেখলাম মসজিদের সুন্দর স্থাপত্যশৈলী। দেয়ালগুলোতে আঁকা কারুকাজ মসজিদের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। ছাদের মাঝ বরাবর ঝুলে আছে পুরনো আমলের ঝাড়বাতি। এর শিকলটা এখন পিতলের হলেও আগে ছিল সোনার। মসজিদের ভেতরে দুটি কাতার করা যায়। বিশেষ দিনে লোকজন বেশি হলে চত্বরেই নামাজ পড়া হয়।

চত্বরে হাঁটছিলাম আর গাইড থেকে জেনে নিচ্ছিলাম এ স্থাপত্যের ইতিহাস। গাইড জানালেন, সম্রাট আকবর অনেকদিন নিঃসন্তান ছিলেন। পুত্রসন্তানের পিতা হওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল তার। দোয়া নেওয়ার জন্যে আগ্রা থেকে পায়ে হেঁটে আসেন হজরত সালিম চিশতির দরবারে। সালিম চিশতির দোয়ার বরকতে ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে জাহাঙ্গীর জন্মগ্রহণ করেন। সালিম চিশতির ওপর খুশি হয়ে সম্রাট আকবর এ মসজিদ, খানকা ও আশপাশের মহল নির্মাণ করে দেন। ১৫৭১ সালে সালিম চিশতির জীবদ্দশায় মসজিদের কাজ শেষ হয়। মৃত্যুর পর এখানেই তাকে সমাহিত করা হয়।

গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে। তালাবদ্ধ ছোট্ট ঘর দেখিয়ে বললেন, এর ভেতর গুহা আছে, যা দিয়ে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে যাওয়া যায়। কর্নারের ছোট দরজা দিয়ে বের হয়ে অদ্ভুত মিনার দেখিয়ে বললেন, এর নাম হিরণ মিনার। সম্রাট আকবরের সময়ে একটা হাতি ছিল। কেউ অন্যায় করলে অন্যায়কারীকে সে হাতি পায়ের নিচে পিষ্ট করে মেরে ফেলত। তাই সম্রাট আকবর একে খুব পছন্দ করতেন। হাতিটি মারা যাওয়ার পর এ মিনারের নিচে দাফন করা হয়। মিনারের চতুর্দিকে লাগানো আছে সে হাতির দাঁতগুলো।

হিরণ মিনার দেখে হজরত সালিমের মাজারে ঢুকলাম। নারী-পুরুষের ভিড়ের কারণে এগোতেই পারছিলাম না। ভেতরে ঢুকে কিছু ওজিফা পাঠ করে বের হয়ে এলাম। মাজারের পূর্বপাশেও রয়েছে কয়েকটি কবর। কবর জিয়ারত করে গেলাম পূর্বদিকে। পূর্ব-পশ্চিম কোণে ছোট্ট বারান্দা। গাইড জানালেন, এখানে বসে সম্রাট আকবর বিচারকার্য সম্পাদন করতেন। আকবর যেখানে বসতেন, সেখানের দেয়ালে ছোট্ট গর্ত। তা দিয়ে শীতল বাতাস এসে সম্রাটের গায়ে পরশ বুলিয়ে যেত। মাজারের পূর্বদিকে রয়েছে আরেকটি বিশাল গেট। সেখান দিয়ে বের হয়ে গাইড আমাদের নিয়ে চললেন সিকরির সৌন্দর্য দেখাতে।

মাজার থেকে সিকরির দূরত্ব দুই মিনিটের পথ। জনপ্রতি ৪০ রুপি টিকিট। টিকিট নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। সিকরির চারদিকেই রয়েছে পাঁচ মাইলব্যাপী বিশাল দেয়াল। মসজিদের মতো সিকরিরও সবগুলো স্থাপত্য লাল বেলে পাথরে নির্মিত। পশ্চিমদিকে এগোতেই দেখলাম বেশ লম্বা কয়েকটি হল রুম। ভেতরে আবছা অন্ধকারে ভয় লাগছিল। একটু আওয়াজ হলেই ভয়ংকর প্রতিধ্বনি ভেসে আসে। গাইড জানালেন, এটা সম্রাট আকবরের ঘোড়ার আস্তাবল। বাইরে ঘোড়া বেঁধে রাখা হতো আর ভেতরে দেওয়া হতো খাবার। ঘোড়ার জন্যে সম্রাট এত সুন্দর কক্ষ নির্মাণ করেছিলেন দেখে অবাক হয়েছিলাম।

আস্তাবলের উত্তর দিকে রয়েছে সুন্দর কক্ষ। গাইড জানালেন, এটা সম্রাট আকবরের সভাসদ বীরবলের। বীরবল অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন, সম্রাট খুব পছন্দ করতেন। সিকরির কোনো কক্ষেই দরজা নেই। দামি পর্দা ঝুলিয়ে দরজার কাজ চালানো হতো। সেখান থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গেলাম পূর্বদিকের একই ডিজাইনে নির্মিত আরেকটি কক্ষে। গাইড জানালেন, এটা সম্রাট আকবরের স্ত্রী মরিয়ম বেগমের। এর ছাদের ওপর চড়ার জন্য রয়েছে সিঁড়ি। কিন্তু সিঁড়ির দরজা তালাবদ্ধ হওয়ায় চড়া হলো না। ভেতরে মশাল জালানোর জন্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি খোপ। মরিয়ম মহল দেখার পর গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন সম্রাটপতœী জোধা বাইয়ের খাস কামরা দেখাতে। সেখানে ঢুকতে গেলেও আশ্রয় নিতে হয় সুবিশাল ও সুন্দর গেটের। গেট পেরোতেই সম্মুখভাগে যোধা বাই মহল। অন্যান্য মহল থেকে এ মহল বেশ বড়। কারুকার্যে ভরপুর দেয়াল। ভেতরে ঢুকে দেখলাম সুন্দর আর আশ্চর্য নির্মাণশৈলী। জোধা বাই মহলের চারপাশেই চাকরদের ছোট ছোট কক্ষ। সবগুলোই এখন পরিত্যক্ত, ভুতুড়ে হয়ে পড়ে আছে।

জোধা বাই মহল থেকে বের হয়ে আরেকটু সামনে এগিয়ে দাঁড়ালাম হাউসের পাড়ে। এর পাশেই রয়েছে বেলে পাথরের সুন্দর মহল। গাইড বললেন, এটা সম্রাটের বিশ্রামাগার। রাজকার্য শেষে এখানেই বিশ্রাম করতেন। ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম, পাথর দিয়ে নির্মিত সম্রাটের শোয়ার পালঙ্ক। মেঝে থেকে পালঙ্কটি বেশ উঁচুতে। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে চড়ে পালঙ্কে উঠতেন তিনি। যেখানে একসময়ের প্রতাপশালী সম্রাটের গা ছুঁয়েছে, সে জায়গাটাকে আমিও একবার ছুঁয়ে দেখলাম। সেখান থেকে বের হয়ে গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন হাউসের অন্য পাশে দোতলা একটা কক্ষে। গাইড বললেন, এর নিচ তলায় একসময় মাদ্রাসা ছিল আর ওপর তলায় সম্রাটের দাসিরা গোসল সেরে কাপড় বদলাত। মাদ্রাসাটি অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এর পাশেই পাঁচ তলাবিশিষ্ট আরেক মহল। গাইড বললেন, এর নাম পাঞ্চমহল। সম্রাটের পাঁচজন স্ত্রীর জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। একেকজনের জন্যে নির্ধারিত ছিল একেকটা তলা। তারা এগুলোতে উঠে শীতল বাতাস গায়ে মাখতেন আর প্রকৃতির অমল সৌন্দর্য অবলোকন করতেন।

পাঞ্চমহলের সামনের দিকে আরেকটি কক্ষ। এগিয়ে গেলাম। এর সম্পর্কে জানতে চাইলে গাইড বললেন, এর নাম দেওয়ানে আম। এখানে রাষ্ট্রের সাধারণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হতো। দরজাটা বন্ধ হওয়ায় এর ভেতর প্রবেশ করা হলো না। দেওয়ানে আমের ডানদিকে রয়েছে দেওয়ানে খাস। এর ভেতর সম্রাটের ব্যক্তিগত ও অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে পরামর্শ হতো। এ কক্ষের ভেতরের অংশ কারুকাজে ভরপুর। মাঝখানে পিলার আর ওপরে চারপাশের দেয়ালে রয়েছে চারটি মোটা পিলার, যা এসে মিশেছে নিচের পিলারে। এর ওপর সম্রাট আকবর বসে পরামর্শ নিতেন।

দেওয়ানে খাসের সামনে রয়েছে খাজানা মহল। এখানে রাষ্ট্রের খাজানা, সোনা, রূপা, হীরা ইত্যাদি রাখা হতো; যা ব্রিটিশরা দেশত্যাগের সময় সঙ্গে করে নিয়ে যায়। পূর্বদিকে এগোতেই দেখা মিলল সবুজে ছাওয়া সুন্দর উদ্যানের। হাজারো ফুলের সমারোহে উদ্যানটিকে মনে হচ্ছিল এক টুকরো জান্নাত। আমাদের ঘোরাঘুরির সমাপ্তি ঘটল এখানেই। সূর্যটা ক্রমশ হেলে পড়ছে পশ্চিমাকাশে। সন্ধ্যাকালীন আঁধারের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। নীড়ে ফিরতে শুরু করেছে পাখিরা। আমরাও ছুটে চললাম গন্তব্যে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close