মুহাম্মদ কামাল হোসেন

  ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

প্রেমের আলামত পাওয়া গেছে

মেয়েটি লাবণ্য। ভাবনার অতল সাগরে সামান্য একজন ডুবসাঁতারু মাত্র। এই মুহূর্তে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। গভীর চিন্তায় মগ্ন। দৃষ্টি নিবদ্ধ একটু দূরের ওই ইউক্যালিপটাস গাছটার দিকে। যেটার ওপর দিয়ে ক্ষণকাল আগেও কাল বৈশাখীর ভয়ংকর তা-বতা বয়ে গেছে। অথচ এখন কত শান্ত ও স্থির। বিধ্বস্ততার চিহ্ন ফুটে ওঠা গাছটার সঙ্গে লাবণ্য নিজের শরীরের কোথাও যেন একটা সাদৃশ্য খুঁঁজে পায়। চিকন সরু সরু পাতার আড়ালে খেলা করছে বৈকালিক মিষ্টি রোদ। যদিও সকাল থেকে চলেছে মুহুর্মুহু বজ্রপাত, সঙ্গে ভারি শিলা বৃষ্টির দ্রুপদী নগ্ন নৃত্য। প্রচ- বৃষ্টির তোড়ে ভর আষাঢ়েও ঝেঁকে বসেছে মাঘের হাঁড়কাপানো শীত। গাছের ডালে এক জোড়া শালিক পাশাপাশি উষ্ণতা ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। আজব দুনিয়ার বিচিত্র খেলা! যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব, সেখানেই উষ্ণতা, ছোঁয়াছুই প্রেম। একটুখানি ভালোবাসার জন্য দুনিয়াজুড়ে কতো হাহাকার, অনুনয় বিনয় ও কাতরানি।

আষাঢ়ের বৈরী আবহাওয়াগত শীতের প্রকোপ ও জলাবদ্ধতার কারণে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। ঋতুবদলের দরুন হঠাৎ করে আজকাল খদ্দেরের সংখ্যাও কমে গেছে। শহরের অলিগলিতে লোকজন কালেভদ্রেও বের হচ্ছে না। সর্বত্র পানি আর পানি। লাবণ্যের হাতে এখন অফুরন্ত সময়। অখ- অবসর। কামনা তাড়না ভুলে ঘরমুখো মানুষগুলো এখন প্রকৃতির বৈরী উন্মাদনায় ভীত সন্ত্রস্ত। ঝড়বৃষ্টি ও পানিবন্দি জীবনে কেউ কেউ তটস্থ। আজকাল প্রকৃতির গতিবিধি বোঝাও মুুশকিল। ছকবাঁধা নিয়মে চলতে চায় না। বাঁধনহারা উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে চায়। এই অসময়ে ও বৈকালিক আবহে ফুটফুটে শালিক জোড়াকে দেখে লাবণ্যের শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ ছুঁয়ে যায়। আজকাল কী যে হয়েছে তার? মনের কাছেও কোনো জুতসই ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না। যখন-তখন হুটহাট বেখেয়ালি মনে ভাবনার অস্থির পাখিরা ভিড় করে। একটি পরিচিত মুখের প্রতিচ্ছবি বারংবার মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে। মীরু ছেলেটাকে মনে পড়ে। ভালোলাগার আবেশে আচ্ছন্ন হয় মন। মর্ত্যরে পৃথিবীতে বিমূর্ত রঙিন মুহূর্তগুলো তার সঙ্গে শেয়ার করতে মন চায়। উচ্ছলা ফড়িংয়ের মতো দুরন্তপনা ও বাঁধাহীন আনন্দে মেতে ওঠতে মন চায়। ছেলেটার মাঝে নিশ্চয় এমন কিছু একটা রয়েছে। ওর ব্যক্তিত্বে ঠাসা একচিলতে হাসিমাখা মুখটা ভেসে ওঠতেই লাবণ্য ঈষৎ কেঁপে ওঠে। মোচড় দিয়ে ওঠে হৃদয়ের গহীন বনে। শ্বাস-প্রশ্বাসের অস্থির অণুগুলোও দ্রুত সংকোচন ও প্রসারণের নামে ইঁদুর-বিড়াল দৌড় খেলে। অথচ কত রং-বেরঙের পুরুষ লাবণ্যের জীবনে এসেছে। সদা কত চরিত্রের চিত্রায়ন চিত্রিত হচ্ছে। দেহের বেসাতি করতে গিয়ে কত পুরুষের মিথ্যে প্রতিশ্রুতিও পেয়েছে। চোখের সামনে গালভরা বুলি ও রাশিরাশি স্বপ্নের মিথ্যে ফানুস উড়িয়েছে। অঞ্জলি উঁচিয়ে রাজ্যের লোভ ও প্রলোভন দেখিয়েছে। ঘরের বউ বানাবে, রানি বানাবে। প্রগাঢ় ভালোবাসায় প্রেমাতুর হৃদয়ে এলোকেশী খোপায় লাল রক্তজবা ফুল গুজে দেবে, নরম ও পেলব দু’পায়ে রঙিন আলতার প্রলেপ লাগিয়ে দেবে- আরো কত কী! কিন্তু ‘খেলারাম খেলে যা’র মতো দেহের পিয়াস মিটে গেলে মুহূর্তে পাষ-গুলো ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। যে চোখে কিছুক্ষণ আগেও ক্ষরিত প্রেমের ফোটা টপাটপ আদ্রতায় নুয়ে পড়েছে, সেখানে তখন আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভা নির্গত হতে দেখা যায়। ঘৃণার চিহ্ন ফুটে ওঠে চোখে-মুুখে। সাদা কাগজের দাম থাকে বৈকি কিন্তু লাবণ্যের তখন দু’পয়সারও দাম থাকে না। মীরু ছেলেটা অবশ্য খদ্দের নয়। ভদ্রগোচের একজন সুঠাম শান্ত ছেলে। পরিচয় হয়েছে ফুড়–ৎ করে কিছুটা কাকতালীয়ভাবে। যথেষ্ট হ্যান্ডসাম ও লাজুক। চোখগুলো অসম্ভব সুন্দর। শহরের এক বিপণিবিতানে অনেকটা নাটকীয়ভাবে পরিচয় হয়।

পেটে ভাত থাকুক আর না থাকুক লাবণ্যকে প্রায় নিয়মিতই শপিং করতে হয়। পুরুষ খদ্দেরদের আকৃষ্ট করতে কত নিত্যনতুন ডিজাইনের বিকিনির পসরা সাজাতে হয়। দেহের সৌন্দর্যের সঙ্গে আজকের যুগে বাড়তি আর্টিফিশিয়াল সৌন্দর্যটুকুও লাগে। তারওপর লেটেস্ট কালেকশন না হলে খদ্দেরের মুখ রুচে না। উগ্র সাজের সঙ্গে পরিপাটি মেকাপ ও দামি কড়া সুগন্ধিও চাই। এই যুগের পুরুষ হচ্ছে এক একটা আস্ত নচ্ছার। বদের হাড্ডি। এটা নয়, ওটাতে তোমাকে মানাবে। এটা পরে আসো কিংবা ওটা পরে আসো। ব্রার কালারটা এই রঙের কেন, ওই রঙেরটা নাও। প্যান্টি সাদা পছন্দ নয়, কালোটা পরে এসো। ঘরের বউকেও কেউ এতটা হুকুমজারি করার সাহস পায় না। পিটিয়ে এক্কেবারে ছাল তুলে ফেলবে। যত্তসব আদিখ্যেতা ও অদ্ভুত বিকৃত ফ্যান্টাসি দেখায় এখানে এসে। একবার ষাটোর্ধŸ এক বৃদ্ধ আসে লাবণ্যের কাছে। লুঙ্গির কাছা খুলে কড়কড়ে টাকার বান্ডিল ছুঁড়ে দেয় তার দিকে।

‘অ্যাই ছেমড়ি কাছে আয়, আরো টাকা পাবি’

কাছে এগিয়ে আসতেই ভক করে উৎকট দুর্গন্ধ বেরিয়ে আসে লোকটার মুখ থেকে। দাঁতগুলো পাকা খেজুরের মতো লাল। এই জীবনেও বোধ হয় ছাই-পেস্ট পড়েনি দাঁতে। লাবণ্য বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এগোয় না। ঝাঁজালো দুর্গন্ধে টেকা দুুুস্তর। পেট গুলিয়ে বমি আসে। নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসার জোগার।

‘কিরে ঢেমনি! দেমাগ দেহাস ক্যান? কাছে আয় বলছি! আরো ম্যালা টাকা পাবি কইলাম!’

লাবণ্য ভ্যাবাচ্যাকা খায়, অস্ফুটস্বরে বিড়বিড় করে,

‘তুই ঢেমনা বানচুত, তোর চৌদ্দগুষ্ঠী ঢেমনা’

তবুও ওড়নায় নাক চেপে কোনোমতে এগিয়ে যায়। গায়ে একটা হালকা নীল রঙের হাঁটু অবধি ঝোলা নাইটি খুুুব পাতলা। ভেতরে একই রঙের ম্যাচিং করা সরু স্ট্রিপের ব্রা আর প্যান্টি। বৃদ্ধ লোমশ হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে। এক ঠ্যাং কবরে গেলে কী হবে শরীরে অসুরের মতো শক্তি। ময়দার মতো খাবলে খাবলে দলা পাকাতে থাকে লাবণ্যের একরত্তি ছোট্ট দেহটার। ঘৃণায় ও যন্ত্রণায় মুখ বেঁকে আসে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার আসি আসি করেও আসে না। কোথাও যেন দলা পাকিয়ে আটকে যায়। একেকবার ইচ্ছে হয় বুড়ো বজ্জাতটার মুখে থুথুর দলা ছিটাতে। হারামজাদাটা মেরেই ফেলবে বোধহয়। নারীদেহটা নিয়ে সবাই মজে থাকতে চায়, কেউ কখনো মনের দুঃখটুকু বুঝতে চায় না। পেটের খাদ্য থলিতে সারাদিনে দানাপানি কিছু পড়েছে কি না, সেই খবরটুকুও কেউ নিতে চায় না। অগত্যা রসকষহীন প্রাণহীন দেহটা একপ্রকার বাধ্য হয়ে সঁপে দিতে হয় সমাজের মুখোশধারী এইসব হিংস্র নরপশুদের কাছে। লাবণ্য ভাবনার আরো গভীর অতলে হারিয়ে যায়। ঘরে অসুস্থ বৃদ্ধা মা ও দু’দুটো ছোট ভাইবোন। ওদের ভরণপোষণ, পড়ালেখা ও চিকিৎসা। কত কী খরচ! অথচ যত মরণদশা হয়েছে তার। পিতৃহারা লাবণ্য তবুও সমাজে মাথা উঁচু করেই অন্য দশটা মেয়ের মতোই মানসম্মানে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু পরিবর্তিত সমাজ ও সমাজের কিছু বিষাক্ত কীট লাবণ্যকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার ছলে জোর করে এই জঘন্য পথে নামিয়েছে। ক্ষোভ আর ঘৃণার বিষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে তার নারীত্বের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নীরবে-নিবৃত্তে ফালি ফালি হয়েছে তার আহত মন। ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত হয়েছে রক্তে মাংসের দেহ। দেহের ওপর পাশবিকতার আঁচড়গুলো নিদেনপক্ষে কোনো ক্ষুধার্ত নেকড়েকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। লাবণ্য আজকাল এসব ভাবতে চায় না। ভেবে লাভও নেই। এটুকু বুুঝে গেছে, নারী মাত্রই ভোগ্যবস্তু। ভোগের রসনাবিলাসে নারীকে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। কথায় কথায় নারী অধিকার ও নারী সুরক্ষা নিছক গালভরা মিথ্যে বুলি বা প্রতিশ্রুতি মাত্র। লাবণ্য বরং মীরুকে নিয়েই ভাবতে চায়। ছেলেটাকে সমাজে স্রোতের বিপরীতে ভেসে চলা একখ- ভেলা মনে হয়েছে। যাকে আঁকড়ে ধরা যায়। বিশ্বাস ও অবলম্বন করা যায়। সংগত কারণে তাকে ভাবতে ভালো লাগে। এক অজানা অচেনা ভালোলাগা ঢেউ খেলে যায় মনে। সেদিন শপিং মলে লাবণ্যকে দেখে মীরুই প্রথম পেছন থেকে ডেকে ওঠে।

‘অ্যাই প্রথমা! দাঁড়াও, দাঁড়াও বলছি!’

শপিং মলে বহু মানুষ। প্রথমাকে ডেকেছে বলে লাবণ্য পেছনে ফিরে তাকাবে কেন। লাবণ্য দোকানির সঙ্গে জিনিসপত্রের দরদস্তুর নিয়েই ব্যস্ত। হঠাৎ পেছন থেকে কোনো একজনের মায়াবী স্পর্শ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লাবণ্যের চোখ দুটি দু’হাতে পেছন থেকে মৃদু চেপে ধরে।

‘বল তো সোনা, কে আমি?’

‘একি! কে আপনি, কে?’

গলার স্বর শুনে মীরু এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নেয়। মনে মনে ভাবে, প্রথমার গলার স্বর তো এমনটি নয়। তবে কি অবিকল প্রথমার মতো দেখতে অন্য কেউ? কিন্তু কে সে? বুঝতে পারে কেলেঙ্কারি কিছু একটা হয়ে গেছে। মীরু লজ্জায় দাঁতে দাঁত কাটে। লাবণ্য ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে ফিরে তাকায়। শীতল গলায় প্রশ্ন করে।

‘কে আপনি বলুন তো? পেছন থেকে আমাকে এভাবে চেপে ধরলেন কেন?’

‘সরি, ইয়ে মানে...আমার ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিন?’

লাবণ্য বুঝতে পারে পুরো বিষয়টাই কাকতালীয়। তবুও মাথায় হঠাৎ অদ্ভুত এক দুষ্টুমি ভর করে বসে। এমনিতেই জীবনের উচ্ছ্বাস, সুখ-শান্তি ও অনাবিল হাসি-আনন্দ প্রায় একপ্রকার মরেই গেছে। মরিচিকার মতো যেটুকু মাঝেমধ্যে উঁকিঝুকি মারে সেটুকুও মিথ্যে। তবুও খেয়ালিমন চট করে সিদ্ধান্ত নেয় লোকটাকে একটু বাজিয়ে নিলে কী আর এমন ক্ষতি? দেখাই যাক না। পানি কতদূর গড়ায়।

‘এই যে মশাই, এখনতো শুধু শুধু সরি বললে হবে না!’

‘জ্বি, মানে...?

‘একটা অপরিচিত মেয়ে মানুষের শরীরে বলা নেই কওয়া নেই, সরাসরি হাত চালিয়ে দিলেন?’

‘ক্ষমা চাই। আসলে আমি বুঝতে পারিনি। আপনি অবিকল প্রথমার মতো!’

‘সেকি, প্রথমা আবার কে?’

মীরু লজ্জায় ভেঙে পড়ার জোগাড়। কোনো রকমে বলে,

‘প্রথমা আমার বন্ধু’

‘গার্ল ফ্রেন্ড?’

‘হু’

‘আই সি! ওকে, আপনাকে ছেড়ে দিতেই পারি। কিন্তু ছোট্ট একটি শর্তে!’

‘শর্ত! আচ্ছা কী শর্ত, বলুুন?’

‘আপনার সততার পরীক্ষা নেব। কাল যথারীতি আপনাকে এখানে আবার আসতে হবে। ক্ষমার বিষয়টি তখন না হয় ভাবা যাবে। নচেৎ বুঝব আপনি ইচ্ছে করে ঘটনাটা...’

‘ওকে, ডান। কথা দিলাম। আমি আসব।’

মীরু চলে যাবার পর লাবণ্য হেসে কুটি কুটি। সেদিন সারাটা দিন লাবণ্য কারণে-অকারণে হেসেছে। আজও সে দিনের কথা মনে হলে হাসি পায়। এমন পাগল ছেলেও আজকের যুগে আছে? লাবণ্য জীবনে এমন প্রাণবন্ত ও জীবন্ত ছোঁয়া কোনো মানুষের পক্ষে কখনো পায়নি। হৃদয়কে পাগল করা এফোঁড়-ওফোঁড় করা মাতাল স্পর্শ।

মীরু কথা রেখেছিল। পরদিন যথাসময়ে ছেলেটি হাজির হয়। লাবণ্য এসে মীরুকে একটি বেঞ্চে বসে থাকতে দেখতে পায়। মেরুন রঙের টি-শার্টের সঙ্গে হালকা নীল জিন্স। দারুণ মানিয়েছে। হাসি বিনিময় করে দুজন। তারপর পাশেই একটা কফিশপে ঢুকে পড়ে। পাশাপাশি বসে। ঘণ্টাব্যাপী কথা হয়। আলাপচারিতায় লাবণ্য জেনে নেয় মীরু একটা পত্রিকা অফিসে চাকরি করে। ভালো মাইনে। টুকটাক কবিতাও লেখে। গল্পের ছলে জেনে নেয় তার সঙ্গে প্রথমার সম্পর্কের বিষয়টি। প্রথমা মেয়েটি নিঃসন্দেহে ভাগ্যবতী। মীরুর মতো লক্ষিমন্ত ছেলে পেয়েছে। লাবণ্য পুরুষবিদ্বেষী হলেও হীরে চিনতে ভুল করেনি। মীরুরা আছে বলেই পচাগলা মৃতবৎ সমাজটা এখনো প্রায় বেঁচেবর্তে রয়েছে। মীরুরাই পারবে এই সমাজকে বদলে দিতে। লাবণ্য পরিষ্কার এ-ও বুঝতে পারে, মীরু আর প্রথমার মাঝখানে সে ছোট্ট একটা সেমিকোলন মাত্র। ব্যবহার না হলেও খুব একটা ক্ষতি নেই। স্রেফ ক্ষণিকের অনাহুত অতিথি। থাকা না থাকার সমান। আড্ডার ছলে নিজের অন্ধকার জীবনটা কৌশলে এড়িয়ে যায় লাবণ্য। মীরুকে জানতে দেয়নি। ছেলেটির সরলতা ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়। সেই থেকে মীরুর সঙ্গে লাবণ্যের একটা অলিখিত স্বাভাবিক সম্পর্ক চলতে থাকে। দেখা-সাক্ষাৎও হয়। কাছাকাছি হয়। সাদামাটা বন্ধুত্বটুকুই। ব্যস্ এরচে বেশি কিছু নয়। মীরু পুরোপুরিভাবে মজে আছে প্রথমাতে। শক্ত বন্ধনে গেঁথে দুজনের সম্পর্ক। তবুও লাবণ্য মনকে বুঝাতে পারে না। কোথাও যেন ছেলেমানুষি হয় মন। বোবা কান্নায় কেঁদে ওঠে। উথলে ওঠে প্রেম। প্রেমের কুঞ্জবনে অবাধ্য দুষ্টু কোকিলটা কুহু কুহু করে ডেকে ওঠে। খোলা আকাশের নিচে পথের পর পথ ছেলেটির হাত ধরে পাশাপাশি হেঁটে যেতে মন চায়। উচ্ছল ফড়িংয়ের মতো ওড়ে যেতে মন চায় দৃষ্টিরও সীমানা ছাড়িয়ে।

কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে আসে লাবণ্য টেরি পায়নি। বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। মনে মনে ভাবে, লাবণ্যদের প্রেমের খায়েশ থাকতে নেই। এমনটা ভাবাও যে পাপ। মীরুর মতো ছেলেদের ঠকানো ঘোরতর অন্যায়, অপরাধ। বরং মীরুর সঙ্গে যেটুকু রয়েছে তাতেই ঢের। রাতের আঁধারে রং নিয়ে যত খেলা লাবণ্যের, কিন্তু নিজের জন্য এতটুকুন রংও অবশিষ্ট নেই। মীরু লাবণ্যের রংহীন জীবনে কিঞ্চিৎ রঙের ছটা মাত্র। সমাজ ও বাস্তবতায় সম্ভব না হলেও কল্পনার রাজ্যে মীরু ঠিকই রোজ আসে। সেখানে বাঁধা-বিপত্তিহীন এক স্বপ্নিল আপন ভুবন গড়ে তুলেছে লাবণ্য। সেখানে সেই সর্বেসর্বা। কোনো প্রথমার অস্তিত্ব-ফস্তিত্ব নেই। নিরেট বাস্তবতার চোরাগলিতে যদিও এসব রঙ ও ভাবাবেগের কোনো মূল্য নেই। এখানে বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রামে দিনশেষে কামনার জৈবিক চাহিদাটুকুই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এখানে প্রতিটা রাত নেমে আসে হিংস্রতার অট্টহাসি দিয়ে। কাল বৈশাখীর উন্মত্ততা ছাপিয়ে পশু খায় পশুর মাংস, মানুষ মানুষের। যুগে যুগে মাংসের প্রতিই যত কামনা-বাসনা ও লোভ। ভেতরের মানুষটাকে নিয়ে নয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close