মাহবুবুল আলম

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

বই আলোচনা

যে প্রেম মানুষ খোঁজে না

নাহিদা আশরাফী একজন প্রতিভাবান তরুণ কবি। অনিন্দ্য সুন্দর সাহিত্যের কাগজ ‘জলধী’ সম্পাদনা করেন। গত গ্রন্থমেলায় নাহিদা আশরাফীর ‘প্রেম নিয়ে পাখিরা যা ভাবে’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনাম দেখেই এটি সংগ্রহের চেষ্টা করি। আজকাল অস্থির সময়ে মানব-মানবীর প্রেম নিয়ে যে অস্থিরতা চলছে, সেখানে ‘প্রেম নিয়ে পাখিদের ভাবনা’ এবং একজন কবির কাব্যগ্রন্থ সত্যিই আমাকে আগ্রহী করে তোলে। ৭৫টি কবিতা নিয়ে ৬ ফর্মার বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপে কলকাতার কবিবন্ধু মৃণাল বসু চৌধুরীর লেখা মুখবন্ধটির প্রতি দৃষ্টি পড়ে। তিনি একজন কবির কবিতাকে যেভাবে অবলোকন করেছেন, তা সত্যি অনবদ্য ও অপূর্ব। এককথায় মুখবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে কাব্যগ্রন্থটির সংক্ষিপ্তসার বললে ভুল হবে না।

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে কবিতাবিষয়ক কিছু কথা বলা দরকার। কবিতা কী? কে কীভাবে কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কবিতা সাহিত্যের এমন একটি মাধ্যম বা শাখা যা শব্দে, সংগীতে, উপমায়, চিত্রে ও অনুভূতির নিবিড়তায় নিজেকে উন্মোচিত করে। মানুষের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, পাপ-পুণ্য, ধর্ম, অর্থ, কাম, প্রতিবাদ, প্রেম-প্রণয় প্রভৃতি যেকোনো বিষয়ই কবিতার উপাদান বা অনুষঙ্গ হিসেবে গৃহীত হতে পারে, কিন্তু এগুলো কাব্যাত্মার খ-িত অংশমাত্র। কবিতার উদ্দেশ্য জগৎ ও জীবনের রহস্যকে সুন্দর করে ও রসস্নিগ্ধ করে উপস্থাপিত করা হয়। এ জন্য কবির কাছে সৌন্দর্যই পরম সত্যরূপে পরিগণিত এবং যা কল্পনায় তিনি সত্য বলে প্রত্যক্ষ করেন, তা-ই সুন্দর। এই সৌন্দর্য সৃষ্টিই কবিতার উদ্দেশ্য।

মনীষীরা বলেছেন, কবিতা ছাড়া বুদ্ধিভিত্তিক স্ফুরণ ও মননশীলতার চিত্র অন্য কোনো মাধ্যমে মূলত অপূর্ণই থেকে যায়। কবিতার গতি অজেয়। কবিতার নিজস্ব একটি উচ্ছ্বাস রয়েছে, রয়েছে স্রোত, যা দিয়ে কবিতা এগিয়ে যায় নিজস্ব নিয়মে, পুরাতন ও জীর্ণ রীতিনীতি পেছনে ফেলে। কবিতার এ স্রোত এমন অজেয়, যা কখনো স্তব্ধ হবে না। জীবন স্তব্ধ হতে পারে তবে কবিতা কখনোই নয়। চলার পথে কখনো কখনো বাঁক নেয় কবিতা, যা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘আধুনিকতা’। কবিতা স্বাধীন, দুর্বিনীত ও স্বেচ্ছাচারী। কবিতা আভিধানিক শব্দ ও ব্যাকরণিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত।

পৃথিবীর অনেক কবি কবিতার বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। আর তাদের সংজ্ঞায় ও দর্শনে ফুটে উঠেছে কবিতার নান্দনিকতা। শেলির ভাষায়, ‘কবিতা হলো পরিতৃপ্ত এবং শ্রেষ্ঠ মনের পরিতৃপ্তি এবং শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের বিবরণ।’ রবার্ট ফ্রস্ট বলেন, ‘কবিতা হলো পারফরমেনস ইন ওয়ার্ডস।’ কবি কোলরিজের মতামত, ‘গদ্য মানে শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো। আর পদ্য মানে সর্বোৎকৃষ্ট শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো।’ এডগার এলান পোর মতে, ‘সৌন্দর্যে ছন্দোময় সৃষ্টি।’ কীটস বলেন, ‘কবিতা মুগ্ধ করবে তার সূক্ষ্ম অপরিমেয়তায়, একটি মাত্র ঝঙ্কারে নয়। পাঠকের মনে হবে এ যেন তারই সর্বোত্তম চিন্তা যা ক্রমশ ভেসে উঠছে তার স্মৃতিতে।’ কবি এলিয়ট বলতেন, ‘কবিতা রচনা হলো রক্তকে কালিতে রূপান্তর করার যন্ত্রণা।’ কার্লাইল বলেন, ‘কবিতা হলো মিউজিক্যাল থট।’ জগৎ বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল কবিতার সংজ্ঞায় বলেন ‘কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়।’ কবি সেন্ট অগাস্টিন বলেন, ‘যদি জিজ্ঞেস করা না হয়, আমি জানি। কবি মিল বলেন, ‘চিন্তা এবং বাক্য, যার মধ্যে আবেগ পেয়ে যায় নিজের শরীর।’ মেকল বলেন, ‘কবিতা বললে আমরা বুঝি সেই শিল্প যা শব্দকে ব্যবহার করে এমনভাবে যা কল্পনার রাজ্যে জাগিয়ে দেয় এক স্বপ্ন।’ ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেন, ‘কবিতা সমস্ত জ্ঞানের শ্বাস-প্রশ্বাস আর সুক্ষ্ম আত্মা।’ এসব সংজ্ঞা থেকে প্রতীয়মান হয়, কবিতা এক ‘আবেগের ঘোর’। যাকে উপলব্দি করতে হয়, বোঝা যায় কিন্তু বোঝানো যায় না। উপর্যুক্ত বিষয়টি আলোচনার উদ্দেশ্য হলো নাহিদা আশরাফীর কাব্যগ্রন্থে এসব সংজ্ঞার মিল বা অমিল কোথায়?

কবি নাহিদা আশরাফীর ‘প্রেম নিয়ে পাখিরা যা ভাবে’ কবিতার চরণ/পঙ্ক্তি পড়ে কবিতার সহজ, সরল, গতিময়তা আত্মনিষ্ঠ ভাষা স্বাতন্ত্র প্রকাশভঙ্গি, নির্মাণে নান্দনিক ভাষার প্রয়োগ, কবিতার শরীর নির্মাণে মুন্সিয়ানা দেখে অবাক হই; তার কবিতায় ভাষা ও আঙ্গিক যে সহজ সরল নয় আবার দুর্বোধ্যতার দোষেও দুষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে তার কাব্যগ্রন্থের নামকবিতাটির কথাই ধরা যাকÑ ‘প্রেম নিয়ে পাখিদের অনুভব/মানুষ তা কখনই বুঝবে না/এ প্রেমের শিহরিত আবেদন/মানুষের মনভূমি খোঁজে না।.../ভালোবাসা নয় কোনো পুথিঁপাঠ/নয় কোনো শব্দের অভিধান/হয়নি তো জানা আজও প্রেম কী/প্রেম জানে শুধু ওই পাখিপ্রাণ।’ (প্রেম নিয়ে পাখিরা যা ভাবে)

নাহিদা আশরাফীর কবিতা পড়ে মনে হয়, তার কবিতায় আছে মুগ্ধতামাখা স্বপ্নের নির্মাণ, ছন্দের প্রতিও দেখিয়েছেন একনিষ্ঠ আনুগত্য। এতে বোঝা যায়, নাহিদা দীর্ঘদিন ধরে কবিতার শরীর নির্মাণের পাঠ নিয়েছেন।

এমনই একটি কবিতার কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করছিÑ ‘তুমি আমার চেনা পথে অচিন গাঁয়ের বাঁক/তুমিই আমার রংবাহারি পয়লা বৈশাখ/তুমি আমার চৈতী হাওয়া দুরন্ত মাস্তুল/তুমিই আমার পলাশ এবং কৃষ্ণচূড়া ফুল।’ (তুমি আমার বৈশাখ)

তার কবিতার ভাবানুবাদ বীক্ষণ করলে একটি অসীম নিরাবয়ব ও বিমূর্ত ব্যঞ্জনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যা পাঠককে আত্মস্থ করতে হলে এর ভেতরে ঢুকে সুরঙ্গপথের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যেতে হবে। আবার তার কোনো কোনো কবিতা সরল শব্দ চয়ন ও বয়নে রেললাইনের মতো সমান্তরালভাবে এগিয়ে যায়। যেমনÑ ‘অনেক দিন কাঁদা হয় না/চোখের জলও পৃথক পালঙ্কের বাসিন্দা হয়েছে/তোমার মতো সেই কবে, টের পাইনি/একটা ঘোর বর্ষা চাই/আমার জন্য নয়...।’ (গহীন জলের কান্না)

দেশ-মাটি-মানুষের প্রতি তার গভীর মমত্মবোধ এবং মানুষের দৈহিক বা জৈবিক ভালোবাসা দীপ্তিময় হয়ে ওঠে, যা চোখে পড়ার মতো। তিনি বিশ্বাস করেন, সমাজের নানাবিদ অসঙ্গতি, স্বার্থপরতা, শোষণ-বঞ্চনা, যাবতীয় জটিলতা ও কুটিলতার সীমানা পেরিয়ে সত্য-সুন্দরের জয়রথ একদিন এগিয়ে যাবে তার নিজস্ব গতিতে এবং তিনিও টেনে নিয়ে যাবেন সেই জয়রথের রশি। ‘আর কত জল চাই মা? আর কত লাল চাই/আর কতখানি রক্তাক্ত উর্বরতায়,/তুমি জ্বলে উঠবে আগ্নেয়গিরির মতো/আর কত রক্তমশালে আলোকিত হবে তোমার গর্ভগৃহ?’ (আর একবার একাত্তর ডেকে আনি)

তার কবিতার বিষয় আঙ্গিকে, রূপক, উৎপ্রেক্ষা, অনুপ্রাসে এবং ছান্দিক শব্দশৈলী আমাদের প্রাণে দোলা দিয়ে যায়। এমনই কয়েকটি কবিতার কয়েকটি চরণÑ ‘বৃৃষ্টি যখন তোমায় ভেজায়/তোমার চিবুক গাল ছুঁয়ে যায়/আলতো করে?/শিশির যখন হিম শীতলে/তোমার চোখের পাপড়ি মেলে/লাজুক ভোরে...।’ (অভিযোগ)

নাহিদা আশরাফী তার কাব্যগ্রন্থের কবিতায় বিভিন্ন মাত্রা ও ছন্দে, নতুন প্রকাশভঙ্গিতে, কবিতার অনুপম, নানন্দিক ও অনিবার্য ভাষায় তিনি পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। তিনি কাব্যিক ব্যঞ্জনার নিরন্তন সত্যকে তুলে ধরার একটা অদম্য প্রয়াস উজ্জীবিত করে রেখেছেন সবসময়। তার কবিতা পড়লে মনে হয়, তিনি বুঝি কবিতার মাধ্যমে মানুষের জীবন, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ভালোবাসা ও বিরহের কথা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন- ‘নদী কি আর বর্ষাহীনে ভরসা হারায়/যখন নদী ধারণ করে প্রণয়জল/বিবর্ণতায় অপূর্ণ নয় মনোভূমি/হৃদয় যখন স্বচ্ছনীলে টলমল।’ (তুমিই তোমার মুক্তিদাতা)

কাজ করতে গেলে কিছু ভুলত্রুটি হবেই, অনেক বিখ্যাত লেখকের মধ্যেও বানান বিভ্রম লক্ষ্য করা যায়, তা হবেই; লেখক তো আর প্রুফ রিডার নন! মানুষের ভুল হবেই আর সেই ভুলত্রুটি শোধরানোর মাধ্যমে মানুষ এগিয়ে যায়। কবি নাহিদা আশরাফিও এগিয়ে যাবেন সোনালি স্বপ্ন বিনির্মাণে। তিনি আগামী দিনেও আমাদের আরো ভালো ভালো লেখা উপহার দেবেন এবং মহাকালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বেঁচে থাকবেন আরো অনেক দিন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close